বঙ্গবন্ধু একজন শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ এবং ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা ও স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের অহংকার। স্বাধীনতার মহান স্থপতির জন্মশতবার্ষিকীতে সাম্প্রদায়িক ও দাঙ্গাবাজ, বাবরী মসজিদ শহিদকারী, গুজরাট দাঙ্গার মহানায়ক, আসামে ঊনিশ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব হরণকারী, কাশ্মিরের জনগণের উপর নিকৃষ্ট ও বর্বর নির্যাতনকারী, সর্বশেষ দিল্লি ট্রাজেডির নায়ক নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদির মতো ব্যক্তিকে যদি সম্মানিত করা হয় তাহলে তা হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে বৈপরিত্য প্রদর্শণ।
সরকারকে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, এদেশ বার আউলিয়ার পূণ্যভ‚মি। এদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। প্রায় এককোটি আলেম-উলামার বসবাস এ পবিত্র ভূমিতে। তাদের সাথে রয়েছে আরো কোটি কোটি মুসলমানের সমর্থন। ষোল কোটি তাওহিদি জনতার মতাদর্শ ও সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করে খুনি ও জঙ্গি নেতা নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদিকে যদি দেবতার স্থানে বসানো হয়, তাহলে ষোল কোটি মানুষ তা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে না। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে। দেশের ষোল কোটি তাওহিদি জনতা, মুসলিম মিল্লাত ও দেশপ্রেমিক জনগণের মতামত ও দর্শনকে অবশ্যই সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে। নাগরিকদের মতামতকে সম্মান দেখাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে আমরা যদি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার কথা ভুলে যাই, তাহলে বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পাবে।
ইতিমধ্যে দেশের আলেম-উলামা ও তাওহিদি জনতা মোদিকে ঠেকাতে রাজপথে নেমে পড়েছেন। মোদিবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভে উত্তাল দেশ। ক্ষোভ ও অভিমানে ফুঁসছে জাতি। ইসলামী দলগুলো মোদিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রত্যক মুসলমান ঈমানী দায়িত্ব মনে করে এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রাম ও কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। তারা দামোদারদাসকে দেবতার আসনে দেখতে চায় না। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘যদি কেউ হত্যার পরিবর্তে হত্যা অথবা ফাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ব্যতিত হত্যা করে, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যদি কেউ কাউকে রক্ষা করে তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে রক্ষা করল।’ সূরা মায়িদা: ৩২। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পারস্পারিক ভালবাসা, দয়া-অনুগ্রহ ও মায়া-মমতার দৃষ্টিকোণে সকল মুমিন-মুসলমান এক দেহতুল্য। যদি দেহের কোন অংশ অসুস্থ হয় তবে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ব্যাথা অনুভব করে।’ বুখারী। শান্তিপূর্ণ এ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিকে খাট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ আন্দোলন নৈতিক ও মানবিক।
বাংলাদেশ শুধুমাত্র সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির দেশ নয়, বরং এর উৎকৃষ্ট উদাহারণ। তা সত্তে¡ও এখানে সংখ্যালঘুদের পান থেকে চুন খসলে তা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে যায়। আর ভারত শিষ্ঠাচার বর্হিভ‚তভাবে বিদেশনীতির তোয়াক্কা না করে নাক গলায়। বাংলাদেশ সরকারের কাছে ব্যাখ্যা ও জবাব চায়। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের সাথে বলতে হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রী মহোদয়গণ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ আসামের লক্ষ লক্ষ মুসলমান ও বাংলা ভাষা-ভাষীকে ভারত সরকারের রাষ্ট্রহীন করার হীন পরিকল্পনাকে ‘ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়’, হিসেবে অভিমত প্রকাশ করে। দায়িত্বশীলগণ কী উপলব্ধি করে না, তাদের এসব কথায় মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে? মুসলমানের রক্তে দিল্লির রাজপথ রঞ্জিত। অথচ অন্য মুসলমান সেটিকে আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাবে তা মুসলমানের জন্য অত্যন্ত কষ্ট ও বেদনার। এ ধরনের আচরণ প্রকৃত মুমিন-মুসলিমের পরিচয় বহন করে না। কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ হুজুরাত-১০। তাই, এ ধরনের দায়িত্ব-জ্ঞানহীন বক্তব্য, কথা-বার্তা ও আচরণ জনগণ রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে আশা করে না। সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করা হচ্ছে, অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে এর কোনো প্রতিবাদ হয় না! আরাকানের দশ লাখ লোক যেভাবে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রহীন করে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে, অনুরূপভাবে আসামেও ঊনিশ লাখ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আর আমার দেশের সরকার তা বুঝেও না বুঝার ভান করছে। সরকারের নতজানু নীতির কারণে সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী বিজেপি সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্র ও দাদাগিরি করেই চলেছে। আর বাংলাদেশ সবকিছুকে ভারতের আভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
মানবতার মুক্তিরদূত, মহামানব, রহমাতুললিল আলামিন, বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ মুজতবা, আহমদ মোস্তফা (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেউ যখন কোনো খারাপ কাজ হতে দেখে সে যেন তা হাতে প্রতিরোধ করে, যদি হাতে প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখে তাহলে মুখে প্রতিবাদ করে, তাও যদি সামর্থ্য না থাকে তাহলে অন্তরে ঘৃণা করে, আর এটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’ মুসলিম। ভাবতে অবাক লাগে, আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ও ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী একটি দল, কীভাবে বিজেপির মতো কট্টর, উগ্র, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলের বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে অতিথির তালিকায় স্থান দেয়? বলে রাখা আবশ্যক, মানবতার শত্রু মোদির বিরোধিতা মানে ভারত বিরোধিতা নয়, বরং মানবতার পক্ষে অবস্থান। আর উগ্রবাদী বিজেপির বিপক্ষে দাঁড়ানোর অর্থ হিন্দুস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নয়, বরং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ। আমরা প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী। তবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালন এটিই নৈতিকতার মানদন্ড হওয়া উচিত। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।’ আশাকরি, ষোল কোটি নাগরিকের মনের ক্ষোভ, অন্তরের জ্বালা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সেন্টিমেন্টকে বিবেচনায় নিয়ে, সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।
লেখক: গ্রন্থকার ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন