কয়েক শতক যাবত মুসলমানরা চরম নির্যাতনের শিকার এবং তা কম-বেশি বিশ্বব্যাপীই। সর্বোপরি বর্তমানে সর্বাধিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে ফিলিস্তিন, ভারত ও মিয়ানমারের মুসলমানরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী ও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এ জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই মুসলিমদের রক্ষার্থে বিশ্বের নেতৃবৃন্দ তেমনভাবে জোরালো ভূমিকা পালন করেনি। বিছিন্নভাবে কিছু তৎপরতা হয়েছে, কিন্তু বিপক্ষের অপকর্ম প্রবলতর হওয়ায় তা ফলদায়ক হয়নি! এই অবস্থায় এই মুসলিম মজলুমদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তারা দেশে এবং বিশ্বের সর্বত্রই এই নিপীড়িত মুসলমানদের পক্ষে নির্ভয়ে বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে সচেতন করছেন। সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের মনে সাহস যোগাচ্ছেন, আশার আলো প্রজ্বলিত করছেন। এ কারণে তারা এবং তাদের দেশগুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। তবুও চলতি শতাব্দীর এই শ্রেষ্ঠ মুসলিম বীররা পিছপা হচ্ছেন না। নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলমানদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেই চলেছেন। অতি সা¤প্রতিক কিছু ঘটনাবলী এবং তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান পাকিস্তান সফরকালে দেশটির জাতীয় সংসদের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভাষণে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের পাশে থাকবে তুরস্ক। কয়েকশ’ বছর আগে তুরস্কের কানাকালেতে যে ধরনের হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল একই ঘটনা ঘটছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। এর বিরুদ্ধে তুরস্ক সবসময় প্রতিবাদ করে যাবে। আমরা কখনো কানাকালের সেই দুঃসময়ে উপমহাদেশের মুসলমানদের সমর্থনের কথা ভুলবো না। আজকে কাশ্মীর ইস্যুকে পাকিস্তানিরা যেভাবে দেখছেন আমরাও ঠিক একইভাবে দেখছি। আমরা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাব। কাশ্মীরে আমাদের ভাই-বোনেরা কয়েক দশক ধরে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। সা¤প্রতিক দিনগুলোতে একতরফা পদক্ষেপের কারণে সে দুর্ভোগ অনেক বেড়েছে। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হতে হবে সহিংসতা অথবা নির্যাতনের মাধ্যমে নয় বরং ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাম্প ঘোষিত কথিত ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি কোনো শান্তির পরিকল্পনা নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দখলদারিত্বের প্রকল্প। আমরা সারা বিশ্বের সামনে ঘোষণা দিতে চাই যে, পবিত্র মসজিদুল আকসাকে ইসরাইলি প্রশাসনের করুণার ওপর আমরা ছেড়ে দিতে পারি না।’ এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এককালীন ক্রিকেট কিংবদন্তি এবং বর্তমানের বিশিষ্ট রাজনীতিক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান যদি পাকিস্তান থেকে নির্বাচন করেন, তবে তিনি বড় ব্যবধানে জয়ী হবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি উন্নত চলচ্চিত্র শিল্প দরকার। ইসলামবিদ্বেষ মোকাবেলায় আমরা সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারণা বাড়াতে চেষ্টা করছি, যাতে চলচ্চিত্রে মুসলমানদের যেভাবে ভুলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তার মোকাবেলা করতে পারি।’ এর আগে দুই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারকে সই করে। এই দুই নেতার বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত।ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবিশ কুমার পাকিস্তানে তুর্কি প্রেসিডেন্টের মন্তব্য ও পাকিস্তান-তুরস্কের যৌথ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ‘জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অখন্ড ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা তুর্কি নেতৃত্বকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার এবং প্রকৃত সত্য নিয়ে বোঝাপড়ার আহবান জানাচ্ছি।’ প্রসঙ্গত, ভারতের তীব্র আপত্তি সত্ত্বে একাধিকবার কাশ্মীর ইস্যুতে মন্তব্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এরদোয়ানের ভাষণেও উঠে আসে কাশ্মীর ইস্যু। ওই সময়েও গভীর হতাশা ব্যক্ত করে ভারত। এর আগে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগান ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এখন যদি আল-আকসা মসজিদ রক্ষা করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে তারা কাবাকে লক্ষ্যবস্তু করলে তখনো প্রতিরোধ করা যাবে না। জেরুজালেম আমাদের জন্য সতর্কবার্তা।’ এভাবে এরদোগান অনবরত কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনদের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সাধ্যমত সহায়তা করেছেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি লিবিয়া, আফগানিস্তান এবং সিরিয়ার দীর্ঘ দিনের গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়া ও অন্য দেশের সাথে একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ যেখানেই মুসলিমদের সংকট, সেখানেই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন এরদোগান। তাই তিনি দেশে এবং সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়। এমনকি অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেও। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’র অভিমত স্মরণীয়। বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা নিয়ে একটি জরিপ করেছে গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল। এতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মুসলিম নেতা হিসেবে সূচকে এগিয়ে রয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান (৩০%)। এছাড়াও বিশ্বের পঞ্চম জনপ্রিয় নেতা হলেন তিনি। এরপর এই সূচকে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সৌদি সালমান বিন আবদুল আজিজের ২৫% ও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ২১%। উল্লেখ্য যে, তার স্ত্রী আমিনা এরদোগানও মুসলমানদের কল্যাণে এবং মুসলিম নারী জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছেন। তিনি স্বামীর সাথে পাকিস্তান সফরকালে গত ১৪ ফেব্রয়ারি যা বলেন ডনের ভাষায় তা এই, ‘নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া কোনো সমাজই অগ্রসর হতে পারবে না বলে জানিয়েছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি আমিনা এরদোগান। এসময় থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নারীদের মধ্যে সেলাই মেশিন বিতরণ করেন। পাকিস্তানিদের এবারই তিনি প্রথম সহায়তা করেননি। এর আগে ২০১৪ সালে তার নামে নামকরণ করা একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করেন তিনি। বলা বাহুল্য, তার এসব কর্মকান্ড পশ্চাৎপদ মুসলিম নারীদের ক্ষমতায়নে অবদান রাখছে। তিনি রোহিঙ্গাদের দুঃখ কষ্ট সচক্ষে দেখার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন গত বছর। তারপর প্রবল-ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে চরম দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কাহিনী শুনেছিলেন এবং তাদেরকে স্বসম্মানে স্বদেশে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
বর্তমান বিশ্বের বয়োজ্যেষ্ঠ ও অন্যতম জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরও মুসলমানদের কল্যাণে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি পেটালিং জায়ায় আল-কুদস নিয়ে তৃতীয় পার্লামেন্টারি সম্মেলনের উদ্বোধনীতে বলেন, ‘শতাব্দির সেরা চুক্তি দিয়ে জেরুজালেমে ইসরাইলি দখলদারিত্ব বৈধ করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প। এই শান্তি পরিকল্পনায় কেবল ইসরাইলি দখলদারিত্বকেই বৈধতা দেবে এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকবে।’ উপরন্তু তিনি ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের পাশে সবসময় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এর আগে তিনি জন্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে রাজ্যটিকে অচল এবং সারা দেশে সংশোধিত এনআরসি পাশ করে ভারতের মুসলমানদের চরম অনিশ্চয়তার মুখে ফেলার বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছেন। এমনকি তিনি মালয়েশিয়া থেকে ভারতীয়দের বের করে দেওয়ার হুমকিও দেন। তিনি ভারতের দাবি মোতাবেক প্রখ্যাত ইসলামী পন্ডিত ড. জাকির নায়েককে ভারতে ফেরত দেননি। জাকির নায়েক ভারতে নির্যাতনের মুখে পড়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। ড. মাহাথিরের এসব কর্মের প্রতিবাদে ভারত মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে মালয়েশিয়া চরম আর্থিক ক্ষতির সন্মুখিন হয়েছে। তবুও মাহাথির নতজানু হননি। ভারতের নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালন অব্যাহত রেখেছেন। এই অবস্থায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত মাসে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে বলেন, ‘ভারত মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল আমদানি বন্ধ করে দিয়ে যে ক্ষতি করেছে তা আমরা পুষিয়ে দেব। পাকিস্তান আগের চেয়ে বেশি পাম অয়েল আমদানি করবে মালয়েশিয়া থেকে।’ স্মরণীয় যে, কিছুদিন আগে সর্বজনাব এরদোগান, মাহাথির এবং ইমরান খান ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারমাধ্যমকে মোকাবেলা করে ইসলামী নীতি, কৃষ্টি-কালচার ও ঐতিহ্য জাগ্রত করার লক্ষ্যে বিবিসির ন্যায় একটি টিভি চ্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যা’হোক, গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পক্ষেও ব্যাপক সোচ্চার হয়েছেন মাহাথির। রোহিঙ্গাদের হত্যার বিচার, তাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান এবং পুনর্বাসনের পক্ষে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন কয়েক বছর যাবত। স্মরণীয় যে, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নের মডেল বলে খ্যাত মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতা নির্লোভী ও নিরহংকার। তাই তিনি শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মেয়াদ থাকতেই ক্ষমতা ত্যাগ করেছিলেন। সে সাথে তিনি দল ও জোটেরও নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। উপরন্তু তিনি তার পরিবারের কাউকে উত্তরসূরিও মনোনীত করেননি। ক্ষমতার প্রতি এমন নির্মোহ দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি রাজনীতিক ড. নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া সমসাময়িক বিশ্বে আর কেউ আছেন বলে জানা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ড. মাহাথির পুনরায় রাজনীতিতে পদার্পণ ও আন্দোলন করে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। দেশ, ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি গভীর প্রেম-ভালবাসা ও দায়িত্ববোধ না থাকলে এসব হওয়ার কথা নয়।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন এবং অবরুদ্ধ করার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার দেশ। এতে ভারত মহাক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সীমান্তে সেনা বাড়িয়েছে। ফলে যুদ্ধাভাব বিরাজ করছে। মাঝে মধ্যে সংঘর্ষে উভয় দেশের ক্ষতিও হচ্ছে। তবুও ইমরান খান জম্মু ও কাশ্মীরের মজলুম মুসলিমদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, পাকিস্তানের একটি শিশুও জীবিত থাকা অবস্থায় কাশ্মীরের মুসলমানের পক্ষে ভূমিকা পালন করবে। উপরন্তু তিনি চীনের সাথে মিলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া তিনি স¤প্রতি বলেছেন, ‘আজাদ কাশ্মীরের জনগণ চাইলে গণভোট দিতে প্রস্তুত পাকিস্তান। তাতে তারা যদি স্বাধীনতা চায়, তাতেও আপত্তি নেই।’ তার এই অভিপ্রায়ের পথ বেয়ে পাকিস্তানি কাশ্মীর ও ভারতীয় কাশ্মীরের একত্র হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করার পথ সুগম হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইমরান খানের দূরদর্শিতা ও মুসলমানদের প্রতি দায়িত্ববোধ কত গভীর। স্বীকার্য, ইমরান খানের সততা, নিষ্ঠা, কৃচ্ছতাসাধন ও কারিশমার কারণে পাকিস্তানে ভঙ্গুর অর্থনীতি অনেকটা চাঙ্গা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসও অনেক হ্রাস পেয়েছে। ফলে পাকিস্তানে ভাবমূর্তি বিশ্বে উজ্জ্বল হয়েছে। তিনি স্বদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয়। উপরন্তু তিনি কম-বেশি জনপ্রিয় বিশ্বের সর্বত্রই। তার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব নিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ নেতা বিমোহিত। তাই ইরান-সৌদি আরব এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বৈরিতা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ ইমরান খানকে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব দিয়েছেন। সে দায়িত্ব তিনি খুবই দক্ষতার সাথে পালন করছেন। দেশগুলোর মধ্যে বরফ কিছুটা গলতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু ভারত তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এখনো জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলিম নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। আটক নেতাদের মুক্তি দেয়নি। বরং নতুন করে গ্রেফতার করছে। এ ব্যাপারে মিডিয়ায় প্রকাশ, আইএএস টপার শাহ ফয়সালকে জননিরাপত্তা আইনে বন্দি করার ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে উপত্যকার ওই রাজনৈতিক নেতাকে কমপক্ষে তিন মাস এবং প্রয়োজনে আরও দীর্ঘ সময় বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা যাবে। গত ১৪ অগাস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা রদের পর থেকেই আটক করে রাখা হয়েছিল ফয়সালকে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দুই দিনের ভারত সফরের আগে কাশ্মীর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে চিঠি দিয়েছেন শীর্ষ চার মার্কিন সিনেটর। তাতে তারা উল্লেখ করেছেন, ‘কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের পর ছ’মাস কাটতে চলল, এখনও কার্যত বিচ্ছিন্ন অধিকৃত কাশ্মীর উপত্যকা। বন্দিদশায় দিন কাটছে উপত্যকার সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রী। ছয় মাসের বেশি ইন্টারনেট বন্ধের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের আটকে রাখা হয়েছে।’ ইইউ’র পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক মুখপাত্র হেনরিকসন বলেন, ‘কাশ্মীরে অনেক বিধিনিষেধ বিশেষ করে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়ে গেছে। অনেক রাজনৈতিক নেতা এখনো আটক রয়েছেন। আমরা গুরুতর নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও এসব বিধিনিষেধ দ্রুত তুলে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূতসহ ২৫ কূটনীতিক ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি জম্মু ও কাশ্মীর সফর করে আসার পরপরই ইইউ উপরোক্ত বিবৃতি দেয়। ভারতের বিশিষ্টজনরাও জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন রয়েছেন। ‘র’এর সাবেক প্রধান অমরজিত সিং দুলাত ন্যাশনাল হেরাল্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কাশ্মীরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছে না। সরকার দাবি করছে সব কিছু স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যরা বলছেন, কাশ্মীরিরা ভাগ্যের কাছে সব সঁপে দিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, রাস্তায় না নেমে কাশ্মীরিরা ভালোই করেছেন। কারণ, এ অঞ্চলে প্রতি ৩০ জন বেসামরিক ব্যক্তির বিপরীতে একজন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছে।’ তবুও আগামী মাসে কাশ্মীরে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ নির্বাচন ভোটারবিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে নিঃসন্দেহে। এই অবস্থায়ও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ ও সংশোধনী নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থে নেয়া হয়েছে। চাপ সত্ত্বেও আমরা সেই সিদ্ধান্তেই অনড় থাকছি। উপরন্তু কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের ব্যাপক হারে পুনর্বাসন করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে মুসলমানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় সেখানে।
কাশ্মীরের বাইরেও ভারতের সমগ্র মুসলমান আজ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। সংশোধিত এনআরসি জারীর পর থেকে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই বিজেপি ও তার সমর্থক দলের নেতারা মুসলমানদের ভারত ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ পর্যন্ত হচ্ছে। ৬-৭টি রাজ্যে এনআরসি বিরোধী বিল পাশ হয়েছে। তবুও সরকার সেদিকে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করছে না। সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়েছে সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশ। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিনাথ। তিনি মোদী ও অমিত শাহর চেয়েও বেশি উগ্র। তার কথাবার্তায় পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে। উপরন্তু তার নির্দেশে রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন বিজেপির কর্মীর মতো আচরণ করছে মুসলমানদের সাথে। যেমন: গত ১৫ ডিসেম্বর একটি মিছিল বের করে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। কিছুদূর যাওয়ার পরেই প্রকাশ্যে রাস্তার ওপরেই তাঁদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয় পুলিশের। কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিপেটা করে বিক্ষোভকারীদের হটানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে বেধড়ক মারধর করে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আটকও করে। এ ঘটনার পরেই সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। কিন্তু বরাবরই অস্বীকার করেছিল দিল্লির পুলিশ। এই অবস্থায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ উক্ত আক্রমণের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করছেন শিক্ষার্থীরা। হঠাৎ একদল সজ্জিত পুলিশ দাঙ্গা মোকাবিলায় ব্যবহৃত ‘রায়ট গিয়ার’ পরে ও মুখে রুমাল বেঁধে সেখানে ঢুকে পড়ে। তাদের দেখেই একজনকে ডেস্কের তলায় ও অন্যজনকে ছুটে পালাতে দেখা যায়। এরপর কোনো প্ররোচনা ছাড়াই বেধড়ক লাঠিপেটা করতে থাকে পুলিশ। এর ফলে আতঙ্কে এদিক-ওদিক দৌড়াতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এই ভিডিওটি বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সর্বত্রই মানুষ চরম ধিক্কার জানাচ্ছে। এছাড়া, প্রশাসন আন্দোলনকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিয়েছে। তবুও উত্তর প্রদেশে এনআরসি বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে মিডিয়ায় প্রকাশ, ‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির শাহিনবাগে আন্দোলন চলছে। মূলত সংখ্যালঘু মহিলারাই সেই আন্দোলনের সামনের সারিতে। কোলে শিশু নিয়ে মায়েদের দেখা যাচ্ছে দিন-রাত এক করে ধর্নায় বসে থাকতে। দাবি একটাই, ধর্মের নিরিখে নাগরিকত্ব দেয়ার আইন বাতিল করতে হবে।’ কম-বেশি এরূপ অবস্থা সমগ্র ভারতে। এই অবস্থায় ভারতের মুসলিমদের এবং ফিলিস্তিনিদের রক্ষার্থে সব মুসলিম নেতাদের এরদোগান, মাহাথির ও ইমরানের মতো সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে। ছিন্ন করতে হবে ইসলাম ও মুসলমানদের চির শত্রুদের সাথে আতাত। নতুবা ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন অপরাধী হতে হবে তাদের।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন