ভাঙ্গাচোরা খানাখন্দে বেহাল রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়ক। নানা কাজের খোঁড়াখুঁড়িতে অনেক সড়ক দীর্ঘদিন যাবত চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন কাজের নামে সারাবছর ধরে চলতে থাকা এ খোঁড়াখুঁড়িতে নাজেহাল নগরবাসী। রাস্তা খুঁড়ে দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখায় রোদ থাকলে ধুলায় বাতাস দূষিত হয় আর সামান্য বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে রাস্তা একাকার হয়ে যায়। পানিবদ্ধতায় কোথাও কোথাও রাস্তা তলিয়ে যায়। তাতে খানাখন্দে যানবাহন পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে। যানজট, ধুলিদূষণে নগরবাসী এমনিতেই অতিষ্ঠ। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এ যেন ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’।
নগরবাসীকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি এখন চরমে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা পরিপত্র অনুসরণ করা হচ্ছে না এসব কাজে। দুঃসহ এ ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি নগরবাসীর। বিশেষ করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের রাস্তা অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়ির কবলে পড়ে বেহাল অবস্থা। গত বর্ষায় যে সব রাস্তার কার্পেটিং ভেঙ্গেছিল সেসব ভাঙ্গাচুরা রাস্তাও মেরামত হয়নি। অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের বাসিন্দাদেরকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, নর্দমা, ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা’ প্রকল্পের আওতায় উত্তরার বিভিন্ন সড়কে উন্নয়ন কাজ চলছে। গত বছর ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই কাজগুলো চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। দীর্ঘদিন দিন ধরে অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কে উন্নয়ন কাজ চলার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে অভিজাত এলাকা উত্তরার মানুষ।
সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার উত্তরার ৪, ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৪ নম্বর সেক্টরের ২০ ও ২০/বি সড়কের দুই পাশ দিয়ে ড্রেনেজের কাজ চলছে। রাস্তা খুঁড়ে কাদা মাটি তুলে সড়কের উপরেই রাখা হয়েছে। সড়কটি দুই পাশ দিয়েই মাটি তুলে রাখার কারণে এই সড়কটি দিয়ে যানবাহনতো দুরের কথা হেঁটে চলাচলও করা রাচ্ছে না। তুবও জীবন যেন থেমে থাকার নয়। অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এই সড়কটি দিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে তাদের অভিভাবকেরা স্কলে আসা নেয়া করতে হচ্ছে। অফিস-আদালতসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য ঘর থেকে বের হয়েই ভাঙ্গচুরা সড়কের এই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদেরকে। গত প্রায় তিন/চার মাস ধরে চলা এই সড়ক দুটিতে ড্রেনেজের কাজ আর কত দিন চলবে তা কেউ বলতে পরছে না।
এর থেকে আর একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে, একই সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের উপর উন্নয়ন কাজের জন্য রাখা ইট, বালুতে কার্যত সড়কটি বন্ধ। তবুও জীবন থেমে থাকে না। এই ইট, বালুর উপর দিয়েই রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলো অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়েই চলছে। এর মধ্যে ছোট বড় দুর্ঘটনাও ঘটছে।
৬ নম্বর সেক্টরের ঈশা খাঁ এভিনিউতে গিয়ে দেখা গেছে, লাইফ প্রিপারেটরী স্কুল ও স্টাবলিট স্কুল অব ইংলিশ ভবনের সামনের সড়কের উপর উন্নয়ন কাজ শেষ হয়ে গেছে প্রায় তিনি/চার মাস আগে। উন্নয়ন কাজ শেষে সড়করে কাটা অংশ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই কাটা অংশ এখন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাক্রবাস, হিউম্যান হলার ও ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহন রাখার স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সড়কে তিনভাগের দুই ভাগ খানাখন্দক ও অবৈধ দখলের কারণে এই সড়কটিতে এখন দিন রাত যানজট লেগেই থাকে। এছাড়াও ৬ নম্বর সেক্টরের ১৬ নং সড়কেরও একই অবস্থা। একই অবস্থা দেখা গেছে, ১১ নম্বর সেক্টরের চৌরাস্তা জমজম টাওয়ারের সামনের পশ্চিম পাশদিয়ে ১২ নম্বর সেক্টরের খালপাড় পর্যন্ত সড়ক ও চৌরাস্তা জমজম টাওয়ারের উত্তর পাশ দিয়ে ১০ নম্বর সেক্টর ব্রিজ পর্যন্ত। এ যেন দেখার কেউ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, উত্তরার ৪, ৬ ও ১১ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে ডিএনসিসি’র উন্নয়ন কাজ চলছে। ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, নর্দমা, ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্ত্বা’ প্রকল্পের আওতায় এ উন্নয়ন কাজগুলো বর্তমানে চলমান রয়েছে। গত বছর ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই কাজগুলো চলতি বরের এপ্রিল মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদনের স্বার্থে এ উন্নয়ন কাজগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কাজ চলতি বছরের এপ্রিলে শেষ হবে। আর কিছু কাজ মে মাসে শেষ হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া বাকি কাজ আগামী বর্ষার আগেই শেষ হবে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীজুড়ে চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সড়কের মাঝ বরাবর দখল করে চলছে উন্নয়নকাজ। দুই সিটি কর্পোরেশনসহ ঢাকা ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, ডিপিডিসি, ডেসা, ডেসকো, রাজউকসহ ২৬টি সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার আর উন্নয়নকাজ চলছে পুরোদমে। কোথাও মেট্রোরেল, কোথাও বিদ্যুৎ লাইন, স্যুয়ারেজ লাইন আবার কোথাও ওয়াসার পানির লাইন সংস্কারে চলছে এসব খোঁড়াখুঁড়ি। এ ছাড়া চলছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ। এতসব বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞে সমন্বয়হীনতা ও অপরিকল্পিতভাবে করার কারণে চরম দুর্ভোগ সইতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সমন্বয়হীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজের সমালোচনা করেন অনেক নগরপরিকল্পনাবিদ। তবে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়া অন্য সংস্থগুলোর খোঁড়াখুঁড়ির কাজগুলো আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর খোদ মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকে সামনের সড়কটি গত দেড় বছরেরও বেশি সময় অচল হয়ে আছে। কমলাপুর, গোপিবাগ, মুগদা, মানিকনগর ও মান্ডাসহ বেশ কিছু এলাকার মানুষ এই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন অফিস আদালতসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে হয়। ধীরগতির উন্নয়ন কাজের জন্য র্দীঘদিন এই সড়কটি বন্ধ রয়েছে। যে কারণে ওই সব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন চরম দুর্ভোগ ভোগান্তিতে এই সড়কটি দিয়ে চলাচল করতে হয়। এছাড়া গোপিবাগ রেল লাইনের দুই পাশের সড়কে চলছে র্দীঘদিন উন্নয়ন কাজ। যে কারণে এই এলাকার রাস্তাগুলোর অবস্থা একেবারেই বেহাল। এই সড়কগুলো দিয়ে যানবাহন তো দুরের কথা পায়ে হেঁটে চলাচল করাও সম্ভব হচ্ছে না। সড়ক খুঁড়ে বিশাল বিশাল গর্ত করে রাখা হয়েছে। এ এলাকায় বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে প্রতিদিন অবর্নণীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদেরকে। এছাড়াও স্বামিবাগ, মানিকনগর ও গোলাপবাগসহ এই এলাকার প্রায় সড়কেই চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। যে কারণে সড়কগুলো এখন চলাচলের অনুপযোগী। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ে রিকশা, ম্যাক্সি, হিউম্যান হলার, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন।
নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব এ প্রসঙ্গে বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে ঢাকার ছোট-বড় বিভিন্ন সড়কে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন কর্মযজ্ঞে উন্নয়নের সুফল ভোগ করার চেয়ে বিড়ম্বনাই যেন বেশি হচ্ছে। রাজধানীর একেকটি রাস্তায় দীর্ঘদিন কেটে রাখায় যানজট ও ধুলাবালিতে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন গতকাল ইনকিলাকবে বলেন, উত্তরার ৪ ও ৬ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, নর্দমা, ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্ত্বা’ প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন কাজ চলছে। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কের উপর দিয়ে চলা এই কাজ আগামী বর্ষার আগেই শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, কাজের কারিগরি মান ঠিক রাখার স্বার্থে আমাদেরকে একটু সময় বেশি নিতে হয়। জনগুরুত্বপূর্ণ এইসব সড়কের কাজতো আর যেনতেনভাবে করা যায় না। তাই আমাদেরকে কাজের মান ঠিক রেখে কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের এই কাজের মেয়াদ মে ২০২০ ইং পর্যন্ত আছে। তার আগেই এই কাজ শেষ করতে পারবো আমরা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, একটি রাস্তা সুন্দর করে কার্পেটিং করে দেয়ার শর্তে অন্য সেবা সংস্থাগুলোকে রাস্তা কাটার অনুমতি দেয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওই সংস্থার কাজ শেষ হওয়ার পর তারা মেরামতটা ঠিকমতো করে না। সেখানে ইট-সুড়কি-বালু ফেলে যায়। ভালো রাস্তা কাটার পর যতই মেরামত করা হোক, আগের রূপে ফিরে আসে না। তখন ধীরে ধীরে ক্ষতের পরিধি বাড়তে থাকে। ভালো রাস্তাটি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন