সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইসলামের সার্বিক চেতনাকে সঞ্জীবিত করার মাস রমজান

আবদুল লতিফ নেজামী | প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর সঙ্কটকালে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অশেষ সওগাত নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান এবার আমাদের দ্বারে সমাগত। মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়ার সমৃদ্ধি, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, দৈহিক ও মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব আর গৌরব এবং মর্যাদার অবিস্মরণীয় স্মৃতি নিয়ে প্রতি বছরই আসে পবিত্র মাহে রমজান। তাই ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, মানবতাবোধ, মহত্ত্ব ও ন্যায়পরায়নতার আদর্শে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণাদীপ্ত এই রমজান মুসলিম জাতীয় ঐতিহ্য চেতনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ ইসলাম ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে। সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মানব জাতিকে মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত লাভের আহবান জানায় এ পবিত্র মাস। 

বিগত ১১ মাসে মানুষের আমলে যে শিথিলতা দেখা দেয়। ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা তৈরি হয়। রমজান মাসে সেই শ্লথভাব কাটিয়ে উঠে উন্নত চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায় পাশবিক বাসনার প্রাবল্যকে পরাভূত করাই হচ্ছে রমজানের অন্তর্নিহিত মর্ম। ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সর্বত্র আল্লাহর দ্বীনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় প্রতিকূলতার মুখে টিকে থাকার জন্যে যে মন-মানসিকতার প্রয়োজন, সিয়াম সাধনার দ্বারাই তা অর্জিত হয়। তাছাড়া ইসলামী চিন্তা-ভাবনার জগতে উন্নতি ঘটাতে, উন্নত মানবিক জীবন এবং সমাজের মনোভূমিতে শৃংখলা আনতে সিয়াম সাধনা সহায়তা করে। এতে মুসলমানদের বিশ্বাস চেতনা ও উপলব্ধি প্রতিবিম্বিত হয়। মানুষের আদর্শিক শুন্যতা দূর করে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ, নৈতিক উৎকর্ষতা সৃষ্টি ও সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে এবং তাদের স্বশিক্ষিত ও মার্জিত করে গড়ে তুলে প্রকৃত মানব সৃষ্টির চেতনা সঞ্জীবিত করার ক্ষেত্রে রমজানের যথযথ অনুশীলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের সার্বিক চেতনাকে সঞ্জীবিত করার অনুশীলন করার সুযোগ আসে এই মাসে পরম দয়াময় রাব্বুল আলামীনের দয়ায়। রমজানের প্রতিটি কর্তব্য ঐশী বিধান এবং মহানবীর (সা.) নির্দেশিত পথে সঠিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হয়।
রমজানের প্রথম দশ দিন রহমতের। দ্বিতীয় দশ দিন মাগফিরাতের। শেষ দশ দিন নাজাতের। সিয়াম সাধনায়রত যেসব বান্দা রমজানের প্রথম দশ দিন মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতলাভে সমর্থ হন, তারাই দ্বিতীয় দশ দিন সর্বশক্তিমান আল্লাহর মাগফিরাত (ক্ষমা) প্রাপ্ত হন। আর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত অর্জনে সক্ষম বান্দারাই শেষ দশ দিনে সর্বপ্রকার পাপ পঙ্কিলতা থেকে নাজাত লাভ করে সত্য, সুন্দর, শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের কল্যাণ, উত্তরোত্তর সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তি অর্জন করে থাকেন এই মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে।
রমজানে ধৈর্যের অনুশীলন হয়। মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রতি দিন সোবহে সাদেক থেকে সূর্য অস্তমিত না হওয়া পর্যন্ত রোজাদাররা সর্বপ্রকার পানাহার থেকে বিরত থাকার অভ্যাস করেন। অনেক বৈধ কাজও ঐ সময়টাতে অবৈধ হয়ে যায়। লোক চক্ষুর আড়ালেও কোনো রোজাদার আল্লাহর এই নির্দেশকে অমান্য করার সাহস দেখান না। তাদের মনে এই ভয় থাকে যে, মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সর্বদ্রষ্টা। রোজার সময় নির্জনেও কোনো রোজা বিরোধী কাজ করলে, তা আল্লাহর নজর এড়ানো সম্ভব নয়। আল্লাহর এই ভয় সর্বদা তাদের মনে জাগ্রত থাকে। আল্লাহর এই ভয় ধারণ, চর্চা ও অনুশীলন করা হয় এই মাসে বেশি বেশি। মহান আল্লাহর আদেশ মেনে চলার শিক্ষাই রমজান মাসে আমাদের চেতনাকে শাণিত করে। কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত করে এবং দীপ্ত পথে বলিয়ান ও উদ্দিপ্ত করতে সহয়াতা করে।
কোরআন নাজিলের মাস। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সম্বলিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন এই মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলমনদের বোধ-বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আচার-ব্যবহার, জীবন ধারণ, জীবন-মনন, শাসন পদ্ধতি, জন্ম-মৃত্যু, রাজনীতি, অর্থনীত, সমাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-আদালত ইত্যাদি সব কিছুই পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। ঐশীগ্রন্থ কোরআন এবং মহানবীর (সা.) সর্বোত্তম জীবনাদর্শনুযায়ী মুসলমানদের জীবন পরিচালনা করার কড়া নির্দেশ রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে।
রমজান মাসকে বিজয়ের মাস বলা হয়। কারণ এই মাসেই সংঘটিত হয়েছে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। বদর নামক স্থানে দ্বিতীয় হিজরী সনের ১৭ রমজান কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে ইতিহাসে এই যুদ্ধকে বদর যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। মানবতার মহান নেতা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার বিপ্লবী সাহাবীরা মানুষের ওপর মানুষের প্রভূত্ব খতম করার মহান লক্ষ্যে এ মহান মাসে লড়াই করেছিলেন, বাতিলের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে, জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে। পৌত্তলিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের চেতনাকে সঞ্জীবিত করার লক্ষ্যে অনুশীলনের তাগিদ দেয় এ মাস।
রমজান ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাস। ৮ম হিজরীর ২০ রমজান মহানবী(সা.)-এর নেতৃত্বে সাহাবীদের মক্কায় প্রবেশের মাধ্যমে পবিত্র মক্কায় ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রমজান মাসেই মক্কা বিজয় হয় বলে এই মাসকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাসও বলা হয়।
রমজান ইসলামের অর্থনৈতিক মাস। এ মাসে জাকাত আদায় করা হয়। দান-দক্ষিণার মাধ্যমে অন্যের সুখ-দুঃখাদিতে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে মানুষের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনৈতিক চেতনা শাণিত হয় এই মাসে। রমজান ইসলামের আলোকে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের চেতনা ও জোরদার হয়। সৌহার্দ্যবোধের চেতনা জাগ্রত করার মাস রমজান। রমজান মাসে এক সাথে ইফতারের মাধ্যমে সার্বজনীন সাম্য, মৈত্রী, মানবিকতা সম্পন্ন মানসিকতা জোরদার করার মহড়া প্রদর্শিত হয় এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য বোধের চেতনাকে জাগ্রত করে। মানুষের অন্তরে একে অন্যের প্রতি ভালবাসার অনুভূতি স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জাগ্রত করে একত্রে ইফতার। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভুলে একত্রে জীবন যাপনের মানসিকতা অর্জনে সহায়তা করে। মুসলিম জনতার মানসলোক ও চেতনারাজ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। ইফতারের যথোপযুক্ত অনুশীলনই পারে সকলকে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় এবার সকলে একত্রিত হয়ে ইফতার গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ জনবিচ্ছিন্নতা কর্মসূচি অনুশীলন করতে গিয়ে অতীতের মতো এবার একত্রে অধিক লোকের ইফতার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শুধু উপবাস থাকাই রমজানের সাফল্য অর্জনের শর্ত নয়। বরং উপবাসের সাথে যাবতীয় পাপ কাজ যেমন মিথ্যা কথা বলা, গীবত করা, চোগলখোরী করা, মুনাফাখোরী করা, কালোবাজারী, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মতো ইসলামবিরোধী কাজ থেকে বিরত না থাকলে রমজানের ফল পাওয়া যাবে না। তাই রমজান মাসে তাকওয়া অর্জন করতে উপরোক্ত বদঅভ্যাস পরিত্যাগের অনুশীলন করতে হবে যথাযথভাবে।
এমাসে যত্নবান হতে হবে নামাজের ব্যাপারে। কারণ নামাজ বেহেস্তের চাবি। রমজান উত্তর মাসগুলোতে নামাজেও শিথিলতা আসে। তাই রমজান মাসে জামায়াতে নামাজ আদায়ে মুসল্লিরা তৎপর হন। নামাজের জন্যে যেসব উপাদান রয়েছে, তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। যেমন কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। তবে কাপড় শুধু পরিষ্কার হলে চলবে না, বরং সেই কাপড় হালাল অর্থে কেনা কিনা তাও স্মরণ রাখতে হবে। কেন না অবৈধ টাকায় কেনা পোশাকে নামাজ আদায় কতটুকু শুদ্ধ হবে, তাও খেয়াল রাখতে হবে। ইবাদাৎ সহি-শুদ্ধ হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হালাল রুজি-রোজগার। কেননা রুজি-রোজগার হালাল না হলে, যত ইবাদাত-বন্দেগি করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। তাই উপার্জন হালাল করতে হলে, স্বভাবতই ঘুষ-দুর্নীতির সংস্পর্শ ত্যাগ করতে হবে। এই অভ্যাসের পরিবর্তন করার মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান। ঘুষ-দুর্নীতি বর্জনের অনুশীলন সার্থক হলে, দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি হবে দ্রুত। কারণ এক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রধান বাধা।
রমজান আসলেই দেখা যায় নিত্যপ্রযোজনীয় দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্দ্ধগতি। এই পবিত্র মাসে অতি মুনাফাখোরী মনোভাব পরিত্যাগ করার মন-মানসিকতা অর্জন করা অপরিহার্য কর্তব্য। অথচ ব্যবসায়-বাণিজ্যে অতিমুনাফাখোরী, কালোবাজারী, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতাও বেশি লক্ষ্য করা যায় রমজান মাসে। এই মন-মানসিকতা রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী। যারা পবিত্র রমজান মাসেও ঘুষ-দুর্নীতিতে লিপ্ত, অতিমুনাফা অর্জনের মানসিকতা ত্যাগ করতে পারেন না, তাদের উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা পবিত্র রমজান পেয়েও তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারেননি, তারা অভিশপ্ত।’ কাজেই এব্যাপারে সকলেরই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। রমজানের আরেকটা বৈশিষ্ট হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারিতা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, রমজান মানুষের জন্যে বার্ষিক ওভারহয়েলিংয়ের মতো। কেননা প্রতিটি ইঞ্জিন প্রতি বছর ওভারহোয়েলিং করতে হয়। তাছাড়া রমজান মুসলমানদের জন্যে বার্ষিক মহড়া। দেখা যায় যে, প্রতিবছর বিভিন্ন বাহিনীর বার্ষিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
লেখক: ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন