সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

নুসরাত হত্যায় অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জনের ফাঁসি

ছাগলনাইয়া থেকে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১১:২৯ এএম | আপডেট : ৪:৩৯ পিএম, ২৪ অক্টোবর, ২০১৯

বহুল আলোচিত মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ১৬ আসামীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। আজ (২৪ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক মামুনুর রশিদ চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মাত্র সাড়ে ৬ মাসের মাথায় নিষ্পত্তি হয়েছে বর্বরোচিত এ হত্যা মামলা। দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন গ্রেফতারকৃত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, মাদরাসার প্রভাষক নুরুল আবছার, হেফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, মোহাম্মদ শামীম, ছাত্রদল নেতা নূর উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুসরাতের সহপাঠি উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল।রায় পড়তে সময় লাগে ১২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড। রায়ে ১৬ জন আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন আদালত। রায় পড়ার শুরুতেই নুসরাত জাহান হত্যা মামলায় গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করেন আদালত। আদালত বলেন, গণমাধ্যমের কারণেই এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের ঘটনা দেশবাসী জানতে পারে।এর আগে সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে আসামিদের কাঠগড়ায় আনা হয়। ৩ মিনিটের মধ্যে আসামিদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। রায় শোনার পর আসামিরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ জানান উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তাঁরা। আসামিরা এ সময় বাদী পক্ষের আইনজীবীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন। পরে পুলিশ পাহারায় আইনজীবীদের সরিয়ে দেওয়া হয়।


এ রায় দৃষ্টান্ত, রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট : পি পি হাফেজ আহম্মদ
নুসরাত হত্যায় এ রায়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি ফেনী জজ কোর্টের পিপি হাফেজ আহম্মদ।তিনি বলেন, রাষ্টপক্ষ রায়ে সন্তুষ্ট। এমন রায় প্রমাণ করে অপরাধী যেই হোক কারও কোনো ছাড় নেই। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) বেলা সোয়া ১১টার দিকে নুসরাত হত্যার রায় ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের একথা জানান।‘মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো দুনিয়া জানাতে পেরেছে এ ঘটনা। আসামি যতই প্রভাবশালী হোক কেউই যে অপরাধ করে পার পাবে না সেটা প্রমাণ হলো।এসময় উপস্থিত ছিলেন পিপি প্রিয় রঞ্জন, নুসরাতের আইনজীবী শাহজাহান সাজু প্রমুখ।

এ রায় দুর্ভাগ্যজনক, অনাকাঙ্খিত : আসামিপক্ষের আইনজীবী
এ রায় প্রত্যাশিত রায় হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন নুসরাত হত্যা মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু। বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) রায় ঘোষণার পর এ প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এ রায় দুর্ভাগ্যজনক, অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত। রাষ্ট্রপক্ষ কোনো অপরাধ সামান্যতমও প্রমাণ করতে পারেনি।তিনি বলেন, খোদ ডাইং ডিক্লারেশনে নুসরাত কোনো আসামিকে দোষারোপ করেননি। আমরা আপিল করবো সাতদিনের মধ্যে। হাইকোর্টের বিচারক আপিলে সবাইকে খালাস দেবেন, এটা আমাদের নিশ্চিত প্রত্যাশা।‘আমরা এ রায়ে অসন্তুষ্ট। উচ্চ আদালতে যাবো। এই রায় শেষ রায় নয়। কেউ আসামি শামীমের নাম বলেননি। কোনো কোনো আসামির জন্য একজনও সাক্ষী দেননি। যা বলার উচ্চ আদালতে বলবো

নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে পরিবার সন্তুষ্ট
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার বাবা এ কে এম মুসা , বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ।বৃহস্পতিবার সকালে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় ঘোষণা করেন। এরপরই আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের কাছে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন এ রায়ে আমারা সন্তুষ্ট । আমরা আশাবাদী খুব দ্রুত রায় কার্যকর হবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞগতা প্রকাশ করেন।নুসরাতের বাবা বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকর হলে নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে।

আদালতে নুসরাতের ভাইকে আসামীদের হুমকী
মামলার বাদী নুসরাত জাহান রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেছেন আসামিরা আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে আমাদের হুমকি দিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছেন।বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) আদালত চত্বরে নুসরাত হত্যার রায় শুনার পর তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকবো। আমরা আশা করবো রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের নিরাপত্তা দেবেন। নোমান আরও বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কৃতজ্ঞতা জানাবো।এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন নুসরাতের আইনজীবী শাহজাহান সাজু, নুসরাতের বাবা মওলানা একেএম মুসা মানিক।

অধ্যক্ষ সিরাজকে অন্য আসামিদের চড়-থাপ্পর
এই রায়ের পর আসামিদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ বা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন প্রধান আসামী ও হত্যকান্ডে মূল ষড়যন্ত্রকারী সোনগাজী মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার ওপর।রায়ের পর আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় অনেকেই কাঁদছিলেন। কেউ কেউ নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। আবার দু’একজন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন অধ্যক্ষ সিরাজের ওপর। একজন চিৎকার করে সিরাজের উদ্দেশ্যে বলেন, তোর কারণে আমাদের ফাঁসি হয়েছে। বলেই সিরাজকে চড়-থাপ্পর দিতে শুরু করেন। এসময় আরো কয়েকজন আসামি যোগ দেয় তার সাথে।সিরাজকে মারতে শুরু করেন কয়েকজন মিলে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের নিবৃত করে।


ওসি মোয়াজ্জেমসহ ৪ পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এই হত্যাকান্ডে বিষয়টি মানুষের সামনে আনার জন্য সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ।রায়ে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনায় ১৬ আসামির অংশগ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের মৃত্যুদন্ডে দ্রুত করা হলো। এছাড়া প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হলো।আসামিপক্ষ আপিল করতে চাইলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আবেদন করতে বলা হয়েছে।মামলার ৮০৮ পৃষ্ঠার রায়ের চুম্বক অংশ পাঠ করেন বিচারক মো. মামুনুর রশিদ। রায়ে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনসহ চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।মামলায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে প্রত্যাহার করা হয়। থানায় হেনস্তা হওয়ার নুসরাতের ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানা পুলিশ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই উপ-পরিদর্শককে (এসআই) বহিষ্কার করা হয়।এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ এনেছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।এগুলো হলো- ১. মামলার কালক্ষেপণ ২. এজহার নিয়ে কূটচাল ৩. গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ দেয়া ৪. নুসরাতকে থানায় জবানবন্দির নামে ওসির হেনস্তা ৫. আইনি বহির্ভূত জিজ্ঞাসাবাদ ৬. প্রথমে অজ্ঞাত মামলা এবং পরে ৮ জনের নাম উল্লেখ করা।


হাসতে হাসতে প্রবেশ করে কাঁদতে কাঁদতে বের হলেন অধ্যক্ষ সিরাজ
আদালত প্রাঙ্গণে বেশ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান ওরফে রাফি হত্যা মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। বৃহস্পতিবার সকালে রায় ঘোষণার পর তাঁকে কাঁদতে দেখা গেছে।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আজ সকালে অধ্যক্ষ সিরাজসহ এই মামলার ১৬ আসামিকে প্রিজনভ্যানে করে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয়। প্রিজনভ্যান থেকে নামার সময় তিনি বেশ হাসিখুশি ছিলেন। হাসতে হাসতে তিনি আদালতের এজলাসে যান। রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত তিনি খোশমেজাজে ছিলেন। তবে আদালতের রায় শুনে কাঁদতে শুরু করেন সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা।


নুসরাতের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী
নুসরাতের উপর নৃশংস ও বর্বর ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এলে তিনি মর্মাহত হয়ে ৭ এপ্রিল তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তাঁর নির্দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিশেষজ্ঞ ৭ চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিকেল টিম গঠন করেন। এ সময় তিনি সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। পরদিন নুসরাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিতে নির্দেশ দেন তিনি। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ডাক্তাররা সেখানকার চিকিৎসকদের সাথে কথাও বলেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর ১৫ এপ্রিল তার মা-বাবাকে প্রধানমন্ত্রী নিজ দপ্তরে ডেকে সান্তনা দিয়ে ন্যায় বিচারের অশ্বাস দেন।
নুসরাত হত্যাকান্ড:এক পলকে ঘটনাপ্রবাহঃ
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপি আলোচনার ঝড় তোলে ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির লোমহর্ষক নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা। নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে তারই নির্দেশে সহযোগিরা একই মাদরাসা ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করে। ঘটনার ৬ মাস ১৮ দিন পর আলোচিত এ হত্যাকান্ডের রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ। নুসরাতের পুরো ঘটনাপ্রবাহ এক পলকে তুলে ধরা হলো-নুসরাতের শ্লীলতাহানিচলতি বছরের ২৭ মার্চ মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। রাগে-ক্ষোভে নুসরাত সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। তার অভিযোগের ভিত্তিতে ওইদিন পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরদিন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে একমাত্র আসামী করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে তাকে সে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।নুসরাতকে ওসি মোয়াজ্জেমের বেআইনি জেরা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করলে ২৭ মার্চ নুসরাত ও অধ্যক্ষকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে নুসরাতকে নিজ কক্ষে এনে বেআইনিভাবে জেরা ও তার ভিডিও ধারণ করেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, থানায় ওসির সামনে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরাত। নুসরাত তার মুখ দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন। সে সময় ওসি মোয়াজ্জেম ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনও তোমাকে কাঁদতে হবে’।অধ্যক্ষের মুক্তি ও বিচার দাবীতে পাল্টা-পাল্টি বিক্ষোভঅধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার আটকের পর ২৮ মার্চ সোনাগাজীর জিরো পয়েন্টে তার সহযোগিরা পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের নেতৃত্বে ‘অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা মুক্তি পরিষদ’-এর ব্যানারে বিক্ষোভ করে। একই সময়ে সিরাজ উদ দৌলার বিচারের দাবিতে আরেক কাউন্সিলর শেখ আবদুল হালিম মামুনের নেতৃত্বে আরেকটি বিক্ষোভ হয়। সেখানে দুই কাউন্সিলরের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে নুসরাত হত্যাকান্ডের ঘটনায় অধ্যক্ষের পক্ষে বিক্ষোভে অংশ নেয়া কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, নুর উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আসামী হয়। কেরোসিন ঢেলে নুসরাতকে হত্যাচেষ্টা ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষার আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে হলে বসলে নুসরাতের বান্ধবি নাসরিন সুলতানা ফুর্তিকে ছাদের উপর মারধর করছে বলে সিরাজ উদ দৌলার শ্যালিকার মেয়ে উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা বা চম্পা বা তুহিন ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে বোরকা, মুখোশ ও হাত মোজা পরা ৪জন দুর্বৃত্ত তাকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। নুসরাত রাজী না হলে এক পর্যায়ে তারা গায়ের ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। আগুনে পুড়ে বাঁধন খুলে গেলে সে চিৎকার করে দৌঁড়ে নিচে নেমে আসে। পরে পুলিশ ও কেন্দ্রে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানায়, নুসরাতের শরীরের ৭০/৮০ শতাংশ পুড়ে যায়।

অধ্যক্ষ-কাউন্সিলরসহ ৮ জনের নামে মামলা
নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে ৮ এপ্রিল তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা (৫৫), সোনাগাজী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুুদ আলম (৪৫), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামিম (২০), জাবেদ হোসেন (১৯), হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), যোবায়ের আহম্মেদ (২০), আবছার উদ্দিনের (৩৫) নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও হাতমোজা, চশমা ও বোরকাপরা ৪জনসহ অজ্ঞাত আরো অনেককে আসামী করা হয়েছে। নুসরাতের মৃত্যু, ওসি প্রত্যাহার ও মামলা পিবিআইতে হস্তান্তর
অগ্নিদগ্ধ নুসরাত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধিন অবস্থায় মারা যান। একইদিন দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পুলিশ হেডকোয়ার্টার সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ানে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। একইদিন মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর হয়।

ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা
নুসরাতের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বেআইনিভাবে জেরা ও ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ১৫ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার ছায়েদুল হক সমুন। ২৭ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলায় ১২৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকার পর ১৬ জুন ঢাকার হাইকোর্ট এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর ২০ দিন আগে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

পুলিশের ৫ সদস্যের তদন্ত টিম
নুসরাত হত্যার ঘটনায় পুলিশের ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে হেডকোয়ার্টার। ১৯ এপ্রিল ঘটনাস্থল ও নুসরাতের বাড়ীতে আসেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্লানিং) এসএম রুহুল আমিন, একই দফতরের অ্যাডিশনাল এসপি স¤্রাট মো. আবু সুফিয়ান, নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহ উদ্দিন আরশেদসহ আরও দুই শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। তদন্ত চলাকালে তারা নুসরাতের মা-বাবা ও ভাই, মাদরাসার পরিচালনা পর্ষদ, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন।

অভিযোগপত্র দাখিল
নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড চেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. শাহ আলম। ২৯ মে বুধবার ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালেত ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রে সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদরাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি ও উপজেলা আ’লীগ সভাপতি রুহুল আমীন এবং মহিউদ্দিন শাকিলের নাম উল্লেখ করে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।


মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে
৩০ মে নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইন মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য সব ধরনের নথিপত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের নির্দেশ দেন। অভিযোপত্র গ্রহণ, ৫ আসামীর মুক্তি ২৯ মে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ১০ জুন তা আমলে নেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ। একইদিন আদালতে ১৬ আসামীর জামিন না মঞ্জুর করে তাদের জেল হাজতে প্রেরণ করেন। একইসঙ্গে হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় নূর হোসেন, আলা উদ্দিন, কেফায়েত উল্যাহ জনি, সাইদুল ও আরিফুল ইসলামকে খালাস দেয় আদালত।

সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা
নুসরাত হত্যা মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমানের মধ্যদিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ২৭ জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদের আদালতে টানা ৬ ঘন্টা ধরে সাক্ষ্যপ্রদান করেন তিনি। পর্যায়ক্রমে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার, বাবা একেএম মুসা মানিক ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানসহ মামলার ৮৭জন সাক্ষী স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে আদালতে সাক্ষ্যপ্রদান করেন। মামলার ৯২জন সাক্ষীর মধ্যে বাকী ৫ জনের নথিপত্র আদালত সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেন।


যৌন হয়রানির মামলার অভিযোগপত্র এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ
৩ জুলাই আদালতে নুসরাতকে যৌন হয়রানির অপর মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. শাহ আলম ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে ২৭১ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার অভিযোগপত্রে ডাক্তার, পুলিশসহ ২৯ জন সাক্ষী রয়েছে। পরদিন ৪ এপ্রিল তিনি এ মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক মো. মামুনুর রশিদের আদালতে প্রেরণ করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Mahmud ২৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:৪৬ পিএম says : 0
আল্লাহর পাকড়াও অনেক কঠিন, আমি চাই এক এক করে সব কটি বিচার হোক, অপরাধীরা যেন পাপ করার আগে হাজার বার ভাবতে হয়।
Total Reply(0)
Miah Muhammad Adel ২৪ অক্টোবর, ২০১৯, ৪:১২ পিএম says : 0
রায় থেকে অপকর্মকারীরা কিছু শিখবে। ধর্ষকদেরও এমন ধরণের সাজা হওয়া উচিত।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন