পর্তুগিজ স্কুলগুলোতে পড়া সমস্ত শিক্ষার্থীকে পর্তুগিজ কবি লুইস ভাজ ডি ক্যামোসের ষোড়শ শতাব্দীর একটি মহাকাব্য পড়তে হয়। এতে রয়েছে সমুদ্রযুদ্ধে রাজ্য স¤প্রসারণের সময়ে পর্তুগালের রাজার গৌরবগাথা। কবিতাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে নাবিক ভাস্কো দা গামার প্রথম সমুদ্রযাত্রা এবং ভারতে মুসলমানদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বীতার গল্প। এতে মুসলিমদেরকে নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।
পর্তুগালকে মশলার বাণিজ্যে প্রবেশের সুযোগ দিতে আরব বণিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারত অভিমুখী সমুদ্রের পথ উন্মুক্ত করার জন্য জাতীয় বীর হিসাবে সম্বর্ধিত হয়েছিলেন দা গামা। তার বিরুদ্ধে সমুদ্রের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিতে সংগ্রামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের প্রচার চালানোরও অভিযোগ করা হয়।
পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দা গামা মক্কা থেকে ফিরে আসা ২০০ মুসলিম হজ্জযাত্রীবাহী একটি জাহাজ আটকে তা জ্বালিয়ে দেন। এতে শতাধিক যাত্রী নিহত হন। তবে এই ধরনের গণহত্যার কথা লুসিয়াদস বা পর্তুগিজ স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে বেশিরভাগ আক্রমণের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়।
পর্তুগালের অন্যতম সেরা কবি হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত ক্যামোস স্মরণে ১০ জুন পর্তুগাল দিবস নামে একটি জাতীয় ছুটি উদযাপিত হয়। এ ছুটিটি ‘পর্তুগিজ রেসের দিবস’ হিসাবে পরিচিত ছিল এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যেকার প্রধানমন্ত্রী রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী আন্তোনিও ডি অলিভিরা সালাজার তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনার উদযাপন হিসাবে প্রচার করেন। তার প্রতিষ্ঠিত ‘এস্তাদো নোভো’ ১৯৭৪ সালে স্বৈরাচারী শাসনের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল।
জাতীয়তাবাদী আখ্যানের মূল অংশে ক্যাথলিক ধর্ম নিয়ে চরম রক্ষণশীল একনায়কতন্ত্র মুসলমানদেরকে আক্রমণকারী এবং ‘খ্রিস্টান জাতির শত্রæ’ হিসাবে চিত্রিত করেছিল। ব্যারোস বলেন, ‘ক্যামোস তার জাতীয়তাবাদী কাজের জন্য দায়ী নয়। তিনি এখনও পর্তুগিজ কবিদের একজন’। তবে ইতিহাসবিদ যুক্ত করেছেন, লুসিয়াদস ছিল মুসলমানদের বিরোধিতা করে এই সময়ের ইউরোপীয় পরিচয় গঠনের আদর্শিক নির্মাণ এবং ক্রুসেডিয় মানসিকতার ফসল যা খ্রিস্টান-মুসলিম সম্পর্ককে বিবাদী শর্তে চিত্রিত করেছিল। ব্যারোসের মতে, কবিতাটি যখন লেখা হয়, অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকদের আধিপত্যের জন্য একটি হুমকি সৃষ্টি করেছিল।
পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর পুরো সময়কালে পর্তুগিজ রাজা উত্তর আফ্রিকার দিকে তার রাজ্য সম্প্রসারিত করতে থাকেন। সেখানে তারা সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং যুদ্ধে লিপ্ত হন। উত্তর আফ্রিকায় পর্তুগালের স¤প্রসারণবাদী উচ্চাভিলাষের অবসান ঘটিয়ে মরক্কোর শহর কসর এল-কেবীর (পর্তুগিজ ভাষায় আলক্যাসের কুইবীর নামে পরিচিত)-এ এক বিপর্যয়কর পরাজয়ের আগ পর্যন্ত এটি অব্যাহত ছিল।
ইসলামের বিরোধিতা করে ইউরোপীয় পরিচয় রূপায়িত হওয়ায় মুর পর্তুগালের ‘অন্যান্য’ হয়ে ওঠে। যদিও ‘মুর’ শব্দটি ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর আফ্রিকার আরবিভাষী মুসলমানদের জন্য উল্লেখ করা হয়েছিল, তবুও এই লেবেলটি প্রায়শই মুসলমানদের কাছে বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করার জন্য ব্যবহৃত হত, যার ফলে তাদের বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছিল বহুগুণে।
তবে জাতীয়তাবাদী আখ্যানগুলো বর্তমানে পর্তুগাল এবং স্পেনের অঞ্চলে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সহাবস্থান থাকায় কয়েক শতাব্দী ধরে একটি ক্যাথলিক পরিচয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যারোস ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইতিহাসের প্রভাবশালী সংস্করণ এবং দীর্ঘকালীন পুরাণের বিপরীতে মুসলমানরা বাইরের লোক ছিল না। ঐতিহাসিক যুক্ত করেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী প্রচারের জন্য এটি উপযুক্ত হওয়া বিপজ্জনক’ বিশেষত পুরো ইউরোপ জুড়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তার আলোকে। পর্তুগালের ‘এস্তাদো নোভো’কে ১৯৭৪ সালের কার্নেশন বিপ্লবে পরিণত করা হয়েছিল, তবে কিছু পুরনো বিবরণ এখনও রয়েছে।
সালাজার শাসন অবসানের পর ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো পর্তুগালের সংসদে একটি নবগঠিত চরম-ডানপন্থী দল ১টি আসন জিতেছে। দলটি পাবলিক স্কুল থেকে ‘ইসলাম শিক্ষা’ বাদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে এবং ভ‚মধ্যসাগরের দক্ষিণের ‘আক্রমণ’ থেকে ইউরোপের সীমান্তকে রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন