বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সোনালি আসর

প্রীতি ফুটবল ম্যাচ

প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হেল বাকী : হিজলদের স্কুল আর সিদরানদের স্কুলের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। খেলা হবে শুক্রবার বিকেলে। হিজলদের স্কুলের সেরা ফুটবলার হিজল। এলাকার সেরা স্ট্রাইকার। মাঝমাঠ থেকে বল ড্রিবলিং করে নিয়ে একাই গোল করে ফেলে। তার পক্ষের সবাই তখন হিজল হিজল বলে হুল্লোড় করতে থাকে। হাততালিতে কানে তালা লেগে যায়। ওদিকে সিদরান মাঝমাঠের তুখোড় খেলোয়াড়। দুরন্ত। সারা মাঝমাঠ একাই সামলায়। নিখুঁত পাস। গোল পোস্টে তার শট খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বল নিয়ে কারিকুরিতে সে দক্ষ। পলাশপুরে তাকে মেসি নামে ডাকা হয়।
এখানে একটি কথা বলা হয়নি। হিজলদের স্কুল শিমুলপুর গ্রামে। আর সিদরানদের স্কুল পলাশপুর গ্রামে। পাশাপাশি দুটি আদর্শ গ্রাম। ছোট্ট গ্রাম। অথচ কত শিক্ষিত লোক! রাস্তাঘাটে হাঁটতে গেলে কত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকের বড় কর্মকর্তার সাথে দেখা হয়ে যায়! গ্রামের মানুষে মানুষে কত সখ্য। একজন আরেকজনের সমব্যথী। একের বিপদে আরেকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক গ্রামে ভালো কিছু হলে আরেক গ্রাম সেটা অনুসরণ করে। কিছুদিন আগে, পলাশপুর গ্রামকে যৌতুকমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলো। এর ঠিক এক মাসের মাথায় শিমুলপুর গ্রামকেও যৌতুকমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হলো। ভালো কাজে দুই গ্রামের মধ্যে প্রতিযোগিতা। শিক্ষা নাকি মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে! শহরে অনেক শিক্ষিত লোকের বাস। এক ফ্ল্যাটের লোক আরেক ফ্ল্যাটের লোককে চিনে না। দেখা গেল এক ফ্ল্যাটে কেউ মারা গেছে। পাশের ফ্ল্যাটে লোকজন চুটিয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। আর গ্রামের মানুষের মধ্যে কত একতা! মাঠে একটা শিয়াল বের হলে-দৌড়াতে দৌড়াতে দুই গ্রামের মানুষ এক হয়ে যায়! একটা আনন্দের উৎস হয়ে যায়। পলাশপুর আর শিমুলপুর যেন এক সুতায় গাঁথা। শিমুলপুরের চাকরিজীবী লোকেরা মিলে একটি ফান্ড গঠন করল। নাম দিল বাইতুলমাল। দারিদ্র্য বিমোচন হবে এ ফান্ডের মূল লক্ষ্য। এ কথা চাউর হওয়ামাত্র পলাশপুর গ্রামও বাইতুলমাল গঠন করে ফেলল। কোন গ্রামে কোন সমস্যা হলে সবাই একসাথে বসে সমাধান করে ফেলে।
দুই গ্রামের মধ্যে সবকিছুতে প্রচ্ছন্ন একটা প্রতিযোগিতা। তাই প্রীতি ম্যাচ হলেও কেউ হারতে চাবে নাÑ এটাই স্বাভাবিক। হিজলদের স্কুলের যেহেতু সেরা খেলোয়াড় হিজল। তাই মূল পরিকল্পনা তাকেই আঁটতে হচ্ছে। পলাশপুর স্কুলের খেলোয়াড় সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করছে। একদিন অন্তর একটি খবর দিল। পলাশপুরের অধিকাংশ খেলোয়াড় নাকি খালি পায়ে খেলতে আগ্রহী। একথা শুনে হিজল বলল, ‘খালি পায়ে খেলার দিন অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে ফিফা বিশ্বকাপে, ভারত খালি পায়ে খেলার অনুমতি পায়নি বলে দল প্রত্যাহার করেছিল। এখন ২০১৪। খালি পায়ে খেলার প্রশ্নই উঠে না।’
হঠাৎ তার মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে অন্তর, ডিউক, শাওন আর রিফাতকে ডেকে তার পরিকল্পনার কথা জানাল। সবই তার পরিকল্পনার কথা মেনে নিলেও শাওন মেনে নিল না। শাওন বলল, ‘কাজটা ঠিক হবে না।’ গায়ের জোরে খেলায় জেতা যায় না জিততে হয় বুদ্ধির জোরে। এটা আমাদের একটা কৌশলমাত্র, হিজল বলল। শাওন বলল, ‘তবুও নৈতিকতা বলতে একটা কথা আছে।’ ‘আরে এটাতো প্রীতি ম্যাচ। এখানে একটু মজা করতেই পারি, হিজল বলল। অবশেষে হিজলের কথা সবাই মেনে নিল। সিদ্ধান্ত হলো তারা মাঠে নামবে বারো জন। ডিউক বলল, ‘যদি ধরা পড়ে যাই-মান সম্মান কিছু থাকবে না।’ তার কথা কেড়ে নিয়ে হিজল বলল, ‘এখানে ধরা পড়ার কী আছে। এটাতো কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ নয়। আমাদেরতো মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে হবে না- যে ধরা পড়ে যাব। আর যদি ধরা পড়িই, তাহলে আমরা বলব, ভুলে একজন বেশি নেমে গেছি। সাঈদকে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নামানোর কথা ছিল। সে ভুলে আমাদের সাথে নেমে গেছে। ঘটনা শেষ।’
শুক্রবার বিকেল। আকাশের মুখ গোমড়া। আকাশে পোয়াতি মেঘের সাবধানী চলাফেরা। এর মাঝে খেলা শুরু হলো। পলাশপুরের এক বিশাল মাঠে তুমুল লড়াই। ট্যাকল। ড্রিবলিং। ছন্দোময় খেলা। কেউ কাউকে হারাতে পারে না। সামনে সমান। খেলার পঞ্চাশ মিনিটের সময় দূর থেকে দুর্দান্ত এক শটে গোল করে ফেলল হিজল। চারদিকে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। এই গোলের রেশ কাটতে না কাটতেই, মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে একেবারে গোল পোস্টে ঢুকে গেল সিদরান। পলাশপুরের মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচল। সবাই মোটামুটি ধরে নিল খেলা এক এক গোলে ড্র হবে। শিমুলপুর স্কুল সবচেয়ে বড় চমক দেখাল খেলার ৮০ মিনিটের সময়। শাওনের করা কর্নার শটে হিজল দর্শনীয় এক হেডের মাধ্যমে বল জালে পাঠিয়ে দিল। শিমুলপুর আনন্দে ভাসছে। পলাশপুরের চোখে-মুখে মেঘের কালো ছায়া। এমন সময় মাঠে বোমা ফাটিয়ে দিল ট্যারা চন্দন। সে শিমুলপুর স্কুলের ছাত্র। তাকে মাঠে নামানোর কথা ছিল। নামায়নি। সব ফাঁস করে দিল। শুরু হয়ে গেল হই-হুল্লোড়। হিজলরা বলল, ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে।’ কে শুনে কার কথা। চারদিক থেকে ধর ধর ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। কেউ কেউ গলা উঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘মেরে ব্যাটাদের ঠ্যাং ভেঙে দে। ভÐামি করার জায়গা পায় না।’
নিরুপায় হয়ে হিজলরা জনগণ ঠেলে দিল দৌড়। প্রায় আধা মাইল মাঠ তারা দৌড়ে পার হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে একেকজন একেক কথা বলতে লাগল। শাওন বলল, ‘আমি আগেই বলেছিলাম কাজটা ঠিক না’ ডিউক বলল, ‘চন্দনকে ধোলাই দেয়া উচিত।’ হিজল সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। জনগণ খেলা দেখে যে মজা পেয়েছে, তারচেয়ে বেশি মজা পেয়েছে আমাদের এই ঘটনায়। আজকের দিনটা আমাদের কাছে মিষ্টি মধুর এক স্মৃতি হয়ে থাকবে।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন