প্রাণঘাতী ‘করোনাভাইরাস’ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর আরেকটি ‘খোদায়ী গজব’ আগমনের পূর্বাভাস এসেছে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে। ইসরাইল ও ভারতকে গ্রাস করতে পারে বলে প্রকাশিত খবরে আভাস দেয়া হলেও এ খোদায়ী গজব কেবল উল্লেখিত দু’টি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
‘ভারত ও ইসরাইলের দিকে ধেয়ে আসছে পঙ্গপালের ঝাঁক!’ গত ৮ মার্চ এই শিরোনামে ‘দৈনিক ইনকিলাব’-এ প্রকাশিত এ খবরে বলা হয়েছে যে, পঙ্গপালের বিশাল একটি ঝাঁক ভারত এবং ইসরাইলের দিকে ধেয়ে আসছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’-এর পঙ্গপাল পূর্বাভাষ বিষয়ক সিনিয়র কর্মকর্তা কেনেথ ক্রিসম্যান। তিনি জানান, ‘এ ঝাঁক চলতি বছরের শেষ নাগাদ মিশরে পৌঁছতে পারে। আর ইসরাইলে পৌঁছতে পারে মে মাসের দিকে। এছাড়া, মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ভারতে হানা দিতে পারে পঙ্গাপালের এ ঝাঁক।’ ইসরাইল ও ভারতের জন্য এ খবর অবশ্যই উদ্বেগজনক ও সতর্কবাণী স্বরূপ।
‘ফাও’-এর কর্মকর্তা পঙ্গপালের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন, এ পঙ্গপাল মরুভ‚মি হতে সৃষ্ট, দিনে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম। পঙ্গপালকে পরিযায়ী বা যাযাবর অর্থাৎ মাইগ্রেটরি পতঙ্গক‚লের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণ একটি ঝাঁকে ৮ কোটি পতঙ্গ থাকতে পারে, যা এক দিনে ৩৫ হাজার মানুষের খাবার উদরস্থ করতে পারে।
পঙ্গপাল প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশের কৃষি ক্ষেত্রে যে ক্ষতি সাধন করে থাকে সে খতিয়ান অজানা। অথচ পঙ্গপালের হামলা হতে কোন দেশই মুক্ত নয়। এরা মানুষের দৈহিক, শারীরিক কোন ক্ষতি করতে না পারলেও মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড পঙ্গু করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, যার ভুরি ভুরি প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। পঙ্গপাল মানুষের ওপর ‘আজাবে এলাহী’ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে থাকে, যার প্রমাণ পবিত্র কোরআনেই রয়েছে। হজরত মূসা (আ.) এর সময়ে ফেরাউনের ‘কিবতি’ জাতির ওপর একের পর এক যে সব আজাব নাজেল হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল পঙ্গপালের হামলা, যার বর্ণনা খোদ কোরআনে রয়েছে। পঙ্গপাল কীভাবে ফেরাউনের ‘কিবতি’ জাতির ওপর আজাব রূপে নাজেল হয়েছিল, তার বর্ণনা বিভিন্ন সূত্রে নিম্নরূপ:
পঙ্গপাল তাদের ক্ষেত-খামার ও বাগ-বাগিচার সকল উৎপন্ন দ্রব্য খেয়ে ফেলে, এমনকি বৃক্ষ রাজিকেও পাতা শূন্য করে দেয়। অতঃপর পঙ্গপাল তাদের আবাস গৃহগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং তাদের গৃহগুলোর ছাদ, দরজা-জানালা এবং খুঁটিগুলোকেও ধ্বংস করে দেয়। তাছাড়া তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, কাপড়-চোপড়, বিছানা-পত্র ইত্যাদি সবকিছু চেটে খায়। ফলে কিবতিরা দারুণ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয় এবং ভ‚খা, নাঙ্গা হয়ে মরতে শুরু করে। তাদের অনুরোধে হজরত মূসা (আ.) ময়দানে দাঁড়িয়ে তাঁর ‘আসা’ (লাঠি) এর ইঙ্গিতে পঙ্গপালের ঝাঁক যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে যায়। এভাবে কিবতিরা পঙ্গপালের হামলা থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। (কিবতিদের ওপর লাগাতার আজাবগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটির মাঝখানে এক মাস বিরতি ছিল)
প্রাণীবিদদের মতে, পঙ্গপাল দুই প্রকারের হয়ে থাকে, স্থলের এবং সাগরের। স্থলের পঙ্গপাল আবার কয়েক প্রকারের, যেমন- বড় আকারের ও ছোট আকারের এবং বিভিন্ন বর্ণের। যথা- লাল, সবুজ, হলদে এবং সাদা। পঙ্গপালের ডিম পাড়ার একটি অদ্ভুত রীতি এই যে, ডিম পাড়ার ইচ্ছা যখন হয় তখন সে অনাবাদি ভ‚মিতে চলে যায়। জন মানবহীন এরূপ স্থানে গিয়ে সে তার লেজ দ্বারা ডিম পরিমাণ মাটি গর্ত করে, আর সে গর্তেই ডিম পাড়ে এবং সেখানে জমির তাপে বাচ্চা জন্ম হয়। পঙ্গপালের ছয়টি পা হয়, দুইটি বক্ষে, দুইটি মধ্য ভাগে এবং দুইটি থাকে শেষ ভাগে। পঙ্গপাল দলবদ্ধভাবে উড়ে বেড়ায় এবং সর্দারের অনুগত হয়ে চলে, সর্দার উড়াল দিলে পঙ্গপালও উড়াল দেয়, তার সর্দার কোন স্থানে অবতরণ করলে সেও তার সাথে অবতরণ করে।
বিভিন্ন হাদীসে পঙ্গপালের উল্লেখ দেখা যায়। রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতাআলা এক হাজার মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোর মধ্যে ছয়শ’ দরিয়ায় বাস করে এবং চারশ স্থল ভাগে। আর যখন আল্লাহতাআলা মাখলুককে ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করবেন, তখন সর্ব প্রথম পঙ্গপাল ধ্বংস করবেন। অতঃপর একটার পর একটা অন্যান্য মাখলুক ধ্বংস করবেন।’ আরো বর্ণিত আছে যে, ‘সমগ্র মাখলুকের মধ্যে সর্ব প্রথম পঙ্গপাল ধ্বংস করা হবে, কেননা পঙ্গপাল সেই মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর অবশিষ্ট ছিল।’
বোখারী শরীফে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) এর বরাতে বলা হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, একবার হজরত আইউব (আ.) উলঙ্গ গোসল করছিলেন। তখন তাঁর প্রতি আল্লাহতাআলা সোনালী পঙ্গপালের বৃষ্টি বর্ষণ করেন, তিনি তাঁর ‘দামান’ (কাপড়) দ্বারা চেপে রাখেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে আইউব! আমি তোমাকে তাদের থেকে বেনিয়াজ করিনি।’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমার বরকত হতে আমি বেনিয়াজ হয়নি।’
হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘এক বছর হজরত উমর (রা.) এর আমলে পঙ্গপাল হারিয়ে যায়, এতে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। পঙ্গপাল খুঁজে বের করার জন্য তিনি চতুর্দিকে লোক প্রেরণ করেন। সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনের দিকে লোক চলে যায়। ইয়েমেনে গমনকারী পঙ্গপালের সন্ধান পান এবং তিনি হজরত ফারুকে আজম (রা.) এর খেদমতে তা পেশ করেন, এতে খলিফা চিন্তামুক্ত হন।’
‘আমুরিয়া’ যুদ্ধে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। মাসলামা ইবনে আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান তাঁর সৈন্য বাহিনীসহ যখন ‘আমুরিয়া’ নামক স্থানে উপনীত হন, তখন মাসলামার বুকে ব্যাথা আরম্ভ হয়, যার ফলে তিনি রণক্ষেত্রে উপস্থিত হতে পারেননি। আমুরিয়াবাসীরা মুসলমানদের কাছে জানতে চাইল, তাদের সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে কেন আসেননি? মুসলমানরা বললেন, তাঁর বুকে ব্যথা, তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আমুরিয়াবাসীরা মুসলমানদেরকে একটি পোশাক দেয় এবং বলে, ‘এটি তোমাদের সেনাপতিকে পরিয়ে দেবে, দ্রæত বুকের ব্যথা সেরে যাবে।’ মুসলমানগণ তাই করলেন। পোশাক পরিধান করা মাত্র মাসলামা ইবনে আবদুল মালেকের বুকের ব্যথা সম্পূর্ণ সেরে যায়।
ইবনে ইমরান বলেন, একবার রসূলুল্লাহ (সা.) এর সামনে একটি পঙ্গপাল এসে বসে পড়েছিল, যার পালকগুলোতে লেখাছিল, ‘আমরা আল্লাহতাআলার ফৌঁজ, আমাদের ৯৯টি ডিম হয়। যদি পূর্ণ একশ হয়ে যায় তাহলে আমরা গোটা বিশ্বকে চেটে খাবো।’ অতঃপর রসূলুল্লাহ (সা.) একটি দোয়া পাঠ করেন। দোয়াটি পাঠ করার পর হুজুর (সা.) এর খেদমতে হজরত জিবরাইল (আ.) হাজির হন এবং আরজ করেন যে, ‘আপনার দোয়ার কিছু অংশ কবুল হয়েছে।’ কোন কোন হাদীসে বলা হয়ে থাকে যে, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পঙ্গপালকে হত্যা করবে না, কেননা এরা আল্লাহর ফৌঁজ।’ পঙ্গপালের শরীয়া হুকুম সম্পর্কে নানা কথা আছে, যা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। তবে এ সম্পর্কে আল্লামা দামিরী (রহ.) এর অভিমতটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, পঙ্গপালের ‘লোআব’ (থুথু) উদ্ভিদের জন্য বিষাক্ত বস্তু, কোন উদ্ভিদে পতিত হলে তাকে ধ্বংস করে ছাড়ে। এ কারণে পঙ্গপাল যে ক্ষেত-খামারে অথবা জঙ্গলে পতিত হয় তাকে বরবাদ করে দেয়। আল্লামা দামিরী (রহ.) আরো বলেন, পঙ্গপালের মধ্যে বিভিন্ন জন্তুর দশটি জিনিস বা স্বভাব পাওয়া যায়: (১) ঘোড়ার মুখমন্ডল, (২) হাতির চোখ, (৩) বলদ (গরু) এর গর্দান, (৪) ‘বারো শিংগা’ জন্তুর শিং, (৫) সিংহের বক্ষ, (৬) বিচ্ছুর পেট, (৭) শক‚নের পালক, (৮) উটের উরু, (৯) উট পাখির পা এবং (১০) সাপের লেজ।
ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল আসার সতর্কবাণী যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তা কেবল ইসরাইল ও ভারতকে গ্রাস করতে পারে তা কীভাবে বিশ্বাস করা যায়, আল্লাহর গজব ‘করোনাভাইরাস’ তো সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য প্রাণঘাতী মহা আতঙ্করূপে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়েছে। সকল প্রকারের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করাও জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন