মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন

অলোক আচার্য | প্রকাশের সময় : ২৩ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

এই সুন্দর পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যে গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে অচিরেই পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও অধিকাংশ দেশের জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিযোজন শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। পৃথিবীর বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল একসময় সুশীতল, বিষমুক্ত ছিল। সেই আগের মতো বাযুমন্ডল পেতে হলে কমপক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বায়ুমন্ডল হয়ে উঠবে সেই ১০০ বছর আগের মতো। এমনটাই জানিয়েছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণা। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স’ এ গবেষনাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র গাছ লাগালেই আসন্ন সংকট থেকে সমাধান সম্ভব। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে অনেরক নিচু শহর মারাত্বক হুমকিতে রয়েছে। আর শিল্পায়নের জোয়ারে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়েই চলেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এক লাখ কোটি গাছ লাগাতে জমির অভাব হবে না। হিসেব করে দেখিয়েছে, যদি আপনার সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকে দ্রুত এক লাখ কোটি গাছ বসিয়ে ফেলার তাহলে অন্তত জায়গার অভাবে সেসব গাছের বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। সম্প্রতি ইথিওপিয়ায় একদিন ৩৫ কোটি গাছ লাগিয়ে রেকর্ড গড়েছে। প্রশ্নটা রেকর্ডের নয় অস্তিত্তে¡র। জলবায়ু পরিবর্তন ধারনাটি আরও কয়েক দশক আগে থেকেই জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু আলোচনার সাথে সাথে জলবায়ু জনিত পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে কার্যত জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছে এবং সারাবিশ^ এখন এর ফল ভোগ করছে। উন্নত বা অনুন্নত দেশ কেউ এর প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না। তবে সক্ষমতা বিবেচনায় এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণে কারও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ রয়েছে আর কারও সে সামর্থ্য কম। আজ জলবায়ু পরিবর্তনে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক. জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করা। দুই. অভিযোজন করা অর্থাৎ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। গত বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সব দেশ সম্মত হয়েছে। কার্যত গত পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ দিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তীব্র শীত বা খরা, অতিবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড়, তীব্র তাপদাহ, অসময়ে বন্যা,ভূমিধস, টর্নেডো ও সুনামীর মত মারাত্বক সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

এখন সব দেশ একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে পৃথিবী এক ভয়ংকর সংকটে পরতে যাচ্ছে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ না নেয়া হয়। সম্প্রতি ইউরোপ-আমেরিকায় তীব্র শীতে জমে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আবার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় তীব্র গরম। সৌদি আরবে ধূলিঝড়সহ ভারী বর্ষণে বিপর্যস্থ হয়েছে মাত্র কদিন আগেই। ইন্দোনেশিয়ার বন্যা এবং ভূমিধসে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আমাদের দেশও জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভারতের রাজধানী দিল্লী এক অদ্ভূত কুয়াশায় ঢেকে রয়েছে বহুদিন ধরে। বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের অভিবাসী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, ২০১১ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৯৬ ভাগ অভিবাসী তৈরি হবে। তলিয়ে যাবে দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। লবণাক্ততা বেড়ে ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি ও ফসল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে উদ্বৃত করে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভূখন্ড পানিতে তলিয়ে যাবে।বৃষ্টিপাতের পরিমাণে পরিবর্তন হলে খরা বেড়ে যাবে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পরবে। আইপিসিসি তাদেও সর্বশেষ প্রতিবেদনে দাবী করেছে, বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধিও হার ১ দশমিক ৫ এ সীমিত রাখতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে হবে। তবে আইপিসিসির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয় উষ্ণতা বৃদ্ধিও হার ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতেই কার্বন নিঃসরণ সীমিত করতে হবে আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হারে। গত কয়েক বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে শিলাবৃষ্টিতে প্রচুর ফসল নষ্ট হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই রাজশাহী ও কুষ্টিয়ায় ব্যাপক শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত বন্যা খরা ও সাইক্লোনে গড়ে প্রতিবছর শুধু ধান ও গম উৎপাদনে ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ডলার। যা মোট উৎপাদনের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।২০১০ সালে করা এক হিসাবে বলা হয়েছে বছওে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে শুধু ধান ও গম উৎপাদনে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ১৯৮৮ সালের বন্যায়। যার পরিমাণ ছিল গড়ে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। ২০০১৭ সালে শুধু সাইক্লোন সিডওের আঘাতে দেশে ৬ লাখ ৯০ হাজার হেক্টারের ফসলহানি হয়েছে। সেই সাথে ৪ লাখ ৬০ হাজার পশুও মারা গেছে। এটুকু আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদেও দেশে সরাসরি কৃষিখাতে প্রভাব ফেলছে।

আমাদের দেশের জলবায়ুর কথা বলি। ষড় ঋতুর এই দেশে এখন ছয়টি ঋতু আলাদা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রীতিমতো নাম গুণে বের করতে হয়। কারণ যখন যে আবহাওয়া থাকার কথা তখন তা থাকছে না। শীতের সময়ে খুব অল্প সময় শীত অনুভূত হয়। যখন গরম আসার কথা তখন শীত থাকে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি তো আমাদের লেগেই আছে। প্রকৃতি তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। আমরাও প্রকৃতির খেয়ালের সাথে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষতি পোষাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বের কার্বন নিঃস্বরণকারী দেশগুলো মধ্যে অন্যতম হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা মূলত এরকম বড় বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সাথে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। সব মিলিয়ে অবস্থা যে ভজঘট সেটা বোঝা যায়। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু তাই বলে বসে থাকার কোন উপায় নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। যদি এটা মনে করি যে এই ভূমিকা সরকার একা করবে তাহলে এটা ভুল চিন্তা। আমরা নিজেদের উদ্যেগেও কাজ শুরু করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাবো। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখি, জ্বলোচ্ছাস, টর্নেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে। পরিবেশের পরিবর্তিত প্রভাব নিয়ে চলছে নানা ধরণের সাবধানবাণী। আমাদের জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। যখন শীত আসার কথা তখন না এসে শীত আসছে দেরীতে। আবার যখন বৃষ্টি হওয়ার দরকার তখন না হয়ে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হলো। পরিবেশের বিরূপ অবস্থার সাথে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত সামর্থ আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মত প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। সেই সংগ্রামের রেশ থামতে না থামতেই আবারো নতুন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎপত্তি হচ্ছে। চলতি বছর বন্যায় আমাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পরবর্তী মোকাবেলাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঘূর্ণিঝর নিত্যনতুন নাম আর ভয়ংকর চেহারা নিয়ে আমাদের সাজানো গোছানো সংসারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে। যখনই সংকট সামনে এসেছে তখনই আমরা এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে সেই বিষয়টা আমরা ভুলতে থাকি। শুধু সেইসব মানুষের মনে দাগ থেকে যায় যারা এর শিকার হয়েছে। বহু বছর তারা এর ক্ষতচিহ্ন বহন করে। সবশেষ কথা নতুন নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের প্রতিবছর আঘাত করছে। তারপর যখন সবকিছু কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় তখন আবারো কোন নতুন দুর্যোগের কবলে পড়ে। তার থেকে ভালো পৃথিবীতে এক লাখ কোটি গাছ লাগিয়ে পরিবেশটা সেই নির্মল করে তোলা। এর ফলে বাতাসও বিষমুক্ত হবে আবার উষ্ণায়নের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। সেই কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন