ইহ ও পরকালীন মুক্তির জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসুলগণের আগমন ঘটেছিল। নবী মোহাম্মদ (সা:) আসার মধ্য দিয়ে নবী-রাসুল আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরে আর কোন নবী বা রাসুল আসবেন না। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন প্রচারে ও পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে নবীদের উত্তারাধিকার আওলিয়ায়ে কেরামগণ যুগে যুগে আগমন করবেন। ইয়েমেনের অধিবাসী হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামনী (রাহ.) ইসলাম প্রচারে আসেন সিলেট। তাঁর পবিত্র পদধুলি পেয়ে সিলেট হয়ে যায় আধ্যাত্মিক রাজধানী। সিলেটের জমিনে হযরত শাহজালাল (রাহ.) এর সার্থক উত্তর পুরুষ ছিলেন জামানার মুজাদ্দিদ শামছুল উলামা আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রাহ.)।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) ১৯১৩ সালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বাদেদেওরাইল পরগণার ঐতিহ্যবাহী ফুলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফতি মাওলানা আব্দুল মজিদ (রাহ.)’র সুযোগ্য সন্তান আল্লামা ফুলতলী (রাহ.) ছিলেন একজন ইনসানে কামিল। তিনি যেমনি ইসলামের একজন সফল খাদেম ছিলেন তেমনি সমাজ সংস্কারক ও মানবতাবাদী ছিলেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিশারী ছিলেন।
আল্লামা ফুলতলী (রাহ.) হযরত শাহজালাল (রাহ.)’র সফরসঙ্গী ৩৬০ আওলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ কামাল (রাহ.)’র বংশধর। আমলে সালিহের মাধ্যমে তাযকিয়ায়ে নাফসের মেহনতে উচ্চাসনে আসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি।
তার কর্মজীবন ছিল বহুমাত্রিক ও সৃজনশীল। সমকালীন সমাজ ও জাতীয় জীবনে তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যতিক্রধর্মী বহুমাত্রিক প্রতিভা যিনি ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, সমাজচিন্তা. রাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা, জীবন, ঐতিহ্য, বিজ্ঞাান, শিক্ষা ও ইসলামী জ্ঞান সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন এক পরিপূর্ণ মহীরূহ ও অনুপম জীবনাদর্শের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন মেধাবী। তিনি ফুলতলী মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষার্জন করেন। এরপর হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসা থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ১৩৩৮ বাংলায় ভারতের বদরপুর মাদরাসায় উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান রামপুর আলিয়া মাদরাসায় বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্জন করে মাতলাউল উলুম মাদরসায় ভর্তি হয়ে যুগের শ্রেষ্ট স্বনামধন্য মুহাদ্দিসগণের কাছ থেকে ইলমে হাদিস, ইলমে তাফসীর, ইলমে আকাইদ ও ফিকহ বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে মাদরাসা শিক্ষার চুড়ান্ত সনদ লাভ করেন।
তাঁর আপাদমস্তক ছিল রাসূল (সাঃ) এর আদর্শে উদ্ভাসিত। নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত এবং মজলুম মানুষের পক্ষে তিনি ছিলেন সু-উচ্চ কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন জালিম ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর শত্রæদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। বিশেষ করে তাগুতের বিরুদ্ধে তাঁর সময়োপযোগী এবং সাহসী কন্ঠ ছিল ধারালো তরবারির চেয়েও শানিত।
তার অন্যতম খেদমত হলো ইলমে কিরাত। যুগে যুগে উলামায়ে কেরামগণ ইলমে হাদিস, তাফসীর ও ফিকহের প্রতি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেভাবে ইলমে কিরাতের প্রতি এগিয়ে আসেননি। এক্ষেত্রে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি যুগশ্রেষ্ঠ কারীদের কাছ থেকে ইলমে কিরাত শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর ইলমে কিরাতের উস্তাদ হচ্ছেন, মক্কা শরীফের রইছুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরীন হযরত আহমদ হিজায়ি (রাহ.) ও আব্দুর রউফ করমপুরী (রাহ.)। ইলমে কিরাতের চুড়ান্ত সনদ অর্জন করে তিনি এ খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। তিনি এ ট্রাষ্টে তার সম্পত্তির বিশাল একটি অংশ (৩৩ একর) দান করেন। এ ট্রাষ্টের মাধ্যমে দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ইলমে কিরাতের শিক্ষা।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সৈয়দপুরে বাতিলপন্থীদের হাতে রক্তেরঞ্জিত হন তিনি। এরপরও তারা ফুলতলী (রাহঃ) কে রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শ হতে একবিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর রেখে যাওয়া কোনো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার দুঃসাহস, নোংরা রাজনীতি অথবা সুযোগ নিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার অপচেষ্টা অবশ্যই সফল হবে না।
তরিকতের দিক থেকে তিনি উচ্চ মার্গের একজন আধ্যাতত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৮বছর বয়সে ১৩৩৯বাংলা সনে হযরত শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রাহ.)’র কাছ থেকে তরিকার দীক্ষা লাভ করেন। ফুলতলী ছাহেবের অন্যতম গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে তিনি অল্প বয়সে তরিকার সনদ লাভ করেন। শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রাহ.)’র কাছ থেকে চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া এবং মুহাম্মদিয়া তরিকা লাভ করেন। তরিকার প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন (রাহ.)’র কাছ থেকে চিশতিয়া ও নিজামিয়া তরিকাও লাভ করেন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) ১৯৪৬ সালে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সুচনা করেন। সেখানে ১৯৫০সাল পর্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ি জামিউল উলুম আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করে ছয় বছর খেদমত করেন। এরপর সৎপুর কামিল মাদরাসা ও ইছামতি কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে পাঠদান করেন। ইন্তেকালপূর্ব পর্যন্ত ফুলতলী কামিল মাদরাসায় হাদিস শরীফের দরস দেন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) দীনী খেদমতের পাশাপাশি সমাজসেবায় তাঁর অবদান অতুলনীয়। তিনি সারা জীবন সৃষ্টির খেদমত করে গেছেন। এতিমদের লালন-পালনের জন্য করে গেছেন এতিমখানা। বর্তমানে তাঁর এতিমখানায় সহ¯্রাধিক এতিম রয়েছে। তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় লঙ্গরখানা বিধবা আতুর পুনর্বাসন কেন্দ্র ও গৃহ নির্মাণ, টিউবওয়েল স্থাপন ও বৃক্ষরোপনসহ নানা প্রকল্প স্থাপন করেছেন। যা আজও মানব সেবায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
তাঁর রেখে যাওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, ১৯৫০ সালে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট, ১৯৭২ সালে লতিফিয়া এতিমখানা, ১৯২০ সালে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা, ১৯৮৩ সালে হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা, ২০০২ সালে লতিফিয়া কমপ্লে´, ১৯৯৪ সালে শিক্ষকদের অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে মাদারিছে আরাবিয়া, ব্যক্তি জবিনে এবং রাষ্ট্রে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠান করেন গণ মানুষের সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ, কারী ছাহেবদের জন্য গঠন করেন লতিফিয়া কারী সোসাইটি, যার প্রতিটি উপজেলায় শাখা রয়েছে। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) ১৯৮০ সালে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে তারামীযে ইসরামিয়া প্রতিষ্ঠান করেন। ২০০৬ সালে হাফিজি মাদাসার জন্য ‘ইয়াকুবিয়া হিফজুর কুরআন বোর্ড’ গঠন।আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম হ্যান্ডস’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া লন্ডন, আমেরিকা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
পাবিারিক জীবনে তিনি ১৩৪৫ বাংলায় তাঁর পীর ও মুর্শিদ হযরত মাওলানা আবু ইউসুফ শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রাহ.)’র তৃতীয় কন্যা মুহতারামা খাদিজা-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক সময় ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন হওয়ায় তার মধ্যে সংসার বিরাগ সৃষ্টি হয়। আল্লামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) তখন তাঁর শুশর ও পীর বদরপুরী (রাহ.)’ নির্দেশে ফুলতলী গ্রামের মরহুম আব্দুর রশিদ খানের কন্যা মুহতারামা নেহারুন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফুলতলী ছাহেবেরে সাত সাহেবজাদা ও তিনজন ছাহেবজাদী।
অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে তিনি সাহিত্য সাধনায়ও নিজিকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি তাফসীর, কিরাত, সীরাত, তাসাউফ ও কাব্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তাঁর আটটি কিতাবের নাম পাওয়া যায়। এ কিতাবগুলো বহুল প্রচারিত ও পাঠক সমাদৃত।
তার রয়েছে অসংখ্য কারামত। যেহেতু ওলিদের কারামত সত্য। তাঁর অনেক কারামত গোপন রয়ে গেছে। অনেকটাই প্রকাশ পেয়েছে। এ যাবত শতাধিক কারামত নিয়ে কয়েকটি গ্রন্থও ছাপা হয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত ২টায় সিলেট শহরের সুবহানীঘাটস্থ তাঁর বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাইজউন। ১৫ জানুয়ারি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.) ইন্তেকাল বার্ষিকীকে কেন্দ্র প্রতি বছর ঈসালে সাওয়াব মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। দেশ বিদেশের উলামায়ে কেরাম পীর মাশায়েখ ও চিন্তাবিদগণ মাহফিলে বয়ান পেশ করেন। এতে ভক্ত মুরিদানসহ লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হন। লেখক: সহ সাধারণ সম্পাদক, ওসমানীনগর উপজেলা প্রেসক্লাব, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন