শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খাদ্যমন্ত্রী এ কি বললেন!

| প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে কেউ মারা গেলে দায় সরকার নেবে না।’ যখন প্রায় প্রতিদিন সীমান্তে বিএসএফ’র গুলীতে বাংলাদেশী নিহত হচ্ছে, তখন খাদ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্য অত্যন্ত দু:খজনক। সীমান্তে হত্যা, অপহরণ ও নাশকতার ঘটনায় তিনি ন্যনতম দু:খিত ও বিচলিত না হয়ে উল্টো বাংলাদেশীদেরই দায়ী করেছেন। এও বলেছেন, ‘সীমান্তে গরু পাচারের জন্য কোনো বিট খাটালের অনুমোদন সরকার দেয়নি। গরু আনতে অবৈধভাবে কেউ সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে বিএসএফ’র গুলীতে মারা গেলে তার দায়ও সরকার নেবে না।’ কদিন আগে সীমান্তে একই দিনে ৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয়। তার আগের দিন নিহত হয় দু’জন। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে ৯ মাসে সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে ২৮ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে, ১৭ জন অপহৃত হয়েছে। নতুন বছরের প্রথম মাসে সীমান্তে হত্যাকান্ড বেড়েছে। সীমান্তবাসীই নয়, এতে গোটা দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। এই পটভূমিতে খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তুল্য। সীমান্ত হত্যা নিয়ে দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমান্তে নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে অংশ নিয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বৃদ্ধিজীবীরা। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঢেউ উঠেছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কি বাংলাদেশী, না ভারতীয়? তিনি কি বাংলাদেশের মন্ত্রী, না বিএসএফ’র মুখপাত্র? কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন। সীমান্তে হত্যার জন্য ভারতকে ঢালাওভাবে দোষারোপ না করে নিজেদের দায়িত্বশীল হওয়ার নসিহত করেছিলেন তিনি। সীমান্ত হত্যা কমেছে দাবি করে বলেছিলেন, যারা মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই অবৈধভাবে ভারতে যায়। তারা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যও তখন তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। সম্প্রতি সেই তিনিই জানিয়েছেন, ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারত রক্ষা করেনি। দিল্লীকে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে।’

ইতোপূর্বে ‘স্মরণ করিয়ে দেয়া’ নয়, রীতিমত অভিযোগ ও প্রতিবাদ আকারে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, এমন কি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অধিকারিকের কাছেও তুলে ধরা হয়েছে। সকল আলোচনায় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সীমান্তহত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনা হবে। বাস্তবে ভারত কখনই এই প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিকতার পরিচয় দেয়নি। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সীমান্তে হত্যাকান্ড শূণ্যের কোটায়। অথচ গত ১০ বছর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র হাতে ৪৫৫ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৬৫৭জন এবং অপহৃত হয়েছে ৫১৮ জন। দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত সম্পর্কিত আলোচনায় সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার বিষয়ে কথা উঠালেই ভারতের পক্ষ থেকে একই কথা বলা হয়। বলা হয়, অনুপ্রবেশকারী ও চোরাচালানী ছাড়া কাউকে গুলী বা হত্যা করা হয় না। আমরা জানি, অনুপ্রবেশ বা চোরাচালান একতরফা কোনো কিছু নয়। উভয় দেশের মানুষই অনুপ্রবেশ করে এবং পুনরায় স্বদেশে ফিরে যায়। আবার দু’ দেশেরই সীমান্তবর্তী কিছু লোক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এই বাস্তবতা অস্বাভাবকি নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিজিবি’র হাতে কোনো ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বা চোরাচালনী নিহত হয়েছে বলে জানা যায় না। বিজিবি ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও চোরাচালানীদের গুলী করে হত্যা করার বদলে আটক করে এবং আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বা চোরাচালানীর ক্ষেত্রেও বিএসএফ’র এমন আচরনই করার কথা, যদিও সে তা করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশীদের গুলী করে হত্যা করে বিএসএফ। অনেক সময় বাংলাদেশের সীমানায় অনুপ্রবেশ করে হত্যাকান্ড ঘটায় কিংবা অপহরণ ও লুটপাট করে। এসব ঘটনার সঙ্গে অনুপ্রবেশ বা চোরাচালানের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএসএফ ইচ্ছে করেই হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ করে, অপহরণ করে ও লুটপাট করে। আর প্রতিবাদ ও অভিযোগ করলে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। আমাদের মন্ত্রীরা ভারতের নাগরিক নন, মন্ত্রীও নন। তারা ভারতের ভাষায় কথা বলেন কেন?

খাদ্যমন্ত্রীর কথা মতো সীমান্ত হত্যার দায় যদি সরকার না নেয়, তাহলে কে নেবে? সীমান্তে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব তো সরকারেরই, নাকি? অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রোধ এবং বিএসএফ’র যে কোনো অপকর্ম ও অপরাধ প্রতিহত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের পক্ষে বিজিবি’র সেটা করার কথা। মন্ত্রীর মতে, বিট খাটালের অনুমোদন সরকার দেয়নি। তিনিই জানিয়েছেন, একটি সুবিধাবাদী চক্র অবৈধ খাটাল তৈরি করেছে। এই সুবিধাবাদী চক্র কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? অবৈধ খাটালের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেয়নি বা নিচ্ছে না কেন? বলার অপেক্ষা রাখেনা, বাংলাদেশের মন্ত্রী কিংবা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি ভারতের পক্ষে দাঁড়িয়ে ভারতের সুরেই কথা বলেন, তাহলে তাদের মন্ত্রীত্ব বা দায়িত্ব থাকা উচিৎ নয়। স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব বা দায়িত্ব থেকে তাদের সরে যাওয়া উচিৎ অথবা তাদের সরিয়ে দেয়া উচিৎ। হত্যা, অপহরণ ও লুণ্ঠনের দায় থেকে এভাবে বিএসএফ’কে মুক্ত করে দেয়া হলে সীমান্তে হত্যা-নাশকতা কি বন্ধ হবে? অবশ্যই হবে না। বরং বাড়বে। বর্তমান সীমান্ত পরিস্থিতিই তার প্রমাণ। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, সীমান্ত হত্যা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। সীমান্তকে অভয় ও নিরাপদ করতে হবে। সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এব্যাপারে সরকারের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন