তৃষিত পথিককে পানি পান করতে গিয়েই নানান বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছিল। ঠা ঠা রোদে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে পথিককে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয় পানির জন্য। সুকুমার রায়ের সেই ‘অবাক জলপান’ নামক সরস নাটকে এটা ছিল জনে জনে বোঝাবুঝির ভুল!
অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং আরো কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন নিয়ে হচ্ছেটা কোন কিসিমের নাটক? ‘অবাক নির্বাচন’! নির্মম রসিকতা? অমানবিকতা? অনেকেই তো জানতে ব্যাকুল, করোনাভাইরাসের মহামারী পরিস্থিতির অকুল সাগরে বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমাদের দেশ ও জাতির এই আপদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এ কেমন বিপজ্জনক পাগলামি! জাতিকে উদ্ধার করার মতোই জরুরি কী?
করোনার ধাওয়ায় ভয়-আতঙ্কে কাঁপছে থর থর গোটা বাংলাদেশ। কাঁদছে দুনিয়াবাসী। ভয়াল ভূমিকম্প যেন অব্যাহত। একটি সূচালো মন্তব্য শোনা যায় বিজ্ঞজনের নিকট: “করোনাভাইরাস যতটা না মানুষ মারে, তারচেয়ে বেশিগুণে মানুষকে লুকিয়ে ফেলে”। অর্থাৎ এখানে স্বেচ্ছায় অথবা ডাক্তারের নির্দেশে কোয়ারেন্টাইনে গৃহবন্দী থাকার কথাই বলা হচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের ধনিক-বণিকদের সেই দুরবস্থায় দিন যাচ্ছে। সাধারণ পাবলিক কী!
ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমানগণ আলাহতায়ার দরবারে আনত। কান্নাভেজা চোখে দুই হাত তুলে মহাদুর্যোগ থেকে আলাহর বান্দাহরা পানাহ চাইছেন। দয়া-ক্ষমা ভিক্ষা করছেন। আগামীকাল পবিত্র জুমাবারে মসজিদে মসজিদে শুধুই ফরিয়াদ শোনা যাবে। এহেন দুঃস্বপ্নের দিন-রাতগুলোতে সবাই নিজ নিজ পরিবার-পরিজন আর কর্মস্থলে সহকর্মীদের নিয়ে সবরকম পূর্ব-প্রস্তুতি, সতর্ক-সচকিত জীবনযাপন করছেন।
তবুও কারো মনে নেই শান্তি। অজানা ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ৬৪ জেলার ১৬/১৭ কোটি মানুষকে। রাজধানী ঢাকার মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রাম স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কোলাহল হারিয়ে প্রায় ফাঁকা। আজ বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিনের শেষে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ঘরমুখো মানুষের ছোটাছুটি আর যানবাহনে ভিড় চোখে পড়ে শহরময়। এরপর ভুতুরে নগরী।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো বন্ধই। জরুরি দরকার না পড়লে মানুষ নিজঘরের বাইরে যান না। চট্টগ্রাম নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, গণপরিবহন, খাবারের দোকান, হকারের কামাই-রুজি, ঠেলাগাড়ি কিংবা ভ্যানের চাকা অচল হওয়ার পথে। সামনের দিনগুলো নিয়ে মানুষজন দুশ্চিন্তায় কাতর। স্তব্ধ জীবনযাত্রা। গ্রামে-গঞ্জে পালাচ্ছে অনেকেই। ভয়ে কাবু মানুষ। দিনে দিনে অবস্থার অবনতি ঘটছে।
আর চরম দুঃসহ করোনাভাইরাসের মহামারী পরিস্থিতিকে যেন থোড়াই কেয়ার করতে নারাজ করিৎকর্মা নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৭০ লাখ মানুষের চট্টগ্রাম মহানগরীটি চসিকের আওতায় পড়েছে ৫টি সংসদীয় আসন। ৪১টি ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা সাড়ে ১৯ লাখ। তারা এখন কে কোথায় কী অবস্থায়? না, কোনো মাথাব্যাথার দরকার নেই। ২৯ মার্চেই যেন ভোট ভোট খেলা করেই ছাড়বেন তারা। মানুষের মহাবিপদ? এতে কী যায় আসে? তৃষ্ণাকাতর মানুষ পানি পানি করে ধড়ফড় করছে। আর ‘অবাক জলপান’ নাটকের চেয়েও এককাঠি সরেস ইসির মহাজ্ঞানের ফসল বুঝি এই ‘তাজ্জব ভোট’!
সর্বশেষ যখন এই প্রতিবেদন লেখা হয় আজ রাত অবধি চসিক নির্বাচন এবং আরো কয়েকটি তাজ্জবের উপ-নির্বাচনের ভোটকান্ড বাতিল কিংবা স্থগিতের কোনো খবর নেই। ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’। ‘দেখছি আর ভাবছি’র মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও মানুষ ধরে নিয়েছে বন্ধ হবেই ভোটকাণ্ড। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ভোট নিয়ে মোটেই ভাবছি না। মাথায় এখন জীবন-মরণ চিন্তা। ভোট পিছিয়ে দেওয়া কিংবা স্থগিতের দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই চাটগাঁর নাগরিকমহল সরব।
এই প্রেক্ষাপটে আজ বিকেলে চট্টগ্রামে চাউড় হয়ে যায় নতুন এক খবর। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে হাজির থাকা চসিক ভোটের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ তথা দুই নায়ক-নেতা আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় মেয়র প্রার্থী দলের মহানগর যুগ্ম সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ধানের শীষে মেয়র প্রার্থী দলের মহানগর সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন একে অপরের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিলেন।
উপস্থিত লোকজনের বলাবলি, এ যেন ভোটের বদলে এবং চট্টগ্রামের জনগণের কাছে তারচেয়েও আজ গুরুত্বপূর্ণ কারোনাভাইরাসে জনসচেনতায় সতর্ক বার্তাটি তারা দিয়ে দিলেন। ভালো কাজে হাসিখুশি দুজনা তখন পেয়েছেন হাততালিও। এখন কী বলবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন? কারোনাভাইরাসের শতরকম বাধা-বিপত্তি পায়েদলে বাতাস থেকে ভোট পড়বে ২৯ তারিখে? নাকি ভোটার-জনগণ হুদা কমিশনের আদেশ পালনে করোনার ঝুঁকি ঠেলে ঠেলে জীবনদানেও বাধ্যগত? নাকি হোম কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে এসে হলেও মহামূল্যবান ভোটটি দিয়েই যাবেন তারা?
গতকালও চট্টগ্রামবাসীর মুখে এখানে সেখানে বিরূপ আলোচনায় উঠে আসে চসিক এবং আরও কটি উপ-নির্বাচন নিয়ে কেনইবা নির্বাচন কমিশন করোনার মধ্যেও মরিয়া? নাকি গিনেজ ওয়ার্লড বুকে নিজেদের বিরল সাহস ও সাফল্য কাহিনী তুলে ধরা এবং নিজেদের অবিস্মরণীয় রাখতেই এতোটা মরিয়া!
এ যেন রোম পোড়ে- নীরু সুখে বাঁশি বাজায়! কিংবা কারও পৌষ মাস- কারও সর্বনাশ। চসিক নির্বাচন এবং আর তিনটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সময় দেশে বৈশ্বিক কারোনার মহামারী দুর্যোগ ছিল না- কথা ঠিক। ২১ মার্চ ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসনে উপ-নির্বাচন এবং ২৯ মার্চ চসিক নির্বাচন, বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনে উপ-নির্বাচন হওয়ার সিডিউল দেয়া হয়।
কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি কোথায় ধাবিত হয়েছে দিনে দিনে? তাকে কেন উপেক্ষা? এহেন মহাবিপদের সময়ে ভোট বন্ধ হলে দেশ-জাতি এবং জগতের কোন ক্ষতিটা হবে? নাকি ‘ভোট উৎসব’ ভেঙেচুরে যেতে দেয়া যায় না? এ কমিশন দেশে ভোটের ‘উৎসব’ কতটা উপহার দিয়ে জাতিকে ধন্য করতে পেরেছেন সেটা বরং তারাই ভালো বলতে পারবেন। ভোটাররা তো ভোটকেন্দ্র বিমুখ সেকথা নতুন কী আর?
সর্বজ্ঞানী কমিশন না জানার কথা নয় যে, ভোটগ্রহণের যারা দায়িত্বে তাদের মাঝেও চরম ভয়-আতঙ্ক, অনীহা কাজ করছে কারোনার দুর্যোগ-দুর্ভোগ নিয়েই। তারা তো এই গ্রহের মানুষ। রক্তমাংশের মানুষই তো। আছে পরিবার-পরিজন। নাকি মঙ্গল গ্রহবাসীরা উড়ে এসে গুরুদায়িত্ব পালন করে যাবেন? তারা প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসার। ভোটকেন্দ্র পাহারাদার আইন-শৃঙ্খলা কর্মী। প্রার্থীদের তরফে পোলিং এজেন্ট। চরম ঝুঁকিতে পড়ছেন তারাও। মানসিক চাপ বাড়ছেই। এরইমধ্যে একজন আনসার সদস্য আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
অবশ্য যেনতেন প্রকারে ভোটকাণ্ড হয়ে গেলেও অর্থাৎ ভোটারশূণ্য ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন সারা হলে তারপর হয়তো কারোনাভাইরাসের দোষ দেওয়া কঠিন কাজ হবে না। অথবা নিকট অতীতের ভোটের মতোই ভোটদানের হার ৩০, ৫০, ৭০, ৮০, ৯০ এমনকি ১০০ শতাংশ ‘নিশ্চিত’ হওয়ার কিংবা প্রদর্শনের ক্যারিশমা দেখাতে পারলে তাতে আশ্চর্যের কী? দোষেরও কিছু না! চাটগাঁবাসীর মুখে মুখে খেদ আর ক্ষোভের মিশ্রণে উচ্চারিত হচ্ছে এসব কথা। যাদের ঠিকানা বীর চট্টলা। বারো আউলিয়ার পুন্যভূমি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন