শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

অপরাধ বনাম করোনাভাইরাস : প্রেক্ষিত শর’ঈ নির্দেশনা

মুফতি মোঃ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
গোসল ও কাফন-দাফন:
১। কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ করলে তাকে গোসল দেয়া, কাফন-দাফন করা ফরযে কেফায়া। যে এলাকায় মারা যাবেন সে এলাকার সকল মুসলমানের ওপর এ কাজ ফরয। কিছুসংখ্যক লোক আদায় করলে সকলের ওপর থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। কেউ আদায় না করলে মহল্লার সকল মুসলমানই গুনাহগার হবেন।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বা যে-কোন মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও তার গোসল ও কাফন-দাফন করতে হবে। অন্য কেউ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে একজন মুসলমানের গোসল ও কাফন-দাফন বাদ দেয়া যাবে না। একজন মুসলমান হিসেবে অন্য মুসলমানের ওপর এটি তার আল্লাহ্ ও রাসূল স. নির্দেশিত দ্বীনি হক।
আল্লাহর ওপর ভরসা রাখাটা মুমিন ব্যক্তির কাজ। তবে সতর্কতামূলকভাবে গোসল দানকারী ব্যক্তি হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক, আবৃত পোশাক ও স্যনিটাইজার ব্যবহার করে পানি ঢেলে দিয়ে হলেও গোসল করাতে হবে। এমনিতে তো স্বাভাবিক সময়ে গোসল দেওয়ার সময়ও হাতে কাপড় পেচিয়ে নেওয়াই শরীয়তের বিধান। যেক্ষেত্রে কোন রোগীর দেহে গ্লাভস পরে বা কাপড় দিয়ে হাত দেয়াও সম্ভব না হবে সেক্ষেত্রে পানি ঢেলে যতটুকু সম্ভব সতর্কভাবে কাফন পরিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা মিলে দাফন করতে হবে।
২। “মৃতদের গোসলদান জীবিতদের ওপর ওয়াজিব হক; যা হাদীস ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত” (আলমগীরী: খ-১, পৃ. ১৫৮; মাকতাবা মাজেদিয়া, কোয়েটা, পাকিস্তান, তা. বি.)। সুতরাং তা মুসলমানগণ উপেক্ষা করবে কিভাবে? অবশ্য একবার গোসলদান ওয়াজিব এবং তিনবার তা সুন্নাত। সুতরাং সতর্কতা’র সমস্যা’র কারণে একবার গোসল দিলেও যথেষ্ট হয়ে যাবে।
৩। (ক) “উত্তম হচ্ছে, মৃতের স্বজনরাই তাকে গোসল দেবে” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৫৯)। সুতরাং বিশেষ কোন ভীতির কারণে অন্যেরা এগিয়ে না এলে, স্বজনরাই গোসল, কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে; কিন্তু একেবারে বাদ দেয়া যাবে না।
(খ) “যদি গোসলদানের পূর্বে জানাযা পড়া হয়, এর পর (গোসল ব্যতীতই) দাফন করা হয় সেক্ষেত্রে গোসল দিয়ে পুনঃ জানাযা পড়বে; কেননা প্রথম জানাযা বাতিল হয়ে গেছে” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৬৩)। ফাতাওয়া আলমগীরী’র এ ভাষ্য থেকে গোসলদানের গুরুত্ব কতটুকু তা বোঝা যাচ্ছে।
এ ছাড়া, কোন মৃত ব্যক্তিকে যদি ইসলামী নিয়মে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে কফিনে ভরে আনা হয় এবং কফিন থেকে লাশ বের করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে কফিনসহই জানাযা ও দাফন জায়েয হবে।
৪। লাশ ফুলে বা ফেটে গেলে এবং বিধি মোতাবেক গোসলদান কষ্টকর ও অসম্ভব পর্যায়ে হলে, সেক্ষেত্রে যে-কোনভাবে লাশের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত করে নিলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে” (হাশিয়াতুত-তাহত্বাভী ‘আলা মারাকিউল ফালাহ্: পৃ-৫৬৯-৫৭০; দারুল-কুতুব, দেওবন্দ, ভারত ও ইমদাদুল আহকাম: খ-২, পৃ-৪৪০; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত)। শরীয়া আইনের এ ব্যাখ্যার প্রতি গবেষণা’র দৃষ্টিতে লক্ষ করলে বোঝা যায়, এক্ষেত্রে ফুলে-ফেটে যাওয়ায় হাতে স্পর্শ করা জটিল বিধায়, তা ‘কারণ’ হিসাবে আইনে ছাড় রয়েছে; একইভাবে ‘করোনা’র ক্ষেত্রেও একরকম নিশ্চিত সক্রমণের (সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণের বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা মতে, যদি তা সত্যি হয়) দরুনও ‘মারাত্মক জটিলতা’-কে ছাড়ের ‘কারণ’ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সুতরাং হাতদ্বারা স্পর্শ না করে বিকল্প কোন উপায়ে গোসলের ব্যবস্থা করা যায়; যেখানে অধিক জনবলের পরিবর্তে ১/২জন সদস্য নিজের নিরাপদ উপকরণ (আবৃত পোশাক, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি ব্যবহার করে যেমন কিনা সারা বিশে্বর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ সেভাবেই সেবা ও চিকিৎসা’র দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন)সহ গোসল কাফনের ব্যবস্থা করতে পারেন।
১। “জানাযা’র সালাত আদায় করা ফরযে-কিফায়া” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৬২)।
২। “জানাযা’র সালাত মাঠে-ময়দানে, বাসা-বাড়ীর ভেতরে আদায় করা সমান কথা” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৬৫) -এ থেকে বোঝা যায়, সংক্রমণ ইত্যাদির (মানবিক) ভীতি থাকলে, আলোচ্য ‘করোনা’ ভাইরাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে অধিক উন্মুক্ত পরিস্থিতি’র জন্ম না দিয়ে সংশ্লিষ্ট স্বজন ও আগ্রহীগণ নিজ নিজ বাসা-বাড়ীতেও জানাযা পড়ে দাফনের ব্যবস্থা করতে পারে।
৩। “শায়খ ইমাম আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনুল-ফযল র. সূত্রে আলমগীরীতে বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি আমাদের শহরগুলোর অনুরূপ বালি ও নরম মাটির অঞ্চলে সিন্দুক/বাক্স-ভর্তি করে মৃতকে কবর¯থ করা জায়েয মর্মে অভিমত পেশ করেছেন” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৬৬)। সুতরাং ফাতাওয়া আলমগীরী’র এ আইনী-ব্যাখ্যাকে সামনে রেখে আলোচ্য ক্ষেত্রে সংক্রমণের ভীতি এড়াতে (দূর থেকে বা বাইর থেকে আগত) ওই বাক্সভর্তি অবস্থাতেও তেমন মৃতের দাফনকার্য সম্পন্ন করা যেতে পারে।
৪। একইভাবে ভীতি এড়াতে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কাল-বিলম্ব না করে, রাতের মধ্যেও দাফন করা জায়েয। যেমন- “রাতের বেলায় দাফন করাতেও কোন সমস্যা নেই; অবশ্য দিনের বেলায় তা অধিক সহজ হয় (সেটা ভিন্ন কথা)” (প্রাগুক্ত: পৃ. ১৬৬)। এ ছাড়া, ‘আল-বাহরুর রায়িক: খ-২, পৃ-৩০০; সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম এর ‘জানাযা’ অধ্যায়েও তাড়াতাড়ি গোসল-জানাযা-কাফন-দাফনের নির্দেশনা এমনিতেও প্রদান করা হয়েছে।
মহামারী চলাকালীন পাঠ করার দু‘আ: বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে বহুমুখী রোগ-ব্যাধির নাম উল্লেখসহ রাসূল স. নিজে দু‘আ করতেন এবং উম্মতকেও দু‘আ করতে উৎসাহিত করেছেন। যেমন: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আ‘উযুবিকা মিনাল-বারাছে ওয়াল-জুনূনি ওয়াল-জুযামি ওয়া মিন্ ছাইয়্যিল আছক্বাম’।
অথবা
‘বিছমিল্লাহিল্লাযী লা-ইয়াদুররু মা‘আছমিহি শাইয়ুন ফিল-আরদি ওয়ালা ফিছ্ছামা, ওয়া হুয়াছ্-ছামিউল ‘আলীম’।
অথবা
‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা ছুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায্-যলিমীন’ (সূরা আম্বিয়া: আয়াত নং-৮৭)।
অথবা
এ ছাড়াও, মহামারী ও রোগযন্ত্রণা দূর হওয়ার লক্ষ্যে মহানবী স. নিম্নােক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন মর্মে ইমাম বুখারী র. উদ্ধৃত করেছেন-
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী স. দু‘আ করতেন: “হে আল্লাহ্! আপনি যেভাবে মক্কাকে আমাদের জন্য প্রিয় করে দিয়েছেন, মদীনাকেও সেভাবে অথবা এর চাইতেও অধিক আমাদের কাছে প্রিয় করে দিন। আর মদীনা’র মহামারী (কালা) জ্বর ‘জুহফা’ নামক স্থানের দিকে সরিয়ে দিন” (প্রাগুক্ত: সহীহ বুখারী: খ-১০, পৃ. ৫৮৩; এবং খ-৩, পৃ. ২৩২-২৩৩)।
অথবা
এছাড়া, ওলী-আউলিয়াগণের নির্দেশনা মোতাবেক বেশী বেশী ‘দুরূদে নারিয়া’ও পাঠ করা যেতে পারে।
মহান আল্লাহ্ আমাদের উক্তরূপ ব্যাপক ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারীর প্রকৃত কারণ বোঝার তাওফীক দিন এবং শরীয়ত নির্দেশিত আন্তরিক তাওবা-ইস্তেগফার, সাবধান ও সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণের সৌভাগ্য দান করুন। আমীন!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন