সড়কে যাতায়াতে ফিরেছে স্বস্তি। ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের মেঘনা, গোমতী, কাঁচপুর প্রথম ও দ্বিতীয় সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অর্থনীতিতেও উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার।
দীর্ঘদিনের যানজট নিরসন হয়েছে। ফলে স্বস্তিতে যানবাহনের চালক, মালিক এবং যাত্রীরা। এতে সড়ক পথে মাত্র ৪ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে গাড়ি। সেতু এলাকা পার হতে আগে যেখানে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগতো এখন ৫ থেকে ৬ মিনিটেই সে পথ পাড়ি দেয়া যায়। গত বুধবার ঢাকা থেকে মাত্র চার ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও দেড় ঘণ্টায় কুমিল্লায় গেছেন যাত্রীরা।
মহাসড়কে চলাচলকারী একটি পরিবহনের চালক জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আগে কাঁচপুর থেকে মদনপুর এবং মোগড়াপাড়া থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকতে হতো। কিন্তু প্রথম, দ্বিতীয় মেঘনা, গোমতী ও কাঁচপুর সেতু খুলে দেয়ায় মাত্র ৮ মিনিটে সেতু পার হয়ে গৌরীপুরে আসতে পেরেছি।
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে নয়াদিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। মেঘনা, গোমতী ও কাঁচপুরের পুরাতন তিনটি সেতু সংস্কার কাজ শেষে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মোক্ত করে দেয়া হয়। পাশাপাশি আরো তিনটি নতুন সেতু নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
উদ্যোক্তারা মহাসড়কের পাশে নতুন করে শিল্প কারখানা স্থাপনে এরই মাঝে কাজ শুরু করে দিচ্ছেন। সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বিপ্লবের। ফলে অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়ছে কর্মসংস্থানও।
কুমিল্লার মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকার পেট্রোবাংলায় কর্মরত থাকার কারণে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি দৈনিক ইনকলিাবকে বলেন, মহাসড়কের পুরাতন ও নতুন ছয়টি সেতু চালু হওয়ার ফলে আর যানজট নেই। গত ডিসেম্বর মাস থেকে ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়েছি। কুমিল্লা থেকেই নিয়মিত অফিস করতে পারছি। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতে সময় লাগছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা।
মহাসড়কে যানজট না থাকায় রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত যেমন কমছে তেমনি মেঘনা-গোমতীর কুমিল্লা অংশ থেকে ফেনী পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে নতুন অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল তৈরিরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠা বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে উৎপাদিত পণ্য কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, লরি করে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে এই মহাসড়ক ব্যবহৃত হয়। একইভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য এই মহাসড়ক হয়েই ঢাকা, গাজীপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, রাজশাহী অর্থাৎ পুরো দেশেই পৌঁছে যাচ্ছে। এছাড়াও কুমিল্লা অঞ্চলেও নতুন করে শিল্প প্রসারের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
কুমিল্লা চেম্বার অফ কর্মাসের সভাপতি মাসুদ পারভেজ ইমরান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রথম ও দ্বিতীয় ছয় সেতু নির্মাণ ও সংস্কার সাথে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে শিল্প বিপ্লব ঘটতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের গতি আসছে, আয় বৈষম্যও দূর হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিভিন্ন শিল্প থেকে রফতানির মাধ্যমে আয় আরও বাড়বে। পাশাপাশি কমে যাবে পণ্য পরিবহণের খরচও।
এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মোসতাকিম আশরাফ টিটু বলেন, তিন সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আর যানজট থাকবে না। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ১৪ জেলায় শিল্প বিপ্লব ঘটবে। এ অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে, ইপিজেড আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল।
এ বিষয়ে কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ওমেন চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমাদ মেরী সিআইপি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সেতুগুলো চালুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে নানারকম শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। মিরসরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনমিক জোন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’। এ শিল্পনগরের কাজ শেষ হলে কর্মসংস্থান হবে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের। এ অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলসহ দেশের চেহারাই পাল্টে যাবে।
আরমান হক ডেনিম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এন আর তৌফিক জানান, ডিসেম্বরে কারখানায় উৎপাদন কাজ শুরু করেছি। এ কারখানায় বছরে ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন মিটার ডেনিম কাপড় তৈরি হবে। ইউরোপীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিম কাপড়ের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এ কারখানাটি নির্মাণ করা হয়েছে।
শফিউল আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিউল আলম ছোটন বলেন, এ মহাসড়ক হয়ে কোম্পানির বিভিন্ন পণ্য ঢাকাসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় প্রতিদিনই পাঠাতে হয়। দ্বিতীয় চারলেনের তিনটি সেতু চালু হত্তয়ার পর থেকে নির্বিঘেœ পণ্য পাঠাতে পারবেন বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
কুমিল্লায় রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড)। এই ইপিজেডে আছে বিদেশি ৪৬টি, ও দেশি ১০টি শিল্প কারাখানা। মেঘনা-গোমতী ও মেঘনার দু’তীর ঘিরেও রয়েছে বেশ কিছু বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামে বিসিক শিল্পনগরী, কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামে বেশ কিছু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। নতুন করে ফোরলেনের ব্রিজ চালু হওয়ায় মহাসড়কের যানজটের অবসান হয়েছে। মহাসড়কের ফোরলেনের দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু উদ্বোধনের পর অপার সম্ভাবনা দেখছে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী।
এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অনেক যানবাহন মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে প্রায়ই ডাকাতের কবলে পড়ে। হাইওয়ে পুলিশের টহল থাকার পরও ডাকাতদের কবলে যানবাহন পড়ায় যাত্রীরা হতবাক। পুলিশ বলছে, দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে ডাকাতরা মহাসড়কের সাথে যুক্ত আঞ্চলিক সড়ক ব্যবহার করে। আগামীতে যাতে সেটি না হয় সে লক্ষ্যে আঞ্চলিক সড়ক থেকে মহাসড়ক প্রবেশ করার মুখে টহল জোরদার করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন