ঢাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। সামান্য বৃষ্টিতেই পানি থই থই করে। গত কয়েক বছর ধরে পানিবদ্ধতায় ঢাকাবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে উদ্যোগ ও আশ্বাসের কথা জানালেও কোনও সমাধান যেন নেই। শুধু ড্রেন পরিষ্কার আর নদী ও খাল অবৈধ দখল মুক্ত করার পরামর্শ ছাড়া কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যুগ যুগ ধরেই একই সমস্যা দেখা দিলেও টেকসই সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। শুধু মিটিং আর নির্দেশেই আটকে আছে এ সংক্রান্ত কাজ। এ অবস্থায় এবারও বর্ষা রাজধানীতে বড় দুর্ভোগের কারণ হতে পারে বলে শঙ্কায় আছেন নগরবাসী। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভও বিরাজ করছে।
অন্যদিকে, টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) অভ্যন্তরের প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। গত দুই দশক ধরে ডিএনডির অভিশপ্ততা থেকে এখনো রেহাই মেলেনি তাদের। স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান জানিয়েছেন, জরুরীভিত্তিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও ব্রিক স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না। এতে ভারি বর্ষণে শহরের অলিগলি, প্রধান সড়ক, ফুটপাত পর্যন্ত তলিয়ে যায়। এ সময় খানাখন্দে ভরা সড়কে চলাচলে প্রতি বছরই হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাতটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। বরং মাঝপথে আটকে থাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ময়লা আর ভাগাড় জমে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এতে করে সড়কে জমে যাচ্ছে বৃষ্টির পানি। আর দুটি প্রকল্পের কাজ এখনও শুরুই করা হয়নি। অন্যদিকে, চলতি বছর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডেও ‘সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এতে খরচ ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। করোনার মধ্যে বড় বড় প্রকল্পের কাজ চললেও সিটি করপোরেশনের এ প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় বর্ষার শুরুতেই ভোগান্তি বেড়েছে।
ডিএসসিসি ও ঢাকা ওয়াসার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পানিবদ্ধতাপ্রবণ ৪৮টি এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু মাত্র পাঁচটি পথ দিয়ে এসব পানি ঢাকার বাইরে নির্গমণ হচ্ছে। এই পাঁচটি পথও সময়মতো পরিস্কার ও মেরামত না করায় ময়লা আবর্জনায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, সেগুনবাগিচা, পল্টন, বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী, সার্কিট হাউজ রোড, রাজারবাগ, শান্তিবাগ, ফকিরেরপুল ও আরামবাগের পানি সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট-কমলাপুর পাম্প-মানিক নগর খাল-জিরানি খাল ও মান্ডাখাল হয়ে বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ে। ধানমন্ডি-২৭, রাপা প্লাজা, ধানমন্ডি-৮/এ স্টাফ কোয়ার্টার মোড়, কাঁঠাল বাগান, গ্যাস্ট্রোলিভার গলি, কলাবাগান ডলফিন গলি, গ্রিনরোড, মাদারটেক ও মেরাদিয়ার পানি নিষ্কাশন হয় পান্থপথ বক্স কালভার্ট-হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা খাল দিয়ে বালু নদীতে। নিউমার্কেট পশ্চিম-দক্ষিণ পাশের বটতলা, বিজিবি-৪ নং গেটের পানি বিজিবি ৩ নং গেট, নাজিমউদ্দিন রোড, হোসেনি দালান, চকবাজার, লালবাগ, কাজী আলাউদ্দিন রোড ও বংশালের পানি নিষ্কাশন হয় বুড়িগঙ্গা সুইচগেট হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে। অন্যদিকে, গুলিস্তানের পানি নিষ্কাশনের কোনও ব্যবস্থা নেই। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতে সচিবালয় ও বঙ্গভবন এলাকায় পানি জমে যায়। খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদার পানি নিষ্কাশন হয় বাসাবো-মাদারটেক-ত্রিমোহনী খাল হয়ে বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায়। কাপ্তান বাজার, লক্ষীবাজার ও আগামসি লেনের পানি নিষ্কাশন হয় ইংলিশ রোড-ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট হয়ে সূত্রাপুর পাম্পে। জুরাইন, পোস্তগোলা, মুরাদপুর, শ্যামপুর, কদমতলা ও দয়াগঞ্জ রেল ব্রিজের পানি নিষ্কাশন হয় জিয়া সরণি খাল-রসুলবাগ-শিমরাইল পাম্প (পানি উন্নয়ন বোর্ড) হয়ে শীতল²ায়। এছাড়া মীর হাজীরবাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের কোনও ব্যবস্থা নেই।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, এসব এলাকার ড্রেনের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়নকল্পে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উন্নয়ন কাজপ্রকল্পগুলোর মধ্যে এক হাজার ২১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্পের আওতায় ১৩১ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার রাস্তা, ২৫ দশমিক ৪০ কিলোমিটার ফুটপাত, ১৩০ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ড্রেন, শান্তিনগর এলাকার পানিবদ্ধতা দূর করতে ৯ দশমিক ২৭২ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন, ১১ দশমিক ৪০২ কিলোমিটার ফুটপাত, ১১ দশমিক ৭২ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ৩৮ হাজার ৯৮টি এলইডি বাতি স্থাপন, নতুন ৭ ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ ও ১৬টি সংস্কার, বাস বে, বাস স্টপেজ, বাম লেন, গার্ড রেল, গ্রিল ফেন্সিং, সড়ক দ্বীপ বিউটিফিকেশন, ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ উন্নয়ন, ৪৭টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ১৭টির সংস্কার, ১৬টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন স্থাপন, দুটি আধুনিক জবাই খানা, তিনটি কবরস্থান উন্নয়ন, একটি শিশুপার্ক নির্মাণ, দুটি হাসপাতাল সংস্কার ও ১১টি ক্লিনার কলোনি নির্মাণ কাজ। ২০১৬ সালে নেয়া এসব প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনটি প্রকল্পের কাজ এখনও বাকি। মাঝপথে আটকে আছে অনেক কাজ। যেগুলো এখন দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া ৭৭৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওতাধীন নবসংযুক্ত শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল এবং সারুলিয়া এলাকার সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৫২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা, ১৫৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নর্দমা, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত, ৭ হাজার ৬৩টি বৃক্ষ রোপণ ও ১৪৩ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার এলইডি লাইট স্থাপন করার কথা রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। কিছু কিছু এলাকায় ড্রেনেজের কাজ হলেও সেগুলো অসমাপ্ত থাকায় পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। শ্যামপুর এলাকার পানি সহজে বুড়িগঙ্গায় পড়লেও যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, রসুলপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা এলাকার পানি গিয়ে মিলছে ডিএনডি এলাকায়। সেখানকার রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় প্রবাহমান পানি উল্টো ড্রেন দিয়ে এলাকার রাস্তাঘাট প্লাবিত করছে। এসব এলাকার ড্রেনগুলো বহুদিন ধরে পরিস্কার না করায় সেগুলোতে ময়লা জমে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এ বিষয়ে এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এরপরও সিটি কর্পোরেশন শান্তিনগর, সচিবালয় এলাকা, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডসহ বেশ কিছু এলাকায় ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি চারপাশের নদীতে পৌঁছাতে ড্রেন-খাল ও নদীর সঙ্গে কার্যকর সংযোগ থাকা দরকার। বাস্তবতা হচ্ছে সেটা নেই। ঢাকা শহরের পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ সামরিক বানিহীকে দেয়ার প্রস্তাব উঠেছে। এটা যৌক্তিক, সামরিক বাহিনীকে এ দায়িত্ব দেয়া হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিএনডি এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় সরকার। আর এই প্রকল্পটির দায়িত্বভার দেয়া হয় সেনাবাহিনীকে। যার কারণে গত বছর পানিবদ্ধতার দূর্ভোগ থেকে অনেকটাই রেহাই পান ডিএনডি এলাকার বাসিন্দারা। এরই মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ ও হয়েছে। মাঝপথে আর্থিক সংকট এবং করোনার কারণে কাজের গতি কমে আসে। এতে গত কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণের ডিএনডি এলাকায় আবারো পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে মানুষ দূর্ভোগে পড়েন।
১৯৬৭ সালে ৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমি নিয়ে কৃষি কাজের জন্য গড়ে তোলা হয় ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-ডেমরা ডিএনডি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু ডিএনডি প্রকল্পের ভেতর অপরিকল্পিকত গড়ে উঠে হাজার হাজার বাড়ি ঘর ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দখল হয়ে যায় ডিএনডির পানি নিস্কাশনের বেশীর ভাগ খাল ও ক্যানেল। অনেক জায়গায় আবার পলিথিনসহ বিভিন্ন ময়লা আর্বজনা জমে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত ডিএনডি পানিবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ডিএনডি উন্নয়ন পকল্পের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন। জানা গেছে, গত শুক্রবার শামীম ওসমানের হস্তক্ষেপে দ্রুত পানি নিষ্কাশনে কাজ শুরু হয়েছে। এমপি শামীম ওসমান জানান, বরাদ্দের ব্যবস্থা হয়ে গেলে সেনাবাহিনী এই প্রকল্পটিকে হাতির ঝিলের চেয়েও মনোমুগ্ধকর অবস্থায় পরিণত করবে। ডিএনডি উন্নয়নের প্রকল্প পরিচালক লেফটেনেন্ট কর্ণেল মাশফিক জানান, জানগণের দূর্ভোগ দূর করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করছেন তারা। এ কাজে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এর সফলতা আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন