রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে রহস্যজনক চুরির ঘটনায় ভ‚মিদস্যু চক্রকে সন্দেহ করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। একই সাথে রেজিষ্ট্রেশন কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরীণ চক্রও জড়িত বলে অনুমান। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে বাড্ডা অঞ্চলের সাব-রেজিস্ট্রার মনির হোসেন বাদি হয়ে মামলা দায়ের করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মামলায় কী কী চুরি হয়েছে- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি বাড্ডা অঞ্চলের সাব-রেজিস্ট্রার। নিরাপত্তাকর্মী বেষ্টিত এমন একটি সুরক্ষিত কমপ্লেক্সে দুর্বৃত্তরা রেজিস্ট্রার অফিসের মূল্যবান জমির কাগজপত্র ও বালাম বই চুরি করেছে। তাদের যাতে চিহ্নিত না করা যায় তার জন্য কম্পিউটারের হার্ডডিক্স চুরির পাশাপাশি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজও নিয়ে গেছে। চুরি যাওয়া কম্পিউটারের হার্ডডিক্সগুলোতে উত্তরা, বাড্ডা ও পূর্বাচলের জমির খতিয়ান ও রেজিস্ট্রির তালিকা রয়েছে। ২০১৬ ও ২০১৮ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগে জানা যায়, ওই চুরির বিষয়টিকে শক্তভাবে আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে ফের চুরির ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের ধারণা, এবারের চুরির ঘটনা পুরোপুরি পরিকল্পিত। এতে অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী, কর্মচারী ও কর্মকর্তারাও সন্দেহে রয়েছেন। বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে তদন্তকারীরা। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবিসহ অন্যান্য সংস্থাও এটার তদন্ত শুরু করেছে।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবেকুন নাহার বলেন, ‘কম্পিউটারের হার্ডডিক্স নিয়েছে। খোয়া যাওয়া বা তছনছ হওয়া রেকর্ডপত্র বা কাগজপত্র মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।’ বালাম বই চুরি হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা বলা যাবে না। শুক্রবার ও শনিবার অফিস খোলা আছে। সব কিছু মিলিয়ে দেখে বলা যাবে যে এটা চুরি হয়েছে কি না।’ রাজধানীর রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সটি কেপিআই (রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ করা আছে। এরপরও এসব ঘটনা ঘটছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। এখানে জনগণের আমানত রয়েছে। এটার নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন আমরা তাই করব।’
সূত্র জানায়, বালাম বই চুরি হলে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে প্রকৃত জমির মালিকগণ। কারণ বালাম বই থাকে এক কপি। জমির দলিলের বর্ণনা বালাম বইয়ে উল্লেখ থাকে। চোর চক্র বালাম বইয়ে ২০০৬ সালের পর থেকে উল্লেখিত তথ্যগুলোর পৃষ্ঠা চুরি করতে পারে। এর আগে ২০১৬ সালে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের বালাম বই চুরি করে। পরে পুলিশ চোর চক্রের ৫ সদস্যের কাছ থেকে বালাম বইটি উদ্ধার করে। এই চুরির সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের কয়েকজন এমএলএস ও দালালচক্র জড়িত ছিল।
গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার ভোরের যে কোনো সময়ে এই চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে বাদী হয়ে বাড্ডা রেজিস্ট্রার অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেছেন।
মামলার এজাহারে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, কমপ্লেক্সের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার গ্রীল ভেঙে দুর্বৃত্তরা অফিসের মূল্যবান শত শত দলিল, বালাম বই, কম্পিউটারের হার্ডডিক্স ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চুরি করে নিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আলী হোসেন খান জানান, ‘বৃহস্পতিবার রাতে মামলা হয়েছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার বা নথিপত্র উদ্ধার করা যায়নি।’
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি আরো জানান, চোরের দল রেজিস্ট্রেশন কার্যালয়ের পেছনে দলিল লেখকদের টিনের চাল বেয়ে কমপ্লেক্স ভবনের দোতলার কলাপসিবল গেটের গ্রিল কেটে ঢুকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবনের দোতলায় বাড্ডা ও তৃতীয় তলায় উত্তরা থানার সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের ফটকের তালা ভাঙা পাওয়া যায়। এই কক্ষ দুটিতে দুটি স্টিলের আলমারি ও ড্রয়ার ভাঙা ছিল। তৃতীয় তলায় জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের ফটকের তালাও ভাঙা পাওয়া গেছে। সেখানে সংরক্ষিত সিসি ক্যামেরা ডিভিআর খোয়া গেছে। তাই সিসি ক্যামেরায় কোনো ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনাস্থল থেকে হাত ও পায়ের ছাপের আলামত সংগ্রহ করেছে। কমপ্লেক্স ভবনে কর্তব্যরত তিন নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
এদিকে, চুরির ঘটনার পর শুক্রবার সারাদিন রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের অফিস খোলা ছিল। কী কী চুরি হয়েছে তা কর্মকর্তারা তদন্ত করেন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ভবনটি নিরাপত্তা প্রহরীদের গাফিলতি রয়েছে। ভবনে যখন তখন যে কেউ ঢুকতে পারেন। এবার যেভাবে চুরি হয়েছে তাতে মনে হয়েছে যে, দুর্বৃত্তরা একাধিবার কমপ্লেক্সে এসে রেকি করে গেছে। এই চুরির সঙ্গে ভ‚মি ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। উত্তরা ও বাড্ডা এলাকার ২০০৬ সালের পর সম্পন্ন হওয়া দলিলগুলো টার্গেট ছিল ওই চোর চক্রের। দলিলের তথ্য গায়েব করতে তারা টার্গেট করে বালাম বই।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, উত্তরা ও বাড্ডা, পূর্বাচল একটি ভ‚মিখেকো গোষ্ঠী নিরীহ লোকজনের ভ‚মি দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু, ওইসব জমির বৈধ নথি থাকার কারণে তারা দখল করতে পারেনি। ওই চক্রটি ভাড়া করা চোরদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে কমপ্লেক্সে চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করছে। তাদের গ্রেফতার করা গেলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে এলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না বলে অভিমত অভিজ্ঞ মহলের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন