ঘটনাটা ১৯৬৬ সালের ২১ জানুয়ারির। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হতে তখনও তিন দিন বাকি। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট, এমএনএফের নেতা মি. লালডেঙ্গা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণকে একটা চিঠি লিখছিলেন।
মিজোদের ইতিহাস উল্লেখ করে ওই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “ব্রিটিশ শাসনের সময় আমরা প্রায় স্বাধীনতা পাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমাদের এখানে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে জাতীয়তাবাদী চিন্তা গড়ে উঠছিল। আমার মানুষদের একটাই ইচ্ছা আর প্রেরণা ছিল তখন, নিজেদের একটা দেশ হবে।“
একদিকে যখন লালডেঙ্গা চিঠিটার নীচে সই করছেন, তখন বাইরে দাঁড়ানো দুই যুবক ‘পিচফল’ আর ‘আনারস’ নিয়ে কথা বলছিল। তারা ওই ফল কতগুলো যোগাড় করতে পেরেছে, সেটাই আলোচনা করছিল ওই দুই যুবক। আশপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারা আন্দাজও করতে পারেন নি যে ‘পিচফল’ হল মর্টার আর ‘আনারস’ হল হ্যান্ড-গ্রেনেড।
সেই সময়ে মিজো বিদ্রোহীরা নানা অস্ত্র আর গোলাগুলির জন্য এধরণের সাঙ্কেতিক ভাষা ব্যবহার করত। পঙ্গপালের মতো একধরণের পোকা ‘ইউফাম’ শব্দটার অর্থ অন্য কেউ না বুঝলেও মিজো বিদ্রোহীরা জানতেন লাইট মেশিন গানের কথা বলা হচ্ছে। পাহাড়ি পাখি ‘টুকলো’র সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা হলে বুঝতে হবে টমি গানের ব্যাপারে কথা হচ্ছে।
'অপারেশন জেরিকো’ : কোষাগার, সেনাবাহিনীর অস্ত্র লুঠ
মি. লালডেঙ্গা প্রেসিডেন্ট সুকর্ণকে চিঠিটা লেখার একমাসের বেশি সময় পর এমএনএফের বিদ্রোহীরা শুরু করে ‘অপারেশন জেরিকো’। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে মিজোরাম থেকে সরিয়ে দেয়ার সেই অ্যাকশন শুরু হয় ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬। প্রথমেই আইজল আর লুঙ্গলাইয়ে আসাম রাইফেলসের শিবির দুটিকে নিশানা বানানো হয়। পরের দিন ভারত থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ঘোষণা করে দেয় এমএনএফ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আইজলের সরকারী কোষাগার লুঠ করে নেয় বিদ্রোহীরা। চম্ফাই আর লুঙ্গলাই জেলার সেনা ছাউনি দুটো তাদের কব্জায় চলে আসে।
‘মিজোরাম: দ্যা ড্যাগার ব্রিগেড’ বইতে সাংবাদিক নির্মল নিবেদন লিখছেন, “হামলাকারীদের একটা পল্টন সাবডিভিশন অফিসার আর তার কর্মীদের জিম্মি করে নেয়। আরেকটা দল তখন পিডব্লিউডি দপ্তরের সব জিনিষপত্র জিপে তুলে ফেলে। যোদ্ধাদের তৃতীয় একটা দল, আসাম রাইফেলসের ছাউনির দিকে লাগাতার গুলি চালাতে থাকে যাতে সেনা সদস্যরা বাইরে বেরতে না পারে। লুঙ্গলাইয়ের সরকারী কোষাগারে হামলা চালিয়ে দুটো লোহার ট্রাঙ্কে ভরে ফেলা হয়। পরে জানা গিয়েছিল ওই দুটো ট্রাঙ্কে ১৮ লক্ষ টাকা ছিল।“
সীমান্তবর্তী শহর চম্ফাইতে অবস্থানরত আসাম রাইফেলসের ছাউনিতে মাঝ রাতে হামলা হয়। এত দ্রুত সেই হামলা শুরু হয়েছিল যে সেনা সদস্যরা তাদের রাইফেলে গুলি ভরার বা আইজল বা লুঙ্গলাইতে খবর পর্যন্ত পাঠাতে পারে নি তারা। হামলাকারীরা সেখানে রাখা সব অস্ত্র লুঠ করে নেয়। ছয়টা লাইট মেশিন গান, ৭০টা রাইফেল, ১৬টা স্টেন গান আর গ্রেনেড লঞ্চার নিয়ে নেয়। একজন জুনিয়ার কমিশন্ড অফিসার সহ ৮৫ জন সেনাকে জিম্মি করে নেয় বিদ্রোহীরা।
ওই ছাউনি থেকে মাত্র দুজন সেনা সদস্য বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তারাই পরে ওই হামলার ঘটনা সবাইকে জানান। হামলাকারীদের একটা দল আইজলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়ে সব কানেকশান কেটে দেয়, যার ফলে পুরো দেশের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভোর সাড়ে তিনটের সময়ে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্যরা মি. লালডেঙ্গা আর তার ‘মন্ত্রীসভা’র ছয় জন সদস্যকে সদর দপ্তর থেকে উঠিয়ে নিয়ে পাঁচ মাইল দূরের দক্ষিণ হ্লিমেন এলাকায় পৌঁছিয়ে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে সেখানে সেনা সদস্যদের কাছে অস্ত্র আর গোলাবারুদ পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এমএনএফ বিদ্রোহীরা একনাগাড়ে গুলি বর্ষণ করতে থাকায় হেলিকপ্টারটা অবতরণই করতে পারে নি।
ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার তখন মাত্র একমাস হল দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন সরকার মিজোরামের ওই ঘটনায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু পাল্টা জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে নি তারা। ভারতীয় বিমানবাহিনীর চারটে ‘তুফানী’ আর ‘হান্টার’ বিমানকে আইজলের ওপরে বোমা বর্ষণ করার দায়িত্ব দেয়া হয় পাঁচ মার্চ, ১৯৬৬ সালে। বেলা সাড়ে এগারোটার সময়ে তেজপুর, কুম্বিগ্রাম আর জোরহাট থেকে বিমানগুলো রওনা দেয়। প্রথম দিন বিমান থেকে নীচের দিকে তাক করে শুধু মেশিনগান থেকে লাগাতার গুলি চালানো হয়।
পরের দিন আবার ফিরে আসে বিমানগুলো। দ্বিতীয় দিন শুরু হয় বোমা বর্ষণ। আইজল আর আশপাশের এলাকায় ১৩ই মার্চ পর্যন্ত লাগাতার বোমা বর্ষণ করা হয়। আতঙ্কিত মানুষজন শহর থেকে পালিয়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিতে থাকে। বিদ্রোহীদের কয়েকটা দল পালিয়ে যায় মিয়ানমার আর পূর্ব পাকিস্তানের জঙ্গলে। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের এক সদস্য থঙসাঙ্গা সেই সময়ের স্মৃতি হাতড়িয়ে বলছিলেন, “আমাদের ছোট শহরটার ওপর দিয়ে হঠাৎই চারটে বিমান ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে সমানে গুলি বর্ষণ করা হচ্ছিল। বেশ কিছু বাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল, কয়েকটা বাড়ি ভেঙ্গেও পড়ে। ধুলোয় চারদিক ভরে গিয়েছিল। মানুষজন সব এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল।“
কেউ কল্পনাও করে নি যে কেন্দ্র সরকার নিজের দেশের ওপরেই বোমা বর্ষণ করবে। গ্রাম পরিষদের এক সদস্য রামরুয়ানা বলছিলেন, “আমাদের দেখে অবাক লাগছিল, যে সরকার চীনের সীমার ভেতরে বিমান পাঠানোর সাহস পায় না, তারা আইজলের ওপরে বোমা ফেলার জন্য যুদ্ধ বিমান পাঠিয়ে দেয়!”
বিধায়ক জিজি সওয়েল আর রেভারেন্ড কোলস রয়ের নেতৃত্বাধীন মানবাধিকার কর্মীদের একটা দলকে এক স্থানীয় মানুষ জানিয়েছিলেন, “সেদিন দুই ধরনের বিমান আইজলের আকাশে দেখা গিয়েছিল। ভাল বিমান আর খারাপ বিমান। ভাল বিমানগুলো একটু ধীরে উড়ছিল আর ওগুলো থেকে আগুনের গোলা ঝরছিল না। আর খারাপ বিমানগুলোর আওয়াজ আমাদের কানে পৌঁছানোর আগেই সেগুলা চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যেত। ওগুলো থেকেই আমাদের ওপরে আগুনের গোলা ছোঁড়া হচ্ছিল।“
মিজো ন্যাশনাল আর্মির এক সদস্য সি জামা একটা বই লিখেছেন, ‘আনটোল্ড স্টোরি’ নামে। সেখানে তিনি ওই স্থানীয় ব্যক্তির উক্তিটি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, “বোমাবর্ষণের সময়ে আমি আমার দাদার বাড়ির পাশে একটা গাছের নীচে লুকিয়ে পড়েছিলাম। দুই হাতে কান চেপে রেখেছিলাম। বোমাবর্ষণ শেষ হলে আমি বাড়ি গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। তারপরে আমি দৌড়ই জঙ্গলের দিকে। সেখানে মাকে দেখতে পাই। তার কোলে আমার ছোট বোন ছিল। তার পিঠ আর হাত থেকে রক্ত বেরচ্ছিল।“
আইজল ছাড়া আরও বেশ কিছু এলাকায় বোমা বর্ষণ করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী। লুঙ্গলাইয়ের দিকে এগোতে থাকা সেনাবাহিনীর দল সেখানেও বোমা বর্ষণের হুমকি দিয়েছিল, কারণ ওই শহরটা পুরোপুরি এমএনএফের দখলে চলে গিয়েছিল। চাঙ্গসোইলেওয়া তার বই ‘মিজোরাম ডিউরিং টোয়েন্টি ডার্ক ইয়ার্স’-এ লিখছেন, “খ্রিষ্টান চার্চের নেতৃত্ব এমএনএফকে শহর ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করেন, কারণ সাধারণ নির্দোষ মানুষ বিপদে পড়ে গিয়েছিল বোমা হামলার কারণে। বোমা হামলা বন্ধ হলে তবেই জানমাল রক্ষা পাবে। এমএনএফ ওই অনুরোধ মেনে নিয়েছিল।“
১৩ মার্চ যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পৌঁছল, তখন তাদের কোনও বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। শিলচর-আইজল-লুঙ্গলাই মহাসড়কের দুদিক থেক সিল করে দিয়ে ১০ মাইল এলাকা সংরক্ষিত অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করে সরকার। বিদ্রোহী আর সাধারণ মানুষদের যাতে চেনা যায়, সেই জন্য পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল সবাইকে। কেউ যদি পরিচয়পত্র দেখাতে না পারত, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ এসেছিল।
মার্চ মাসের আইজলে বোমা বর্ষণের ফলে শহরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও মাত্র ১৩ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সরকার আর বিমানবাহিনী ওই ঘটনা নিয়ে কোনও কথাই জানায় নি, আর প্রশ্ন করা হলে ঘটনার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। কয়েক দশক পরে এই ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসে যখন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বাইরের জগতে বিবরণ দেন। ওটাই ছিল প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র বিমান হামলা, যেখানে ভারতের ভেতরই ভারতীয়দের ওপরে বোমাবর্ষণের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিল।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড সংবাদপত্রটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদন ছেপেছিল যে সেনা সদস্যদের রসদ পৌঁছে দেয়ার জন্য ওই যুদ্ধ বিমানগুলি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই প্রশ্নও উঠেছিল যে রসদ পৌঁছে দেয়ার জন্য তো সাপ্লাই বা ট্র্যান্সপোর্ট বিমান আছে, যুদ্ধ বিমান পাঠানোর কী প্রয়োজন হয়েছিল!
সেই সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলে লড়াই করার ক্ষমতা সীমিত ছিল। তাই ওই অপারেশনের জন্য পুরোনো হয়ে যাওয়া তুফানী আর হান্টার বিমানগুলিকে কাজে লাগাতে হয়েছিল। বিমানগুলি যারা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন – রাজেশ পাইলট আর সুরেশ কালমাডি। ওই বিমান হামলার ফলে মিজো বিদ্রোহীদের হাতে একটা বড় প্রচারের অস্ত্র তুলে দিয়েছিল সরকার। তারাও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল।
ওই বোমা বর্ষণের ফলে সেই সময়ের মতো মিজো বিদ্রোহীদের দমন করা গেলেও পরবর্তী প্রায় দুই দশক মিজোরাম অশান্তই থেকে গিয়েছিল। মিজোরামকে নতুন রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮৬ সালে। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট শান্তি চুক্তিতে সই করে। এমএনএফের প্রধান লালডেঙ্গা রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। আইজলের যে জায়গায় ২০ বছর আগে তিনি এমএনএফের পতাকা তুলেছিলেন, সেই একই জায়গায় ভারতের জাতীয় পতাকা তোলেন লালডেঙ্গা। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন