শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সৎ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের পরিণতি

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। সারা বিশ্বের মানুষ আতঙ্কিত এ ভাইরাস নিয়ে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সবাইকে পরিষ্কার থাকা ও বাইরে মাস্ক পরে চলাচল করতে বলা হলো।
কিনতে ঝুঁকছেন অনেকেই মাস্ক ও হ্যান্ডওয়াশ। তবে এটিকে মওকা হিসেবে নিয়ে মাস্ক ও হ্যান্ডওয়াশের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বিক্রেতারা।
কিছুদিন আগে আমাদের ভেতরের একশ্রেণির মানুষ পেঁয়াজ মজুত করে রাখলেন, পেঁয়াজের আকাশচুম্বী দাম হলো। তবু আমাদের কিছুই করার ছিল না। আমরা বেশি দাম দিয়েই পেঁয়াজ কিনলাম। প্রতি বছর রোজার সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দাম থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের, তাই আমাদের বেশি দামেই কিনতে হয়।
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা করেছেন। সৎ ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি বিশ্ববাসীর নিকট আদর্শ হয়ে আছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তাঁর আমানতদারিতা, নিষ্ঠা ও সততা দেখে হযরত খাদিজা (রা.) তাঁর প্রতি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ব্যবসায়িক নীতি ছিলো, দামবৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্য গুদামজাত করা যাবে না। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি গুদামজাত করল সে বড় অপরাধ করল।” [মুসলিম : ১৬০৫]
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব এবং ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করো।” [সূরা আন-নিসা : ২৯]
মুমিন ব্যবসায়ীদের গুণাগুণ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন , “এমন লোকেরা, যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, সালাত কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন।” [সূরা আন-নূর : ৩৭-৩৮]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীগণ হাশরের দিন নবী, শহীদ ও সত্যবাদীদের সঙ্গে অবস্থান করার সৌভাগ্য অর্জন করবে।” [তিরমিযী : ১২০৯]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “উত্তম কামাই হলো, একজন মানুষের তার নিজের হাতের কামাই এবং সব ধরনের মাবরুর ব্যবসা-বাণিজ্যের কামাই।” [মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫]
মাবরুর ব্যবসা হলো, যে বেচা-কেনাতে কোনো প্রকার ধোঁকা, খিয়ানত, মিথ্যা ও প্রতারণা থাকে না। পক্ষান্তরে যে ব্যবসার সাথে মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা ও খিয়ানতের সংমিশ্রণ ঘটে তাকে মাবরুর বলা যাবে না। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে সত্যিকার ব্যবসায়ী বলা যাবে না। কিয়ামতের দিন ফাজের (অপরাধী) লোকদের সাথে হাশরের মাঠে তাদের পূণরুত্থান হবে। রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন ফাজের হিসেবেই উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎ কর্ম করে ও সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া।” [তিরমিযী : ১২১০]
ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা :
এক- ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও কায়কারবারগুলো বৈধ হতে হবে। অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ও অবৈধ কায়কারবারকে ইসলাম বৈধতা দেয় না। যেমন, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া ইসলামে অনুমোদন নেই। কারণ, এসব বিষয়কে ইসলামে মৌলিকভাবেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার ব্যবসার সাথে এসবের সংমিশ্রণ আপনার ব্যবসাকে কলুষিত করে।
দুই- ব্যবসা-বাণিজ্য সকল অবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে ইসলামের কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি :
১. ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না
ব্যবসা দ্বারা মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত দেন যে, “নিজে ক্ষতিগ্রস্তÍ হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়।” [ ইবন মাজাহ : ২৩৪১]
২. ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি করা যাবে না
এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে খাবারের পন্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।” [ সহীহ মুসলিম : ১০২]
৩. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না
মিথ্যা অবশ্যই একটি নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। ব্যবসার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কোনো মুসলিম সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্যকে গোপন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।” [সূরা আল- বাকারা : ৪২]
৪. ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না
অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয়তখন কম দেয়।” [সূরা আল-মুতাফফিফীন : ১-৩]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন কোনো স¤প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্য-শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে”। [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ৭৮৫]
৫. পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না
মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন- যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।” [সহীহ মুসলিম : ১০৬]
৬. নিজে ঠকা যাবে না এবং অপরকেও ঠকানো যাবে না
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে অভিযোগ করল, যে সে বেচা-কেনাতে প্রতারিত হয় বা ঠকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন তুমি বলে দিবে যে কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে।”
[সহীহ বুখারী : ৬৯৬৪]
৭. খাদ্যে ভেজাল মেশানো থেকে বিরত থাকা
খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী লোকদের সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। তাদের বিশ্বাস করে না, অন্তর থেকে সম্মান করে না। দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও ব্যর্থতা নিজের চোখেই দেখতে পারে।
পরকালের কঠিন শাস্তি তো তাদের ভোগ করতে হবেই। ইদানীং শুধু ভেজাল নয়, বিভিন্ন আধুনিক নামের বিষও মেশানো হয়। এমনকি ভেজাল ওষুধেরও বাজারে ছড়াছড়ি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “এবং তোমরা অপবিত্র বস্তুকে পবিত্র বস্তু দ্বারা পরিবর্তন করো না।” [সূরা আন-নিসা : ২]
শিল্পপতি, আমাদানিকারক ও আড়তদারদেরকে জনবান্ধব হতে হবে। তাঁরা মুনাফার জন্য ব্যবসা করবেন; কিন্তু অতিমুনাফা, রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার চিন্তা, বাজার অস্থিতিশীল করে জনগণকে কষ্ট দেয়া, গুজব ছড়িয়ে মূল্য বৃদ্ধি করা, বিপদের সময় ভোক্তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। “কম লাভ, বেশি বিক্রি” ফর্মুলাতে ফিরে যেতে হবে। যে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে জনগণকে জিম্মি হতে হয় সেটি সৎ ব্যবসা হতে পারে না। সৎ ব্যবসা ইবাদতও বটে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Kutub uddin ৩১ মার্চ, ২০২০, ১০:৪৭ পিএম says : 0
খুব ভাল লাগল। বাবসা-বানিজ্যে ইস্লামের রিতিনিতির উপর আমাদের অনেক গবেষণা থাকা দারকর। মাঝেমধ্যে এমন লেখা পেলে ক্রিতজ্ঞ থাকব।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন