করোনার কার্যকর চিকিৎসা : চীন ইতালি জাপান ইরান আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে সফল প্রয়োগ : কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই
করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় আশা জাগাচ্ছে প্লাজমা থেরাপি। প্লাজমা থেরাপি হচ্ছে একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। যেখানে করোনা থেকে সেরে ওঠা মানুষের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হবে। এরপর তার শরীরে এন্টিবডি কাজ করলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ভারতের ন্যায় বাংলাদেশেও প্লাজমা থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন তরুণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নানামুখী আবেদন-নিবেদনের পর বিষয়টি আমলে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
হেমাটোলজিস্টরা (রক্তবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ) বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার আগে এই ভাইরাস থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে প্লাজমা থেরাপি। এর মাধ্যমে অতিদ্রæত মানুষের শরীরে পরোক্ষ ইমিউন সিস্টেম তৈরি হয়, যা ভাইরাস কিংবা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসিএইচ) হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএ খানকে সভাপতি করে গত রোববার ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কমিটির সদস্যরা হলেন, বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সী, ডিএমসিএইচের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির এবং ডিএমসিএইচের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মাজহারুল হক তপন। কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সিরাম প্রয়োগের জন্য প্রটোকল প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে কমিটি একাধিক সদস্যকে সংযুক্ত করতে পারবে।
এর আগে প্লাজমা থেরাপি নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে দেশের তরুণ চিকিৎসকদের একটি গ্রæপ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা অব্যাহত রাখে। ই-মেইল এবং মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন তারা। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ শুরু হলেও বাংলাদেশ এখনও প্রস্তুত নয়। তবে সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এই চিকিৎসা পদ্ধতি ইতোমধ্যে শুরু করেছে ভারত, চীন ও জাপান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসকরা চাইলেও এখনই করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি শুরু করতে পারছেন না। কারণ, এ ক্ষেত্রে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের রক্ত প্রয়োজন। সরকারের হাতে রয়েছে সুস্থদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা। তাই প্রথমেই তালিকা ধরে তাদের রক্তদানে উৎসাহিত করার কাজটি সরকারকেই করতে হবে। আর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগে সফলতা পাওয়া গেলে কারোনা আতঙ্ক অনেকটাই কেটে যাবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. এম এ খান বলেন, মার্কিন ও চীনের গবেষণা এবং অন্যান্য গবেষণাগুলোতেও দেখা গেছে যে, যারা কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের প্রত্যেকেরই রক্তে প্লাজমায় এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে। যদি ভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির শরীরে নিষ্ক্রিয় এন্টিবডি সক্রিয় করে তোলা যায় তাহলে এই এন্টিবডিই ভাইরাসকে ধ্বংস করে দেবে। এর ফলে, রোগীর ভাইরাল লোড, জ্বর এবং ফুসফুসের প্রদাহ পরীক্ষা করা হয়। সুতরাং তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তিনি বলেন, কনভ্যালেসেন্ট প্লাজমার পরিব্যাপ্তিতে থাকা নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি গবেষণামূলক ট্রিটমেন্টে ব্যবহার করা হয় রোগীর শরীরে পরোক্ষ ইমিউনিটি গড়ে তুলতে, যাতে ভাইরাস আর কাউকে আক্রান্ত হরতে না পারে। এই হেমাটোলজিস্ট বলেন, এখনো যেহেতু কোভিড-১৯ এর কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি, এছাড়া যেসব ঔষধ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে তা বাজারজাত হতে আরও বেশ কিছু সময় লেগে যাবে। এজন্য মানুষের জীবন বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই নতুন থেরাপির পরীক্ষামূলক ব্যবহার সফলভাবেই কাজে লাগিয়েছে।
প্রফেসর ডা. খান বলেন, প্রাথমিকভাবে যেসব বয়স্ক মানুষ এবং চিকিৎসাকর্মী ভীষণ অসুস্থ রয়েছেন তাদেরকে এই থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হবে। কারণ যদি চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে রোগীদের সেবা কারা করবে? কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে যারা গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন তাদের চেয়ে যারা প্রাথমিক স্তরে রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি অনেক বেশি কাজ করে। কারণ প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে ভাইরাসটি থাকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র অবস্থায়। প্লাজমা থেরাপির নির্ভুল ব্যবহারের জন্য এবং প্রশিক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিভিন্ন স্টেটে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হচ্ছে।
এর আগে প্লাজমা থেরাপির কার্যকরী ব্যবহার করা হয়েছিল এইচ১এন১ ( স্পেনিশ ভাইরাস), ইবোলা, সার্স-১ এবং মার্স ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য। তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি, অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিট যদি এটি অনুমোদন দেয় তাহলে আমাদের একটি প্রটোকল তৈরি করতে এবং এবং তারপর থেরাপির পরীক্ষামূলক ব্যবহারে যেতে হবে। প্রটোকল মানে হচ্ছে- আমরা কিভাবে প্লাজমা সংগ্রহ করবো, সংরক্ষণ করার পদ্ধতি কি হবে, যারা প্লাজমা দান করবেন তাদের শরীরে থাকা প্লাজমার লেভেল কিভাবে পরিমাপ করবো। এছাড়া থেরাপির ফলে কি রেজাল্ট আসতে পারে এসব বিষয়।
তিনি বলেন, অনেক রোগীই প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠছেন, ফলে বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এজন্য যারা ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন তাদের ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে এবং তাদের থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করতে হবে। প্রটোকল মেনেই তাদের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, প্লাজমা সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোন আইনি বাধা নেই। এটা অনেক বেশি নিরাপদ একটি পদ্ধতি, যেমন- মানুষ যেভাবে রক্তদান করে এটিও সেই একই ধরনের। ১৮-৬০ বছর বয়সী যে কোন ব্যক্তি যার ওজন সর্বনি¤œ ৫০ কেজি এবং যিনি হেপাটাইটিস (এইচবিভি), এইচসিবি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত নন এমন যেকোন ব্যক্তিই প্লাজমা দান করতে পারেন। মানুষের উচিত হবে প্লাজমা দান করার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করা। আমাদের তাই করা উচিত আমাদের কাছে মানুষের জীবন বাঁচাতে যতটুকু সুযোগ আছে তার সদ্ব্যবহার করা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট প্রসেসর ডা. নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, এই পদ্ধতিতে সুরক্ষা পাওয়ার প্রমাণ আছে। এর ব্যাপারে আমরাও আশাবাদী। পদ্ধতিটি প্রয়োগ নিয়ে দেশেও আলোচনা হয়েছে।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসায় সরাসরি নিয়োজিত আছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ খালেদ মো. ইকবাল। তিনি বলেন, করোনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত শতভাগ নিশ্চিত কোনো চিকিৎসা নেই। ভারতে করোনা রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে সুফল মিলেছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি ভারতের চিকিৎসকদের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছে। প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে সংকটাপন্ন কয়েকশ’ রোগীকে সুস্থ করে তোলার কথা বলছে চীন। যারা সংকটাপন্ন তাদের ওপর প্লাজমা থেরাপি দিলে তাদেরও জীবন বাঁচানো সম্ভব।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুস্থ হয়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কারণে কারোনায় আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে যেসব চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তারাও নিজেদের শরীরে প্লাজমা থেরাপি শুরু করতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে ধানমÐিতে নিজের বাসায় আইসোলেশনে থাকা করোনা আক্রান্ত এক চিকিৎসক। তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে তিনি করোনা সংক্রমিত হন। ওই চিকিৎসক বলেন, তার মধ্যে করোনার মৃদু সংক্রমণ রয়েছে। তিনি মনোবল হারাননি। শুকনো কাশি ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই। তারপরও তিনি এখনই প্লাজমা থেরাপি নিতে চান। চিকিৎসক বলেন, আমি পারলে আজই এন্টিবডি প্লাজমা নিতে চাই। কারণ, এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যদি এন্টিবডি কাজ করে, তবে দ্রæত সুস্থ হয়ে উঠব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি থাকায় এখানে মৃত্যুর উচ্চহার সহজেই ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু যদি রোগ লুকানোর চেষ্টা করা হয়, তবে রোগী নিজে মরলেন, পরিবারের সদস্যদেরও ঝুঁকিতে ফেললেন। আবার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসককেও সংক্রমিত করে দিলেন। এটা হল আত্মহত্যার শামিল। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, গ্রিন লাইফ, ইউনাইটেড, বারাকাহ কিডনি হাসপাতালসহ যেখানেই চিকিৎসক-নার্সরা সংক্রমিত হয়েছেন, তা হয়েছে রোগী তথ্য গোপন করার কারণে। সংক্রমিত চিকিৎসক থেকে হাসপাতালের অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই করোনায় তথ্য গোপন করা আত্মঘাতী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় বিশ্বব্যাপী প্লাজমা থেরাপি একটি অন্যতম সফল চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরাও এটি ব্যবহার করতে পারি। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত যেসব রোগী ভালো হয়ে আসবেন এবং যাদের মধ্যে কোভিড-১৯ এন্টিবডি তৈরি হয়েছে তাদের থেকে বøাড নিয়ে প্লাজমা বের করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের শরীরে ব্যবহার করে আমরা সাফল্য পেতে পারি। তবে এক্ষেত্রে আমাদের যেসব রোগী ভালো হয়ে আসবেন তাদের কিছুটা মানবিক হতে হবে। নিজে ভালো হওয়ার পরে অন্য রোগীদের সেবায় রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ আমরা অনেক সময়ই সচেতনতার অভাবে রক্ত দিতে চাইনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. এ বি এম ইউনুস ইনকিলাবকে বলেন, করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এখনো কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। করোনার চিকিৎসায় বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। প্লাজমা থেরাপি সেরকম একটি। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পূর্বে করোনার চিকিৎসায় বাংলাদেশেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে চীন, ইতালি ইরান, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এর সফল প্রয়োগ হয়েছে। আমেরিকার এফডিএ প্লাজমা থেরাপিকে জরুরিভাবে করোনার চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। আরও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এফডিএ পুরোপুরি অনুমোদন দিতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন