শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

হতাশার চোরাবালিতে আটকা পড়েছে অসহায় রোহিঙ্গারা

স্বদেশে গণহত্যা বিদেশে দুর্দশা-১

নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিনিধি, মিয়ানমার সীমান্তের এনগা খু ইয়া থেকে | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

কক্সবাজারের কাছে কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির


কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা বেশ খানিকটা জায়গা। কয়েকটি স্থাপনা রয়েছে সেখানে। সুমসাম, সার দিয়ে রাখা হয়েছে কিছু ট্রেলার। এটা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন্দ্র। শূন্য, অভ্যর্থনার কোনো পরিবেশ সেখানে অনুপস্থিত। দেখে মনে হয়, একটি কারাগার যেটা বন্দিদের আগমনের জন্য অপেক্ষমাণ।

খালি ট্রেইলার, ডেস্কের পিছনে ঘুরঘুর করতে থাকা অফিসারদের মুখে বহু কষ্টে টেনে আনা হাসি। লক্ষণ দেখে মনে হয়, তারা মিয়ানমারে ফিরে আসার রোহিঙ্গাদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। কেউ তাদের ফটো তুলবেন। কেউ পরীক্ষা করবেন তাদের পরিচয়পত্র।
লোকজন নিরাপত্তা লাঠি হাতে দন্ডায়মান। কারো মনে হতেই পারে যে এটি প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকার অতিথি অভ্যর্থনাবিমুখ একটি বন্দিশিবির নয়। যেন একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। এই এনগা খু ইয়া প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে যারা নেই তারা হচ্ছে রোহিঙ্গা।

দুই বছর আগে এই রোববারে নিষ্ঠুর জাতিগত নিধনের কবল থেকে রক্ষা পেতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালাতে শুরু করে। অচিরেই তাদের সংখ্যা পৌঁছে সাড়ে ৭ লাখে। উভয় দেশের সরকারই বারবার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করতে থাকে যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরা আসন্ন।
কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। বারবার তা ভেঙে গেছে। লাখ লাখ তো দূরের কথা। হাজার হাজার রোহিঙ্গাও স্বদেশের মাটিতে ফেরেনি। আসলে তারা ফিরবে কিনা বলা বলা কঠিন। তাদের মিয়ানমারে ফেরা নিরাপদ। এই আশ্বাসের পরও কয়েক ডজন মাত্র রোহিঙ্গা ফিরে গেছে।

এক হাজার ২০০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকারীর প্রথম দলটির ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু শতাব্দীর ভয়াবহতম জাতিগত নিধনের কেন্দ্রস্থলে আতঙ্কিত মানুষদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালেচনার মুখে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাদের এই প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা বিলম্বিত হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নিরাপদ, স্বেচ্ছাভিত্তিক ও মর্যাদাজনক প্রত্যাবসনের অঙ্গীকার করার পর রোহিঙ্গাদের ফেরার কয়েকটি নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু কেউ ফেরেনি।
অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার জানায় যে ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গার সীমান্ত অতিক্রম ছাড়াই দিনটি পেরিয়ে গেছে। এতে এটাই বোঝা যা যে দুই পক্ষের জন্যই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন রাজনৈতিক ভাবে হওয়া প্রয়োজন।

জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গা হত্যা শুরুর জন্য মিয়ানমারকে গণহত্যার অভিযোগে বিচার করতে হবে। মিয়ানমারকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অপরাধী নয়।

দারিদ্র্য ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার বিরুদ্ধে লড়াইরত বাংলাদেশ তার নাগরিকদের নিশ্চিত করতে চায় যে দেশটির কষ্টার্জিত অর্থ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে না। কিন্তু এনগা খু ইয়া রোহিঙ্গা উপস্থিতিহীন অভ্যর্থনা কেন্দ্রের ক্ষয়ে যাওয়া ভবনগুলো প্রমাণ করছে যে মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন অঙ্গীকার মিথ্যা ছিল। জায়গাটি এত নির্জন যে প্রধান প্রবেশ পথে একটি কুকুর বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এমনকি প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের নজরদারি টাওয়ারটিও সৈন্যহীন ছিল। নজরদারি করছিল না কেউ সেখানে।

প্রত্যাবাসনের ভুয়া অঙ্গীকার : বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ না ফেরা আগের আরো বহু বেদনাদায়ক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। প্রথমত, মিয়ানমার একতরফাভাবে প্রত্যাবাসনের তারিখ ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের বিবেচনায় উপযুক্ত এমন অল্পসংখ্যককে মাত্র ফেরার অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ তখন বলেছে যে তারা এ ধারণাকে সমর্থন করে।

আগস্টের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, আমি খুবই ইতিবাচক। আমি আশাবাদী যে এ মাসেই রোহিঙ্গাদের ফেরা শুরু হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের উপচে পড়া আশ্রয় শিবিরগুলোতে অবস্থানরত লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সামান্যই পরামর্শ পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার তাদের মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা ৫টি বাস ও ২টি ট্রাকের কোনোটিতেই কোনো রোহিঙ্গা আরোহণ করেনি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ তাদের কারো ফেরার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে। তারা আতঙ্কিত, ফেরার আনন্দহীন প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করছে।
বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের একজন বিশেষজ্ঞ রাধিকা কুমারস্বামী বলেন, পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের অনুক‚ল নয়।

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমাদের উপগ্রহ ছবি দেখানো হয়েছে। তাতে উত্তর রাখাইনের পরিস্থিতি দেখা গেছে যে সেখানে সকল গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একটি গাছও সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। এ বিষয়টি মিয়ানমার পক্ষকে এ কথা বলার সুযোগ দিয়েছে যে তারা বিস্মিত কেন রোহিঙ্গারা ফিরে আসছে না।
রাখাইন রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র উ উইন মিন্ট বলেন, কেন প্রত্যাবাসন হচ্ছে না সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। আমাদের পক্ষ থেকে সব কিছুই প্রস্তুত। এই একই ঘটনা আগেও ঘটেছে, ফলাফল হয়েছে শূন্য। (অসমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন