ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েক হাজার অবৈধ ব্যাটারি রিকশা। একই সঙ্গে রয়েছে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, ভ্যানগাড়ি, নসিমনসহ তিন চাকার ছোট যানবাহন। মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব যানবাহন। এসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। সর্বশেষ গত রবিবার কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের লালমাইয়ে বাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৬ জনসহ নিহত হয়েছে ৮ জন। রবিবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে লালমাই উপজেলার জামতলী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মহাসড়কে চলছে এসব যানবাহন। সরেজমিন এসব যানবাহনের টোকেন বাণিজ্যের প্রমাণও পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যাটারি রিকশা চালক বলেন, পুলিশকে টাকা দিয়ে তারা সড়কে গাড়ি চালানোর অনুমতি নিয়েছেন। প্রতিমাসে এসব টোকেন সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন মালিক সমিতি ও সংগঠনের নামে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এশিয়া লাইন পরিবহনের চালক মো. আমজাদ হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ব্যাটারি রিকশা, সিএনজি অটোরিকশার জন্য সড়কে গাড়ি চালানো কঠিন। এসব গাড়ির চালকের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। সড়কের যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ করেই ইউটার্ন নিয়ে বসে। এসব কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়। তিনি বলেন, আমরা বারবার বলার পরেও মহাসড়কে ব্যাটারি রিকশা, প্যাডেল রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, ভ্যানগাড়ি, নসিমনসহ তিন চাকার ছোট যানবাহনগুলো বন্ধ হচ্ছে না। হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় থানা পুলিশকে টাকা দিয়ে এসব গাড়ি সড়কে চলছে। যার কারনে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। অনেকেই হচ্ছেন পঙ্গু। অথচ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় চার বছর আগেই মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করলেও তা বন্ধ হয়নি। ঘন ঘন দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির জন্য এ ধরনের যান বহুলাংশে দায়ী হলেও কিছুতেই মহাসড়কে এগুলোর চলাচল থামানো যাচ্ছে না।
তবে মহাসড়কে অল্প-মাঝারি দূরত্বে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে তীব্র চাহিদা থাকায় এবং গরিবদের জীবিকার প্রয়োজনে এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকার বিকল্প ব্যবস্থাও করছে না। স্থানীয় সরকারের অনুমতি নিয়ে ও চাঁদাবাজদের সন্তুষ্ট করে তিন চাকার যান চালু রয়েছে। ফলে মহাসড়কে নিরাপত্তার ভয়াবহ ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। মহাসড়কে দ্রুতগতির বাস-ট্রাকের সঙ্গে এই কম গতির যানবাহন বিপজ্জনক। এসব অবৈধ যান সড়ক থেকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এগুলো বন্ধ করতে প্রায়ই চলে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অভিযান। মহাসড়কে দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশ মাঝেমধ্যে এদের ধরে। অভিযান চললে ক›দিন অল্পস্বল্প চলে, ধরপাকড় থেমে গেলে আবার মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ায়।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাজনীতিকদের সহায়তাতেই অবৈধ যান চলাচল করে মহাসড়কে। স্থানীয়ভাবে দৈনিক ৪০০/৫০০ টাকা চাঁদা দিয়ে চলছে। ইজিবাইকও একই প্রক্রিয়ায় চলছে। ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়িকে নিবন্ধন দেয় না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ২০১১ সালে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু চালু গাড়িগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার শর্তে সেগুলোর জন্য যন্ত্রাংশ আমদানি করতে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে যন্ত্রাংশের নামেই বিক্রি হয়ে চলেছে আস্ত গাড়ি। বিআরটিএ নিবন্ধন না দিলেও পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ লাইসেন্স দিচ্ছে। স্থানীয়ভাবে চাঁদা দিয়ে অবাধে চলছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত যানবাহন। এ ব্যাপারে কুমিল্লা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, স্টিকার ও টোকেন বাণিজ্য এখন নেই। গতিকম এ ধরনের যানবাহন মহাসড়কের যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে জরিমানা প্রদানসহ মামলা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক জানিয়েছেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ ধীরগতির যানবাহন। তিনি বলেন, মহাসড়কে বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট গাড়ির মতো দ্রুতগতির যান যেমন চলে, একই সঙ্গে চলে ধীরগতির অটোরিকশা, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত গাড়ি ও রিকশা। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে মহাসড়কে এমন বারোয়ারি যান চলাচল করে না। ধীরগতির যানবাহনের কারণে দ্রুতগতির যান দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ধীরগতির যানগুলো দুর্বল হওয়ায় এর যাত্রী ও চালকদের নিরাপত্তা নেই। সামান্য টোকা লাগলে বড় সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটে। মহাসড়ক নিরাপদ করতে দ্রুতগতি ও ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক সড়ক বা লেন থাকতে হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ২২টি জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। তিন চাকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতিবাদে মহাসড়কে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। ব্যাপক জনভোগান্তি হলেও সরকার চাপের কাছে নতিস্বীকার করেনি। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহনের চলাচল বন্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু অভিযানের গতি কমতেই মহাসড়কে ফিরতে শুরু করে তিন চাকাসহ সব ধরনের অবৈধ যানবাহন। গত দু’দিন সরেজমিন ঢাকা-চট্রগ্রাম, কুমিল্লা-নোয়াখালী এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে দেখা যায়, শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশা নয়, চার্জকৃত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, টেম্পো, ভারতীয় মাহিন্দ্রের মতো বিপদজ্জনক যানবাহনও চলছে দেখা গেছে। ‹নিরাপদ চালক চাই› এর সম্বনয়ক আজাদ হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, হাইকোর্ট ও মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেওয়ার পরও অবৈধ যানবাহন বন্ধ হচ্ছে না। তাহলে কার নির্দেশে বন্ধ হবে ? হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন যদি সড়ককে নিরাপদ রাখতে এগুলো বন্ধ না করে, তাহলে কারও কিছু করার থাকবে না। গতকাল সোমবার ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে সরেজমিন দাউদকান্দি থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কের দাউদকান্দি বিশ্বরোড, হাসানপুর, বারপাড়া, গৌরীপুর, রায়পুর, ইলিয়টগঞ্জ, মাধাইয়া, চান্দিনা, জাগুরঝুলি, পদুয়ার বাজার এলাকায় বিপুলসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিছু সংযোগ সড়কে চলছে। আবার কিছু মহাসড়কেই চলছে।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ কুমিল্লা সহকারী-পরিচালক মোঃ নুরুজ্জামান জানিয়েছেন, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অবৈধ যানমুক্ত করা যাবে না। সবাইকে সচেতন হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন