শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির জানাজা ও দাফন : ইসলামের নির্দেশনা

মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫২ পিএম

করোনা ভাইরাস আজ পৃথিবীব্যাপী এক আতঙ্কের নাম। বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সবকিছু থমকে দাড়িয়েছে। এই প্রথম তামাম দুনিয়ার মানুষ হোম কোয়ারান্টাইনে থেকে নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কি এক ভয়াবহ আতঙ্কিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বিশ্ব জাহানের তামাম বনি আদম। একবিংশ শতাব্দীর মানুষের ভোগবাদী আর বস্তুবাদী চেতনায় অর্থনৈতিক সুবিধালাভের মানসিকতায় আত্মকেন্দ্রীক কর্মপ্রবাহ তাকে জঘন্য স্বার্থপরতার আকরে বন্ধি করে তোলে। রাজা থেকে প্রজা- যে যেখানে ক্ষমতাবান সে সেখানে নিয়মকে অনিয়মে, শৃঙ্খলাকে বিশৃঙ্খলায় রুপদান করে থাকে। মানবতা, মানবিকতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞার পরিবর্তন দেখে হতাশ হয় ভোক্তভোগী আমজনতা। সবকিছু নিজের সুবিধা ও স্বার্থকে কেন্দ্র করে ঘটে থাকে। কিন্তু সব শক্তিমান লোকের উপরও মহা পরাক্রমশালী এক সত্ত্বা রয়েছেন যার নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় পরিচালিত হয় এই বিশ্বজাহান। আজকের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মানুষের সীমাদ্ধতার প্রকাশ ও স্রষ্টার একচ্ছত্র ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের এই মর্মে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালার ফয়সালার বাহিরে কিছু হবে না। জন্ম- মৃত্যু সব কিছু নির্ধারিত রয়েছে তাঁর দফতরে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘প্রত্যেক জাতির জন্য নির্দিষ্ট সময় আছে, অতঃপর যখন তাদের সময় অসবে তখন মুহুর্তকাল দেরি করতে পারবে না এবং এগিয়ে আনতেও পারবে না।’ [৭:৩৪] যার যখন মৃত্যু আসবে, তখন তাকে জগত ছাড়তে হবে- এই মানসিকতায় চলমান পরিস্থিতিতে মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু হিসেবে কামনা করতে হবে। রাসূল সা. এর হাদীসে এসেছে, ঈমানদার মৃত্যুবরণ করলে তিনি শহিদী মর্যাদা পাবেন। এমনকি শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের হাদীসে বর্ণিত সাতটি মানদন্ডের দ্বিতীয়টি হলো- যারা মহামারিতে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করে, তারাও শহীদ। রাসূল সা. কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন যে- ‘এটি আযাব; মহান আল্লাহ যার প্রতি ইচ্ছা করেন এটা প্রেরণ করেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা একে মুমিনের জন্য রহমত বানিয়ে দিলেন। ফলে (এখন) যে ব্যক্তি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হবে এবং সে নিজে দেশে ধৈর্য সহকারে অবস্থান করবে, সে জানবে যে, তাকে তাই পৌঁছবে যা আল্লাহ তায়ালা তার জন্য লেখে দিয়েছেন। তাহলে সেই ব্যক্তির জন্য শহীদের মত পুরুষ্কার রয়েছে।’ [বুখারী- ৩৪৭৪] এই হাদীসে মহামারিতে মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যে তিনটি শর্ত রয়েছে তা হলো- ঈমানদার ধৈর্য সহকারে মহামারি আক্রান্ত এলাকায় থাকবে। সে আল্লাহর নেয়ামতের আশায় অবস্থান করবে। সে যখন বিশ্বাস করবে আল্লাহর পক্ষ থেকে যাবতীয় তাকদীর নির্ধারিত হয়।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে অনবদ্য ও অনিবার্য ঘটনা হলো মৃত্যু। কোন পরিস্থিতিতে, কোন জায়গায়, কখন ও কিভাবে মৃত্যু হবে তা পরিপূর্ণভাবে অনিশ্চিত। আলকুরআনের বাণী হলো- ‘প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যু স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ [২৯:৫৭;৩:১৮৫;২১:৩৫] মৃত ব্যক্তির জানাযার নামাজ ও দাফনে ‘ফরজে কেফায়া’ হিসেবে সাধারণ মুসলিমগণ সাধ্যমতো স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ গ্রহণ করে থাকে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন নিয়ে আমাদের দেশে বিতর্ক তৈরী হয়েছে। এ জাতীয় মৃত দেহ ভাইরাসের খনি। রোগটিও ছোঁয়াচে হওয়ায় নিজের পরিবারের সদস্যগণও সালাতে জানাজা ও লাশ দাফনে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। ইতোমধ্যে কেউ কেউ লাশটি পুড়িয়ে ফেলার দাবী তুলেছেন। এটা অযৌক্তিক ও অন্যায় না কেবল বরং লাশের সাথে বেয়াদবী; যা ধৃষ্টতা প্রদর্শনের শামিল। হাদীস থেকে জানা যায় মৃত লাশের তা’যিম বা সম্মান করা জীবিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব। সেখানে কোনো মুসলিম ব্যক্তির লাশ পোড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। যে বা যারা এ বাগাড়াম্বর ও হঠকারী দাবী বাব ক্তব্য রাখেন তাদের সাথে অন্তত: ইসলামী চিন্তা-চেতনা নাই বলা যায়। করোনা বা কোনো দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে মৃত ব্যক্তির লাশের ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যেমন একটি দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে; তেমনিভাবে ইসলামে আইন তথা ইলমে ফিকহেরও একটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। দুটির মাঝে সমন্বয় সাধন করে আক্রান্ত ব্যক্তির জানাজা এবং পরবর্তী দাফন কাজ সম্পন্নই শুধু নয়; বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করতে হয়। এ জন্যই ইসলামে গবেষণা বা ইজতিহাদকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যদি মৃত দেহটি সমস্যাযুক্ত হয় এবং গোসল দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে ইলমে ফিকহ, চিৎিসা বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের আইনকে বিবেচনায় নিয়ে এর সমাধান করতে হবে। যেহেতু করোনা একটি সংক্রামক ব্যাধি, তাই সবধরনের ব্যবস্থা করেই আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করতে হবে। সংক্রামক রোগের ধারণাকে অস্বীকার করে মালয়েশিয়া ও ফিলিস্তিনসহ কিছু ধর্মীয় সমাবেশ হওয়ার প্রেক্ষিতে এ রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। আবেগী কিছু মানুষ অবিদ্যার কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে কথা বলে। সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামকে পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশের যে গতিময়তা সে হিসেবে সমকালিন ইলমে ফিকহ-র গবেষণা ও বিকাশও দরকার। আমাদের দেশে উচ্চ লেভেলে বিভিন্ন কারনে তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম আইন বিশারদগণ এ গবেষণা চালাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে এ দুইটি বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই একজন মুমিন-মুসলিম তার ব্যবহারিক জীবনকে সঠিকভাবে চালাতে পারে।
আমরা জানি আদম আ. থেকে এ পর্যন্ত যত নবী রাসূল এবং তাদের উত্তরসূরী মারা গেছেন সকলকে মাটিতে কবর দেওয়া হয়েছে। এটাই ইসলামের হাজার বছরের অনবদ্য ও শাশ্বত নিয়ম। মানুষ মারা গেলে এ গোসল দেওয়া ওয়াজিব। কারণ রাসূল সা. সবসময় মৃতদেহকে গোসল করানোর জন্য আদেশ করেছেন। পানি নিয়ে, তাতে বিশেষ কিছু গাছের পাতা দিয়ে গোসল করাতে হয়। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন