মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান প্রদান করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। ইসলাম যেমন কাউকে অবজ্ঞা করে না, তেমনি মানুষের ব্যাপক কর্মকা-ে কোনটিকে উপেক্ষাও করে না। বস্তুতপক্ষে মানুষের বহুমুখী কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই এর উদ্দেশ্য। তার সকল প্রকার আচার-আচরণ মূলত দেহ ও আত্মাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধ অনুসারে জীবন পরিচালিত হলেই জাগতিক কাজ-কর্মগুলো ইবাদতের মূল্য পায় এবং নৈতিক চরিত্র উন্নত ও পবিত্র হয়। অনুরূপভাবে আমরা যেগুলোকে আধ্যাত্মিক সাধনা বলি সেগুলোর মধ্যেও নিহিত রয়েছে বস্তুগত সুবিধা। আধ্যাত্মিক অথবা জাগতিক কাজের নিয়ম-নীতিগুলো উৎসারিত হয়েছে একটি অভিন্ন উৎস থেকে এবং তা’হল কুরআন মজীদ। কুরআন মজীদ আল্লাহর কালাম।
আধ্যাত্মিক এবং জাগতিকÑ এ দুটো ধারার পরিপূর্ণ এবং অপরিহার্য বিকাশ ঘটেছে ইমাম শব্দটির মধ্য দিয়ে। ইসলামী পরিভাষায় ইমাম (মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক) বলতে কেবল মাত্র মসজিদের অভ্যন্তরে নামাযের ইমামতি বুঝায় না। বরং তিনি মুসলিম রাষ্ট্রেরও নেতা।
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান সম্পর্কে রাসূল করীম (সা.) যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, হাদীস শরীফে তার বিবরণ রয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বাস, ইসলাম অর্থ আনুগত্য এবং ইহসান অর্থ উত্তম পন্থা। আলোচ্য বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যার শুরুতে নবী করীম (সা.)-এর একটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটিঃ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, হযরত মুহম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূলÑ এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, সালাত (নামায) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, বায়তুল্লাহর হজ্জ করা এবং মাহে রমযানে রোযা রাখা (বোখারী ও মুসলিম)।
রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন যে, সালাত হল দীনের স্তম্ভ। কুরআন মজীদে একশতেরও বেশি জায়গায় সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে। এবং বিভিন্ন স্থানে সালাতের বিভিন্ন নামকরণও করা হয়েছে। যেমনÑদু’আ, যিকর, তাসবিহ, ইনাবাহ।
দৈনিক ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের হুকুম রয়েছে। দুনিয়ার বুকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করাই এর উদ্দেশ্য। এখানে একজনকে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং সালাত আদায় করতে হয়। তাকে সালাত আদায় করতে হয় বিকালের প্রথম ভাগে, শেষ বিকালে, সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং রাতে বিছানায় যাওয়ার পূর্বক্ষণে। প্রতি ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে কয়েক মিনিট সময়ের দরকার হয়। এ সময়ে নিজেকে যাবতীয় স্বার্থাদির চিন্তা থেকে বিরত রেখে একাগ্র চিত্তে আল্লাহর দিকে গভীর মনোনিবেশ করতে হয়। তাকে সালাত আদায় করতে হয় স্রষ্ট আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নজীর হিসাবে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নর ও নারীর জন্য সালাত আদায় করা ফরয বা অবশ্য কর্তব্য।
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার যোহরের সালাতের স্থলে জুমার সালাত মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে আদায় করতে হয়। সাপ্তাহিক এই সমাবেশে অত্যন্ত ভাবগম্ভীরতার সঙ্গে সালাত আদায় করা হয়Ñ সালাতের পূর্বে স্থানীয় ইমাম খুৎবা (ভাষণ) দেন। ইসলামে বছরে দুটি আনন্দ-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। একটি অনুষ্ঠিত হয় মাহে রমযানুল মুবারক শেষে, অপরটি হজের মৌসুমে। আনন্দ-উৎসব দু’টি আবার বিশেষ সালাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। এই আনন্দ-উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা নামে পরিচিত। ঈদের সালাত নিত্যদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অতিরিক্ত। ঈদের সালাত ওয়াজিব। ছয় তকবিরের সঙ্গে এ সালাত আদায় করা হয়। এ সালাত সমবেতভাবে আদায় করতে হয়। এ উদ্দেশ্যে খুব সকাল থেকেই লোকেরা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হতে শুরু করে এবং ইমাম তাদের উদ্দেশ্যে খুৎবা (ভাষণ) দেন। মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার জন্য যে সালাত আদায় করা হয় তাকে জানাযার সালাত বলে। জানাযার সালাত ফরযে কিফায়া।
সালাতের অন্তর্নিহিত অর্থ এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আলোচনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত সুফী শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী (রঃ) বলেছেন যে, স্মরণ রাখবেন, কখনো কখনো মানুষ খারাতুল কুদস বা পবিত্র মঞ্জিল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন সে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভ করে। তার উপর অবতীর্ণ হয় পবিত্র জ্যোতি (তাজাল্লী)। সে নফসের উপর বিজয়ী হয় এবং এমন সব জিনিস অবলোকন করতে থাকে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আবার যখনই তার উপর থেকে সেই পবিত্র জ্যোতি সরে যায় তখনই সে ফিরে আসে পূর্বাবস্থায়। ফলে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় অদ্ভুত রকমের এক অস্থিরতা ও অস্বস্তি। অবশেষে সে বাধ্য হয়ে এ নিম্ন অবস্থাকে মেনে নেয়। তখন সে আল্লাহর ইশকে মাতওয়ারা হয়ে হারানো অবস্থা ফিরে যেতে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। আসলে এটা হল কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে আবেদন-নিবেদন ও কাকুতি-মিনতি করার নামান্তর মাত্র। সালাতের তিনটি মৌলিক বিষয় রয়েছে ঃ
১। আল্লাহর মহিমা ও কুদরতের কথা মনে রেখে একাগ্রচিত্তে তাকে হাজির-নাজির জানা।
২। বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা এবং উপযুক্ত শব্দে নিজের বিনম্রতা প্রকাশ করা। যেমন কারো প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াই। তাঁর দিকে মুখ ফিরাই এবং তাঁর প্রতি পূর্ণ মাত্রায় মনোনিবেশ করি। কিন্তু যখন পরম শ্রদ্ধা সহকারে রুকুতে বা সিজদা করে তখন সেটা হয় আরো বড় ধরনের সম্মান প্রদর্শন।
৩। এই বিনম্রতাকে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যথাযথ সুনির্দিষ্ট ভঙ্গিমার মাধ্যমে স্থাপন করা এবং ভয় ও শ্রদ্ধায় অবণত হওয়া। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, মুখম-ল হল আমাদের শ্রেষ্ঠতম অঙ্গ। আমাদের আমিত্ব এবং আত্ম-সচেতনতার প্রকাশ ঘটে এই মুখম-লের মধ্য দিয়ে। সেই মুখম-লকে যখন আমরা নত করি, এমন পর্যায়ে নিয়ে আসি যা সম্মানিত বিষয়ের সম্মুখে ভূমিকে স্পর্শ করে তখন যে সম্মানের প্রকাশ ঘটে তা তুলনাহীন। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলাকে মানুষ এভাবে স্মরণ করবে যাতে সে আলোকিত হবে পবিত্র জ্যোতিতে। এভাবেই সে হৃদয় দিয়ে আল্লাহর মহত্ত্বকে অনুধাবন করতে পারে। তার মধ্যে ফুটে ওঠে বিনয় নম্র ভাব। বস্তুতপক্ষে এটাই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মানব জীবনের একমাত্র সাধনা। মানুষ কেবলমাত্র ক্রমাগত সাধনার মাধ্যমে এই উন্নতর পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। এ ধরনের আরোহণ কেবলমাত্র সম্মান সহকারে সোজা হয়ে দাঁড়ান, নত হওয়া এবং সিজদার মাধ্যমে হতে পারে এবং সর্বোত্তম ইবাদত সেটাই যার মধ্যেএ তিনটি কাজ বিরাজমান রয়েছে। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রঃ), প্রথম খ-, সালাতের রহস্য)।
কুরআন মজীদে বলা হয়েছে যে, “তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশ ম-লীতে ও পৃথিবীতে, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্র ম-লী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং সিজদা করে মানুষের মধ্যে অনেকে (২২ ঃ ১৮)। আরো বলা হয়েছে যে, “সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না (১৭ ঃ ৪৪)।
সমস্ত সৃষ্টিরাজির ইবাদত-বন্দেগীর একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে। এ সব কিছুরই সমন্বয় ঘটেছে সালাতের মধ্যে। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র নিয়মিত উদয় হয়, অস্ত যায়। এ যেন সালাতের এক রাকাতের পর আরেক রাকাত আদায় করার অনুরূপ। পাহাড় পবর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সালাতের শুরুতে মু’মিন-মুসলমানদেরও ঠিক এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পশু-পাখিরা বশ্যতা স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে নত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে সালাতের রুকুর। বৃক্ষরাজিকে আমরা মূলের সাহায্যে মাটি থেকে খাদ্য খাবার সংগ্রহ করতে দেখতে পাই। মূল হল তার মুখ। অন্য কথায় চির অসহায়ের মতো গাছপালা যেন চিরদিনের জন্য ভূতলশায়ী হয়ে রয়েছে। এর সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে সিজদার।
তাছাড়া, কুরআনের বর্ণনা অনুসারে পানির একটি প্রধান কাজ হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। ইবাদত-বন্দেগীর শুরুতে যে ওযু করা হয় তার সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে। কুরআনে বলা হয়েছে যে, “বজ্র নির্ঘোষ ও ফেরেশতাগণ উভয়ে তাঁর প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে (১৩ঃ১৩)। সালাতেও এ আয়াতটির অনুসরণ ঘটে। সালাতের সময়ও আমরা উচ্চ স্বরে আল্লাহু আকবর উচ্চারণ করি। সালাতে কখনো উচ্চ স্বরে, কখনো আবার নিম্ন স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করলেও আমাদেরকে সব সময়ই আওয়াজ করে আল্লাহু আকবর বলতে হয়। পাভিরা ঝাঁক বেঁধে আকাশে উড়ে আল্লাহর যিকর করে। অনুরূপভাবে মুসলমানরা ও সমবেতভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকে। প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন সময়ে কখনো ছায়া প্রসারিত হয়, কখনো আবার সংকুচিত হয়ে আসে। এটাও মূলত আল্লাহর প্রতি আনুত্য প্রকাশ ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার একটা ধরন। সারাতের মধ্যে আমরা এর প্রকাশ দেখতে পাই। যেমন আমরা সালাত আদায় করতে গিয়ে কিয়াম (দাঁড়ান), রুকু এবং সিজদার মাধ্যমে কখনো নিজেকে প্রসারিত করি আবার সংকুচিত করি। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর যিকর-আয্কারকে ‘ইবাদত’ বলে। ইবাদতের মূল শব্দ ‘আবদ। এর অর্থ দাস। অন্য কথায় বলা যেতে পারে যে, মনিবের প্রত্যাশা অনুসারে চাকর যা করে সেটাই হল ইবাদত। স্রষ্টার দাবি এই যে, পাহাড়-পর্বত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, পশু-পাশিরা নত হয়ে থাকবে, বৃক্ষরাজি থাকবে ভূতলশায়ী হয়ে। আর এটাই হল তাদের আনুগত্য ও যিক্র-আযকার। যে ধরনের যিকর-আযকার একজনের জন্য উপযুক্ত আল্লাহ তা’আলা তার নিকট থেকে সেটাই প্রত্যাশা করেন। অনুরূপভাবে সৃষ্টির সেরা প্রাণী, জগতের মধ্যে সর্বাধিক বিবেকবান এবং ধরা বুকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের জন্য যে ধরনের ইবাদত-বন্দেগী প্রযোজ্য আল্লাহ তার নিকট সেটাই প্রত্যাশা করেন।
ওযু ও শারীরিক পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে একজন পবিত্রতা অর্জন করে। আর পবিত্রতা হল সালাত বিশুদ্ধ ও বৈধ হওয়ার পূর্বশর্ত। হাদীস গ্রন্থেও ওযু ও গোসলের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক বর্ণনা রয়েছে। পবিত্রতা অর্জন করার জন্য একজনকে হাত, মুখ, নাক, পা ও মাথা ধৌত করতে হয়। এখানে ওযু অর্থে কেবলমাত্র বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা বুঝায় না। বরং এটা ব্যবহৃত হয়েছে অতীতের জন্য অনুশোচনা এবং আগামীতে ন্যায়নিষ্ঠভাবে চলার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে। অনুশোচনা অতীতের পাপরাশিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। অপরদিকে ন্যায়নিষ্ঠভাবে চলার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তা’আলার রহমত লাভের আশা করি। প্রধানত যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হই, ওযুর সঙ্গে তার সংযোগ রয়েছে বেশি। হাত দিয়ে আমরা আঘাত বা আক্রমণ করি ও কোন কিছু গ্রহণ করি। মুখ দিয়ে কথা বলি। নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেই। মুখম-লের সাহায্যে কখনো আমরা একজনকে অবজ্ঞা করি, কখনো আবার কাউকে প্রভাবিত বা চাপ দেয়ার জন্য উদ্যোগী হই। মাথা দিয়ে চিন্তা করি, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হই। কান দিয়ে শুনি। যে পথে চলতে আল্লাহ বারণ করেছেন পা দিয়েই আমরা সে দিকে অগ্রসর হই। ওযুর নিয়ত করতে গিয়ে প্রথমেই একজনকে বলতে হয় যে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি পানিকে পরিষ্কার এবং পরিষ্কারক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। মুখম-ল ধোয়ার সময় সে আল্লাহর কাছে এ মুনাজাত করে যে, শেষ বিচার দিবসে আমার মুখম-লকে উজ্জ্বল করিও এবং কালিমা লিপ্ত রেখো না। হাত ধোয়ার সময় বলে, আমাকে ভাল কাজে নিয়োগ কর, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখ, রোজকিয়ামতের দিনে বাম হাতের পরিবর্তে ডান হাতে আমলনামা দান কর, হিসাব-নিকাশকে সহজতর করে দাও। মাথা মাছেহ করার সময় বলে আমাকে ইলম শিক্ষা দাও। কান ধোয়ার সময় বলে, আমাকে তোমার এবং তোমার রাসূলের বাণী শ্রবণ করার তৌফিক দাও। পা ধোয়ার সময় বলে জাহান্নামের উপর দিয়ে পুলসিরাত অতিক্রম করার সময় পাপীষ্ঠরা পা ফসকে জাহান্নামে নিপতিত হবে। আর তোমার প্রিয় বান্দাদের পদযুগল থাকবে অতি দৃঢ়। হে আল্লাহ, সে দিন পা ফসকে আমার যেন পতন না ঘটে এবং আমার পদযুগলকেও দৃঢ় রেখো।
রাসূলে করীম (সা.)-এর মি’রাজের সময় মুসলমানদের জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়। রাসূলে করীম (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন যে, একজন ঈমানদারের জন্য সালাত হল তাঁর মি’রাজ। সালাতের মাধ্যমে সে পৌঁছে যায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যে।
এগুলো কোন অর্থহীন বক্তব্য নয়। বরং সালাতের সময় একজন মুসলমান যেভাবে আচরণ করে তার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে এর সত্যতা। প্রথম সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, হাত উঠিয়ে ইহরাম বাঁধে এবং স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা দেয় যে, “আল্লাহু আকবারÑআল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ মহান। আল্লাহ ব্যতীত অন্য সমস্ত সত্তাকে সে অস্বীকার করে, এবং মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে সর্বোতভাবে আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহর হামদ বা মহিমা ঘোষণা করার পর সে খুবই বিনম্র বোধ করে। তখন সে আল্লাহর আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ তার সামনে মাথা নত করে এবং বলে সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম, “আমার মহান প্রভু, পবিত্র”। অতঃপর সে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং সত্য পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানায়। আল্লাহর মহত্ত্ব তার অন্তরকে এমনভাবে আলোড়িত করে যে, সে আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করার তীব্র তাগিদ অনুভব করে। এক সময়ে পরিপূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে ভূমিতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, সুবহানা রাব্বিয়াল আলাÑ“আমার শ্রেষ্ঠতম প্রভু পবিত্র”। বার বার সে এগুলো পুনরাবৃত্তি করে এবং এভাব তার দেহ আধ্যাত্মিক সাধনার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে সে অর্জন করে পার্থিব জগতের বেড়াজাল থেকে উত্তরণের যোগ্যতা। এক সময় সে আসমানী পরিম-ল অতিক্রম করে চলে যায় আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যে। সেখানে সে আল্লাহর মহান দরবারে অভিবাদন পেশ করে এবং তার জবাবও পেয়ে যায়।
বস্তুতপক্ষে এ স্তরে উপনীত হওয়ার জন্য সে এমন নীতি ও পন্থা অনুসরণ করে যেগুলো মি’রাজের সময়ে রাসূল (সা.)-এর অনুসৃত নীতি ও পন্থারই অনুরূপ। এ সময়ে সে বিনয় নম্রভাবে বলে যে, “সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর জন্য। হে নবী, তোমার উপর বর্ষিত হোক আল্লারহ শান্তি, নেমে আসুক আল্লাহর দয়া ও বরকত। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের এবং আল্লাহর সমস্ত নেক বান্দার উপর।” এটাকে বলা যেতে পারে একজন মু’মিনের রূহানী সফর। এ সফরের লক্ষ্য হল আল্লাহর সান্নিধ্য প্রাপ্তি। এখানে তাকে জড় পদার্থের কোনো প্রতীক ব্যবহার করতে হয় না। এটাই হল সালাতের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। জাগতিকভাবেও সালাতের অসংখ্য গুরুত্ব রয়েছে। যেমন, সালাত আদায় উপলক্ষে মহল্লার অধিবাসীরা দৈনিক পাঁচবার সমবেত হয়। পেশাগত জীবনে অবিরত কাজ করে যাওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে এক ঘেয়েমী বা বিরক্তির ভাব আসে। সালাত মিনিট কয়েকের জন্য হলেও তাতে স্বস্তি জোগায়। একটি লোকালয়ের ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, সবাইকে পূর্ণ সমতায় একটি স্থানে (মসজিদ) সংঘবদ্ধ করে। লোকালয়ের যিনি বুযুর্গ তিনি স্থানীয় মসজিদে সালাতের নেতৃত্ব দেন। আবার রাষ্ট্রের যিনি প্রধান, তিনি সালাতের ইমামতি করেন রাজধানীর কেন্দ্রীয় মসজিদে। মসজিদে বসে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে সর্ব সাধারণের সাক্ষাৎ মেলে। কোন রকম বাধা-প্রতিবন্ধকতা বা আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন