সদা হাসিমুখ ভদ্রলোকের পুরো নাম কারিঙ্গামান্নু কুঝিয়ুল মুহাম্মদ। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনরা তাকে ‘কেকে’ নামেই ডাকেন। ভারতের কেরালা রাজ্যের কালিকটের বাসিন্দা তিনি। দেশটির প্রতœতত্ত¡ বিভাগ বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ছেষট্টি বছরে এখন অবসর সময় কাটাচ্ছেন।
তিনি অবসরে গেলেও হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। আর এর পেছনে রয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে কর্মরত অবস্থায় তার নেতৃত্বে প্রস্তুত করা একটি রিপোর্ট। অযোধ্যার বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে মন্দির বানানোর পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট শনিবার যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনে এই প্রতœতাত্বিক রিপোর্টটির গুরুত্ব ছিল বিরাট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন বছরকয়েক আগে ভারত সফরে এসেছিলেন, দিল্লির বিভিন্ন প্রতœতাত্বিক স্থানে তার ‘ট্যুর গাইড’ ছিলেন কেকে মুহাম্মদ। তার বহু আগে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ যখন আগ্রা সফরে এসেছিলেন, তাকেও তাজমহল ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল এই প্রতœতত্ববিদের ওপর।
মূলত ওই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মেনে নিয়েছেন, বাবরি মসজিদের স্থাপনার নিচেও বহু পুরনো আর একটি কাঠামো ছিল যেটি ‘ইসলামি ঘরানায়’ নির্মিত নয়। ওই রিপোর্টেই প্রথম স্পষ্টভাবে দাবি করা হয়েছিল যে, বাবরি মসজিদ চত্বরে মসজিদ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।
রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় কে কে মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এটা একেবারে পারফেক্ট জাজমেন্ট। আমার মতে, এর চেয়ে ভালো রায় আর কিছু হতেই পারে না!’
মন্দির বানানোর রায়ের মধ্যে দিয়ে তার দীর্ঘদিনের প্রতœতাত্বিক গবেষণা ও পরিশ্রমই স্বীকৃতি পেল, সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু একজন মুসলিম হয়েও তিনি কীভাবে অযোধ্যার বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে মন্দির ছিল বলে আজীবন যুক্তি দিয়ে গেছেন, সে বিষয়টি এখন বিতর্কিত।
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদকে ঘিরে যে বিতর্ক, সেখানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রতœতাত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে ১৯৭৬ সালে। তখন সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভারতের বিখ্যাত প্রতœতাত্বিক ড. বি বি লাল। তার অধীনেই একজন তরুণ গবেষক হিসেবে যোগ দেন কে কে মুহাম্মদ।
আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করা প্রতœতত্ববিদ কে কে মুহাম্মদ ভারতের রিডিফ ডটকম পোর্টালকে বলেন, “বাবরি মসজিদ চত্বরে খোঁড়াখুঁড়িতে ‘মন্দির প্রণালী’, ‘অভিষেক পানি’ বা ‘মগর (কুমির) প্রণালী’র মতো বিভিন্ন চিহ্ন বা স্মারক দেখা যায়। আর এগুলো তো হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয়েই থাকে। কুমির প্যাটার্নের ওই ধরনের স্থাপনা কখনও মসজিদে থাকে না। তাছাড়া মানুষ ও পশুপাখির বহু টেরাকোটা মোটিফও আমরা সেখানে পেয়েছিলাম, যেগুলো মুঘল আমলের কোনো মসজিদে কখনওই দেখা যায় না।’
পরে এই সব ‘সাক্ষ্যপ্রমাণে’র ভিত্তিতেই ভারতের প্রতœতত্ব বিভাগ তাদের রিপোর্টে এই উপসংহারে পৌঁছায় যে, বাবরি মসজিদ স্থাপনারও অনেক আগে সেখানে হিন্দুদের একটি মন্দির ছিল। সেই রিপোর্টেরই মূল প্রণেতা ছিলেন কে কে মুহাম্মদ। তিনি পরে উত্তর ভারতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা হিসেবে অবসর নেন।
তবে ওই প্রতিবেদন নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এমনকি ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞই ওই রিপোর্টের বিষয়বস্তু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদে মধ্যে অন্যতম ইতিহাসবিদ আরফান হবিব। যদিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা রিপোর্টটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। কে কে মুহাম্মদের দাবি, ইরফান হাবিবের মতো বামপন্থী ইতিহাসবিদরা তখন খুব প্রভাবশালী ছিলেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চে তখন তিনি ও তার মতো বাম ঘরানার লোকজনেরই দাপট ছিল। ফলে তারা আমাদের গবেষণাকে একেবারেই গুরুত্ব দেননি।
তবে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তাদের ওই রিপোর্টটিকে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেয়ায় এই রায়কে জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সম্মান’ বলে মনে করছেন কেকে মুহাম্মদ। প্রতœতত্বে অবদানের জন্য চলতি বছর ভারত সরকার তাকে বেসামরিক খেতাব পদ্মশ্রীতে ভূষিত করেছে।
ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতোমধ্যে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে এই ঐক্যটাই ভারতের সৌন্দর্য! এ জিনিস শুধু ভারতেই সম্ভব! একজন হিন্দু আইনজীবী (রাজীব ধাওয়ান) এদেশে মসজিদের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন! আবার একজন মুসলিম প্রতœতত্ববিদ (কে কে মুহাম্মদ) মন্দিরের পক্ষে রিপোর্ট লিখতেও ভয় পান না!’
সূত্র : বিবিসি বাংলা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন