মুম্বাই এলাকায় কাসুরদে পরিবার তাদের বাড়ি ‘সবিতা ভিলা’র সরু প্রবেশমুখে হিন্দু দেবতা ‘গণেশে’র একটি ছবি ঝোলানো আছে। তাদের বিশ্বাস এটি তাদের পরিবারের চলাচলের পথ থেকে সমস্ত বাধা দূর করবে। কিন্তু এটি মিঠি নদীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি, যেটি এখন তাদের বাড়ির দরজার সামনে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই শহরের ১ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার সাথে এই নদী কাসুরদের চলাচলের পথও বন্ধ করে দিয়েছে।
মুম্বাইয়ের আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরসহ মিঠি নদীর জায়গা ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল সুউচ্চ ভবন ও বিভিন্ন কলোনি। শহরের বেশিরভাগ নিকাশী বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলা হয় এই নদীতে। ফলে একটু ভারী বৃষ্টি হলেই নদী উপচে আশে-পাশের এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যা ঠেকাতে এই নগরীর যে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল, সেই ম্যানগ্রোভ গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে ভবন বানাতে।
গত ৬৫ বছরের মধ্যে এবার মুম্বাইয়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম করে সেখানে এই মৌসুমে বেশ কয়েকবার অতি ভারী বর্ষণ হয়েছিল। ফলে সেখানকার ড্রেনগুলো উপচে পড়ে রাস্তাতেও পানি উঠে যায়। যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়ে। বিমান চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চলতি বছর দুইবার সেখানে বন্য হয়। সে সময়গুলোতে কাসুরদের এলাকার স্কুলগুলো আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রতিবার বন্যার পরে, যখন পানি নামতে শুরু করে, ঘরে ফিরে এসে তাদেরকে নাক ঢেকে ঘর থেকে পানি এবং ময়লা পরিস্কার করতে হয়। জমে থাকা পানিতে মশারা ডিম পাড়ে। সেখানে যে কোন সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ হতে পারে।
সেখানকার একজন বাসিন্দা রাজেশ্রী চন্দন বন্যার সময় তার জীবিকার একমাত্র উৎস, সেলাই মেশিনটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলেও, তাকে এক বস্তা চাল এবং বাচ্চাদের কাপড় ফেলে দিতে হয়েছিল। শুধু মাত্র ভোটের সময় হলেই আসে বলে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি রাজ্যের শীর্ষ রাজনীতিবিদও বছরের শুরুতে শুধু একবার সেখানে গিয়েছিলেন, তারপর আর তাকে দেখা যায়নি বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য এলাকায় সবার কাছে তিনি সমর্থন চেয়েছিলেন। ভোটের সময় তারা গরীবদের জন্য শহরের উত্তরে নতুন বাড়ি বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ রাজনীতিবিদ শুধু পাঁচটি পরিবারের হাতে প্রতীকী প্লাস্টিকের চাবি ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছেন।
অন্যদিকে, মারাঠওয়াদার সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল, ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মতো একই সময়কালে এখানেও আখ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পানি শোষণকারী ফসলগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফকির মোহাম্মদের গ্রামের রাস্তার পাশের একর ও একর জমিতে কৃষকরা আখ রোপণ করেছেন। এসব জামিতে সেচের পানি আসে উপরের বাঁধ থেকে। সেখানে পুরো রাজ্য জুড়েই গড়ে উঠেছে অসংখ্য সুগার মিল। বেশিরভাগের মালিক হয় কিছু রাজনীতিবিদ, না হয় তাদের বন্ধুরা। তারা আখের জন্য অনেক টাকা দেয়। এ কারণেই পানির সংকট সত্তে¡ও সেখানে আখ রোপণ করা হচ্ছে।
অদ্ভ‚ত হলেও সত্যি, ভারতের সরকার বিশ্বের অন্যতম খরা প্রবণ এই এলাকায় চিনি উৎপাদকদের সহায়তা করছে। সরকার তাদের বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, কৃষকদেরকে তাদের আখের ক্ষেতে সেচের জন্য পাম্প দিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে ও আখ উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। কখনও কখনও ঋণ মওকুফও করে দেয়া হয়। বিশেষ করে যখন রাজনীতিবিদরা কৃষকদের কাছে ভোট চাইতে যান। এ বছর সরকার চিনিকলগুলোর জন্য রফতানিতে প্রায় ৮৮০ মিলিয়ন ডলার ভর্তুকির অনুমোদন দিয়েছে।
প্রিন্সটন এনভায়রনমেন্টাল ইনস্টিটিউটের গবেষক রামানান লক্ষিণারায়নের বিশ্লেষণ অনুসারে, এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধার ফলে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে আখের উৎপাদন অন্য যে কোন ফসলের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম চিনির উৎপাদক দেশে পরিণত করেছে। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ভারতে আখের মোট উৎপাদনের চার ভাগের তিন ভাগই হয় ‘অত্যন্ত খরা প্রবণ’ এলাকায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন