শানু মোস্তাফিজ : রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার সুমনা রহমান (২৭) নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিছুদিন থেকে তার হাত-পা ফুলে যাচ্ছে। রক্তচাপও বেড়েছে। মাঝে মাঝে শরীরে খিঁচুনি হয়। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে তাই এসেছেন মিঠাপুকুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সুমনা বললেন, “কিছু দিন থেকে একদম কাজকর্ম করতে পারছি না। মাঝখানে একদিন হঠাৎ খিঁচুনি দেখা দিলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।” সুমনা জানান, সংবাদপত্রে স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা পড়ে গর্ভবতী মেয়েদের সমস্যা সম্পর্কে তিনি জেনেছেন। তাছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় ডাক্তারও তাকে খিঁচুনি বা একলামশিয়ার কিছু লক্ষণ বলে দিয়েছেন। তাই এখন শরীরে কোন সমস্যা দেখা দিলে তিনি হাসপাতালে ছুটে আসেন।
সুমনা তার গর্ভের সন্তান ও নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বেশ সচেতন; কিন্তু আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। ঢাকায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালের ডা. নাহিদ নাসরিন বললেন, “একটু স্বাস্থ্য সচেতনতা মানুষকে অনেক বড় বিপদ থেকে রেহাই দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার বিষয়গুলো সবার জানা প্রয়োজন।”
আফরোজা বানু (৩২) থাকেন রংপুরের পীরগঞ্জে। তার দেড় বছরের শিশুর প্রচ- ঠা-া লেগেছে। শ্বাসকষ্টও রয়েছে। নিঃশ্বাসের সময় বুকে শব্দ হয়। প্রথমে তিনি গ্রামের হাতুরে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করান। পরে হাসপাতালে আনলে ডাক্তার তাকে জানান, শিশুটির নিউমোনিয়া হয়েছে। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। আফরোজা বললেন, “প্রথমদিকে অবহেলা করেছি। বাচ্চাকে কোন ওষুধ দেইনি। তাই অসুখটা জটিল হয়েছে। তবে ডাক্তার বলেছেন, ভয়ের কিছু নেই।” আফরোজার বাড়ি থেকে হাসপাতাল খুব দূরে নয়। শুধু অবহেলা করে তিনি তার অসুস্থ সন্তানকে হাসপাতালে নেননি। তাছাড়া নিউমোনিয়া সম্পর্কেও তার কোন ধারণা নেই।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডা. মুজিবুর রহমান বললেন, “এরকম অনেক পরিবার রয়েছে যাদের সাধারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। ফলে সবধরনের রোগকে তারা জটিল বানিয়ে ফেলেন।” তার মতে, মায়েদের স্বাস্থ্য সচেতনতা অনেক বেশি জরুরি। কারণ শিশুর পরিচর্যা, সঠিক পুষ্টি, সময়মতো টিকা দেয়া ইত্যাদি কাজ এখনও আমাদের দেশে মায়েদের দেখতে হয়। মায়েরা স্বাস্থ্য সচেতন না হলে সন্তান নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আবার কোন বয়সের শিশুকে কি ধরনের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবেÑ তাও মায়েদের জানা প্রয়োজন। ডা. মুজিবুর রহমান বলেন, “একজন নারী তার পুরো পরিবার দেখাশুনা করেন। পানিবাহিত নানা রোগ যেমনÑ ডায়রিয়া, জন্ডিস আমাদের জীবন বিপর্যস্ত করে। কাজেই বিশুদ্ধ পানি পাান ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মায়েদের সজাগ থাকা উচিত। তবে শুধু পরিবার বা সন্তান নয়; নিজের বিষয়েও সব নারীকে সচেতন থাকতে হয়।”
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০০৫ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৫০ শতাংশ মহিলা প্রজননতন্ত্রের রোগে ভোগেন। এর অন্যতম কারণ হলোÑ অযতœ, অজ্ঞতা, অপরিচ্ছন্নতা ও দারিদ্র্য। তাছাড়া বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ মহিলা অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগেন। গর্ভবতী মায়েদের ৭৪ শতাংশের রক্তশূন্যতা, ৪৭ শতাংশের আয়োডিন ঘাটতি এবং ৬০ শতাংশের ভিটামিন-এ ঘাটতি রয়েছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়, গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টির অভাবে কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বাংলাদেশে শতকরা ৯০ ভাগ শিশুই অপুষ্টির শিকার এবং এর মধ্যে মেয়ে শিশুর হার বেশি। পুষ্টি সমস্যার কারণে এদেশের মানুষ দিন দিন খর্বাকৃতি হয়ে যাচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বললেন, “আমাদের দেশের নারীরা নিজের বিষয়ে মোটেও সচেতন নন। ক্যালসিয়াম ঘাটতি, হরমোন সমস্যাসহ নানা রোগ মেয়েদের হয়ে থাকে। প্রায় প্রত্যেক নারীরই রয়েছে এ ধরনের সমস্যা। কিন্তু তারা এর কোন চিকিৎসা করান না।” তিনি বললেন, “অপরিষ্কার থাকার কারণে মহিলাদের জরায়ুতে ক্ষতের (ইনফেকশন) সৃষ্টি হয়। পানি কম খেলেও প্র¯্রাবের রাস্তায় (্ইউরেটায়) সমস্যা দেখা দেয়। ময়লা কাপড় ব্যবহারের কারণে হাত-পায়ে চুলকানি হয়; যা শিশুকেও আক্রান্ত করতে পারে। অথচ এসব ব্যাপারে আমাদের দেশের মহিলারা যথেষ্ট সচেতন নন। তিনি জানান, সন্তানকে ঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো শুধু শিশুর জন্য নয়; মায়েদের জন্যও মঙ্গলজনক। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।”
ডা. ফারহানা দেওয়ানের মতে, প্রত্যেক মেয়েরই বিয়ের পর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি ঠিক করা উচিত। নইলে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। সময়মতো খাওয়া, সঠিক পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা এবং কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে অনেক রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার বললেন, “আমাদের দেশের মানুষের পুষ্টি বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। আর নারীরা সাধারণত স্বামী-সন্তানকে খাওয়ানোর পরে নিজের খাওয়ার কথা ভাবেন। গর্ভবতী মায়েদের স্বাভাবিকের চেয়ে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণত তা হয় না। এক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের বিশেষ করে স্বামীকে যতœশীল হতে হয়।” পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমের আরো বেশি সহায়তা নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার ও ডা. মুজিবুর রহমান দু’জনই মনে করেন, কেবল স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন মায়েদের পক্ষেই সুস্থ শিশু জন্ম দেয়া সম্ভব। স্বাবলম্বী বা প্রতিষ্ঠিত হতে হলে নারীকে সুস্থ থাকতে হয়। তাই প্রত্যেক নারীকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন