বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

ঐ নতুনের কেতন উড়ে

প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইমামুল হাবীব বাপ্পি

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল ইউরোপের সবচেয়ে বড় ফুটবল মহাজজ্ঞ উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের ১৫তম আসর। চরম উত্তেজনা আর হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে এক মাসের এই মহাজজ্ঞের পর্দা নেমেছে গত ১০ জুলাই। বাঘা বাঘা সব রথী-মহারথীদের ভিড়ে এবার নতুন চ্যাম্পিয়নকে খ্ুজে নিয়েছে আসরটি। ফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সকে হারিয়ে প্রথমবারের মত বড় কোন ফুটবল শিরোপা ঘরে তুলেছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। ফ্রান্স ও রোমানিয়ার মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টের শেষ হাসিটা পর্তুগিজরা হাসলেও এর মাঝের সময় জন্ম দিয়েছে নানা ঘটন-অঘটনের।
ইউরোপের সেরা ২৪টি দেশকে নিয়ে ফ্রান্সের ১০টি শহরে অনুষ্ঠিত হয় এবারের মূল পর্ব। তবে টুর্নামেন্টকে ঘিরে হাসি-কান্নার পর্বটা শুরু হয়েছিল সেই বাছাইপর্ব থেকেই। সেখানে সবচেয়ে বড় অঘটনটি ছিল, গেল বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালিস্ট ও ইউরোর ১৯৮৮ সালের চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের মূল পর্বে উঠতে না পারা। তাতে যে আসরের রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল তা নয়, বরং তাদের হারিয়ে মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়া আইসল্যান্ডের মত নবাগত দল চমক ধরে রেখেছিল মূল পর্বেও। রুপকথার ভেলায় চড়ে তারা উঠে গিয়েছিল নক-আউট পর্বেও। শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি মাত্র ৩ লক্ষ ৩০ হাজার জনসংখ্যার দেশটির সেই যাত্রা। নক-আউট পর্বে টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট ইংল্যান্ডকে হারিয়ে জন্ম দিয়েছিল ফুটবলের আরেক ইতিহাসের। একদিকে তখন আইসল্যান্ডারদের গৌরবগাঁথা, অন্যদিকে ইংলিশ ফুটবলের করুণ বেদনা-কাব্য। যে কাব্যের পরিসমাপ্তি হয় তাদের কোচ রয় হজসনের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।
এ তো গেল আইসল্যান্ড বন্দনা। টুর্নামেন্টের আরেক নবগত ওয়েলস তো রিতিমত ইতিহাসই গড়ে ফেলল এবার। দীর্ঘ ৫৬ বছর পর ফুটবলের বড় কোন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া দলটির অগ্রযাত্রা থামে সেমি-ফাইনালে এসে! ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল জর্জ বেস্টের দেশ নর্দান আয়ারল্যান্ডও। প্রথমবার আসরে সুযোগ পেয়ে জায়গা করে নেয় শেষ ষোলোয়। টুর্নামেন্ট জুড়েই তাই একদিকে যেমন ছিল নবাগতদের গৌরবের বিজয়গাঁথা, অন্যদিকে ছিল ফেভারিটদের হতাশাময় বিদায়ের করুণ রাগ। অখ্যাত আইসল্যান্ডের কাছে ইংল্যান্ডের বিদায়ের কথা আগেই বলেছি। সেই সাথে একে একে বিদায় নেয় হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ের স্বপ্নে বিভোর স্পেন (কোয়ার্টার ফাইনাল), আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি (সেমিফাইনাল), দেশের ফুটবলে নবদিগন্তের আলো হয়ে আসা বেলজিয়াম (কোয়ার্টার ফাইনাল) এবং ফেভারিট না হয়েও দুর্দান্ত খেলতে থাকা ইতালি (কোয়ার্টার ফাইনাল)। স্বাগতিক হিসেবে তৃতীয় বৈশ্বিক ফুটবল শিরোপার স্বপ্ন দেখতে থাকা ফ্রান্সের যাত্রাটা ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছালেও শেষ মুহূর্তে এসে হতাশাই সঙ্গী হয় তাদের। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেও হার মানতে হয় পর্তুগিজদের কাছে।
পর্তুগালের শিরোপা জয়টা আসলে অবাক করার মতই। গ্রুপ পর্বে একটি ম্যাচও না জিতে ৬টি গ্রুপ থেকে মোট ৬টি তিন নম্বর দলের মধ্যে তৃতীয় সেরা দল হিসেবে নক-আউট পর্বে পা রাখে তারা। এই পর্বে জয়ের জন্য ৪ ম্যাচের ৩টি ম্যাচই তারা নিয়ে যায় অতিরিক্ত সময়ের ফেরে। ইউরোর ইতিহাসে যা একটি রেকর্ড। শেষ ষোলোয় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেই ভাগ্যপ্রসূত অতিরিক্ত সময়ের গোলে জয়ের পর পোল্যান্ডের বিপক্ষে টাইব্রেকারও গেল তাদের পক্ষে। শেষ চারে ওয়েলসের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ে জিতলেও সেখানেও ছিল ভাগ্যের ছোঁয়া। ঐ ম্যাচে ওয়েলস জিতলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। এরপর আসে সেই স্বপ্নের ফাইনাল। এখানেও ফুটবলের সেই চরম অনিশ্চয়তার আসল নাটক জমে ওঠে ম্যাচের শুরুতেই। সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রোনালদো চোট নিয়ে উঠে যায় ম্যাচের ২৪ মিনিটে। স্বাগতিকরা তো বটেই অনেকেই ভেবেছিল ফরাসিদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবার আটকায় কে! কিন্তু ভাগ্য নিয়ন্তা যে অন্য হিসাব কষে রেখেছিলেন! নইলে ফরাসি খেলোয়াড়রা একাধিক গোলের সুযোগ কেন সেদিন কাজে লাগল না, বল বারে লেগেও ফিরে আসে একেবারে নির্ধারিত সময়েরও অন্তিম মুহূর্তে! আর টুর্নামেন্ট জুড়ে প্রতিপক্ষর রক্ষণে ত্রাস ছড়ানো অঁতোয়ান গ্রিজম্যানের হেডারই বা অত কাছ থেকে কেন লক্ষ্যচ্যুত হবে! ম্যাচের ৮০ মিনিট পর্যন্ত যে দলটি প্রতিপক্ষের পোস্টে কোন শটই নিতে পারল না, সেই দলের গলায়-ই তাই উঠল বিজয় মাল্য। যা ছিল ভাগ্য বিধাতার নিজ হাতে গড়া এক অভাবনীয় কিন্তু বাস্তব পরিসমাপ্তি।
কখনো কখনো অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনাও শিরোনাম হয়েছে এবারের ইউরোয়। গ্রুপ পর্বে রাশিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ফুটবল মাঠের উত্তেজনা মাঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ে দর্শক গ্যালারিতে। ঘটতে থাকে পরস্পরের দিকে বোতল বিয়ার ক্যানসহ বাজির ফোয়ারা নিক্ষেপ করার মত ঘটনা। এক পর্যায়ে যে ঘটনা মোড় নেয় শারিরীক সংঘর্ষে। সেই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারি থেকে স্টেডিয়ামের বাইরে। রক্তাক্ত সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে দর্শকদের ওপর বাধ্য হয়ে চড়াও হতে হয়েছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই ঘটনায় রাশিয়ান দর্শকদের অভিযুক্ত করে সেদেশের ফুটবল সংস্থাকে জরিমান ও মৌখিক সতর্ক করা হয়।
আবার কখনো টুর্নামেন্টের মাঝে পরে বেঁজেছে কিংবদন্তিদের বিদায়ের করুণ সুর। সুইডশ তারকা জøাতান ইব্রাহিমোভিচের বিদায়ের ঘটনা ছিল তেমনি একটি ঘটনা। ২০০১ সাল থেকে এই পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছরের পথচলায় ১১৬টি ম্যাচ খেলে সুইডিশ জার্সি গায়ে ৬২ গোল করে বসেন দেশের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে। এমন কিংবদন্তির বিদায় হলো গ্রুপ পর্ব থেকেই দল বিদায় নেওয়ার কারণে। বিদায় বলেছেন স্পেনকে ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জেতানো কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কও। স্পেন দলকে তার আর কিছুই দেওয়ার নেই জানিয়ে সেচ্ছাই সরে গেছেন এই কিংবদন্তি কোচ।
আসছে ২০২০ ইউরো অনুষ্ঠিত হবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। টুর্নামেন্টের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষেই এই ‘রোমান্টিক’ আয়োজন। ইউরোপের ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের ১৩টি শহরে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচগুলো। সেবারো অংশ নেবে ২৪টি দেশ। চ্যাম্পিয়ন দেশ সুযোগ পাবে ২০২১ ফিফা কনফেডারেশন কাপের মূল পর্বে। ঐ আসরও হয়তো জন্ম দেবে অনেক অজানা হাসি-কান্নার ঘটনার। যে ঘটনা আগেই ঠিক করে রেখেছেন সেই তিনি, যিনি সবার অলক্ষে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন সমস্ত সৃষ্টিকুল।

সংখ্যায় ইউরো ২০১৬ ফাইনাল

৩৫ ম্যাচ খেলার পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের প্রধম শিরোপা জিতল পর্তুগাল।
১০ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের দশম দেশ পর্তুগাল।
৬ ষষ্ঠ বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে গোল করলেন এদের। এর আগে এই কীর্তি গড়েনÑ অলিভার বেয়ারহফ (জার্মানি), সিলভেইন উইতর (ফ্রান্স), ডেভিড ত্রেজেগুয়েত (ফ্রান্স), হুয়ান মাতা (স্পেন) এবং ফার্নান্ডে তোরেস (স্পেন)।
৩ পর্তুগাল একমাত্র দল, যারা একই আসরে তিনটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে খেলেছে।
৮০ মিনিট পর্যন্ত লক্ষ্যে কোন শটই নিতে পারেনি পর্তুগাল। ইউরোর ফাইনালে যা দীর্ঘতম সময়ের রেকর্ড।
ইউরোর শেষ ১০ চ্যাম্পিয়ন

সাল স্বাগতিক চ্যাম্পিয়ন রানার্স-আপ
১৯৮৪ ফ্রান্স ফ্রান্স স্পেন
১৯৮৮ পশ্চিম জার্মানি নেদারল্যান্ডস সোভিয়েত ইউনিয়ন
১৯৯২ সুইডেন ডেনমার্ক জার্মানি
১৯৯৬ ইংল্যান্ড জার্মানি চেক প্রজাতন্ত্র
২০০০ বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস ফ্রান্স ইতালি
২০০৪ পর্তুগাল গ্রিস পর্তুগাল
২০০৮ অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড স্পেন জার্মানি
২০১২ পোল্যান্ড ও ইউক্রেন স্পেন ইতালি
২০১৬ ফ্রান্স পর্তুগাল ফ্রান্স

ইউরো ২০১৬ খুচরো
মোট ম্যাচ : ৫১
গোল সংখ্যা : ১০৮ (ম্যাচ প্রতি ২.১২টি)
মোট দর্শক সংখ্যা : ২৪ লক্ষ ২৭ হাজার ৩’শ ৩
গোল্ডেন বুট : অঁতোয়ান গ্রিজম্যান (ফ্রান্স), ৬ গোল (২ অ্যাসিস্ট, ৫৫৫ মিনিট)
সেরা খেলোয়াড় : অঁতোয়ান গ্রিজম্যান (ফ্রান্স)
সেরা দীয়মান খেলোয়াড় : রেনাতো সানসেচ (পর্তুগাল)


ইউরো চ্যাম্পিয়ন্সশিপের টপ স্কোরার
আসর খেলোয়াড় গোল
১৯৮০ ক্লুজ অ্যলোফস (পশ্চিম জার্মানি) ৩
১৯৮৪ মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স) ৯
১৯৮৮ মার্কো ভন বাস্তেন (নেদারল্যান্ডস) ৫
১৯৯২ ডেনিস বার্গকাম্প (নেদারল্যান্ডস), ৩
টমাস ব্রেুালিন (সুইডেন),
হেনরিক লার্সেন ডেনমার্ক), ও
কার্ল-হেলেঞ্জ রিডল(জার্মানি)
১৯৯৬ অ্যালেস শিয়ারার (ইংল্যান্ড) ৫
২০০০ পাত্রিক লুলভার্ট (নদারল্যান্ডস), ৫
সভো মিলোসেভিক (যুগোশ্লোভিয়া)
২০০৪ মিলেন বারোস (চেক প্রজাতন্ত্র) ৫
২০০৮ ডেভিড ভিয়া (স্পেন) ৪
২০১২ ফার্নান্ডো তোরেস (স্পেন) ৩
২০১৬ অঁতোয়ান গ্রিজম্যান (ফ্রান্স) ৬
*শেষ দশ আসর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন