রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ। সেই ওষুধ যদি হয় ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের তা হলে নিরাময় নয়, হবে মরণ! বিশব্যাপী বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম ও চাহিদা বাড়লেও দেশের চিত্র ভিন্ন। গত কয়েক দশকে ধাপে ধাপে উন্নতি করে ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। নিজেদের চাহিদার প্রায় ৯৮ ভাগ মিটিয়ে ১৬৮টির মতো দেশে ওষুধ রফতানি করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। ওষুধ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি অথচ দেশের বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধে। সু-চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ভেজাল ওষুধ কিনে উল্টো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ওষুধের মান নিয়ে তাই প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এক শ্রেণির ওষুধ কোম্পানি ও সিন্ডিকেট বেশি মুনাফার লোভে তৈরি করছে বিভিন্ন ধরণের ভেজাল ওষুধ। শুধু দেশিয় ওষুধই ভেজাল হচ্ছে এমন নয়; এখন বিদেশি ওষুধও ভেজাল করে অভিজাত ফার্মেসিগুলোতেই দেদারছে বিক্রি করছে। লাজ ফার্মা, তামান্না ফার্মাসহ নামিদামি ফার্মেসিগুলোতেই বিদেশি বড় বড় কোম্পানির ওষুধের হুবহু নকল লেবেল ছাপিয়ে ওষুধের গায়ে লাগিয়ে বাজারজাত করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতিদিনই বাড়ছে এই চক্রের দৌড়াত্ম। যার কারণে হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। এসব ওষুধ সেবন করে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে মারাও যাচ্ছে রোগী। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক সব ওষুধেই মিলছে ভেজাল। ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মতে, নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দষ্ট আইনও নেই বাংলাদেশে। এ কারণে ভেজাল ওষুধের ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া ওষুধ খাতের দুর্নীতি, চিকিৎসকদের কমিশনের লোভ, আইন প্রয়োগের শৈথিল্য, প্রশাসনের নজরদারির অভাব, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত অসমর্থতা, দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ভেজাল ওষুধ বাজারজাতকরণের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন তারা। এই অবস্থায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন। আর তাতে মানুষও জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ওপর আস্থা পাবে। যদিও বিষয়টি যার দেখার কথা সেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তারাও এ কাজে বিভিন্ন সময়ে সহায়তা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে দেশে প্রস্তুত ভেজাল ওষুধের পাশপাশি বিমান, নৌ ও স্থলবন্দর দিয়ে ঢুকছে নকল, ভেজাল, মানহীন ও অনুমোদনবিহীন ওষুধ। সূত্রমতে, দীর্ঘদিন থেকে দেশিয় নামিদামি কোম্পানির ওষুধ হুবহু নকল করে বিক্রি করছিলো একটি চক্র। কিন্তু দেশিয় ওষুধের দাম কম এবং এতে লাভ কম হওয়ায় চক্রটি বেশি মুনাফার আশায় বিদেশি ওষুধ নকল করে বাজারে বিক্রি করছে। চক্রটি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশের ওষুধ কোম্পানির মোড়কে ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে। এসব ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে লাজফার্মা, তামান্না ফার্মার মতো নামিদামি ফার্মেসিতে। গত বৃহষ্পতিবারও গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ ও ওষুধ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করেছে। এ সময় আটক করেছে ১৬ জনকে।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য মতে, রাজধানীর লাজফার্মা, তামান্না ফার্মাসহ বেশকিছু ওষুধের দোকানে দীর্ঘদিন থেকে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি ভেজাল ওষুধ। খোঁজ মেলে এসবি করপোরেশন নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের যারা আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ওষুধ আমদানির নাম করে দেশেই তৈরি করে আসছে মানহীন ওষুধ। পুলিশের অভিযানে অরেক্সিস, হাইজিংক, ডায়ানাসহ ৬টি বিদেশি ব্রান্ডের বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ ও ওষুধ তৈরির উপকরণ জব্দ করা হয়। এসব ওষুধের মোড়কে, আমেরিকা ইংল্যান্ডের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও তৈরি হয় টঙ্গীর চেরাগ আলীতে। হলোগ্রাম, কৌটা আর কাঁচামাল আনা হয় ফকিরাপুল থেকে। পুলিশ অভিযান চালায় উত্তরার তামান্না ও লাজ ফার্মায়। সেখান মেলে এসব ভেজাল ওষুধ।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মুখপাত্র উপ-পরিচালক আইয়ুব আলী ইনকিলাবকে বলেছেন, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলমান আছে। এটা তাদের নিয়মিত কাজ। প্রতি সপ্তাহে এমনকি প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অভিযান চলছে। তিনি বলেন, বিদেশি ওষুধ দেশেই তৈরি করে বিক্রি করছে এটা গুরুতর অপরাধ। বিদেশি ওষুধ হলে অবশ্যই অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশন লাগবে। রেজিস্ট্রেশন না থাকলেই অনুমোদনবিহীন। আর অভিযানে অনুমোদনবিহীন ওষুধ পেলেই আইন অনুযায়ী মামলা, জেল ও জরিমানা করা হচ্ছে।
আইয়ুব আলী বলেন, করোনার সময়ে একটি গ্রুপ সুযোগ নিচ্ছে নকল ওষুধ বাজারজাত করে মুনাফা করতে। আর সে জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ওষুধ ক্রয় না করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানান তিনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, উত্তরায় অভিযানে জব্দ করা এসব ওষুধের কোনো অনুমোদন নেই। তারা আটা-ময়দা আর রং মিশিয়ে এসব ওষুধ তৈরি করে এগুলা প্যাকেট করে বিক্রি করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসব ওষুধ সামগ্রী আমদানি হয় না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ঢাকা শহরের উত্তরা, গাজীপুরের নর্দমার কাছাকাছি জায়গাতে বসে বসে তারা এসব ওষুধ তৈরি করে এবং বিভিন্ন বড় বড় ফার্মেসিতে তৈরি করে। এসব নিয়ে লম্বা তদন্ত করে যাতে করে আমরা জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে কিছুটা অবদান রাখতে পারি। এসব ওষুধ কেনা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ পুলিশের।
এর আগেও বিদেশি ওষুধের নামে নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করছিল ‘অ্যারিস্টোক্রাট কেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। বিদেশ থেকে ‘খোলা ওষুধ’ এনে তা বোতলে ভরে লেভেলিং করত প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধগুলো নতুন করে মেয়াদ বসিয়ে বাজারে ছাড়ছিল। প্রতিষ্ঠানটির এসব ভেজাল ওষুধ বিক্রিতে সহযোগিতা করছিলেন কিছু অসাধু চিকিৎসক। যারা প্রতিমাসে এখান থেকে কমিশন পেতেন। গত বছর র্যাবের অভিযানে প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা এবং এমডিকে দুই বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।
সূত্র মতে, সারা দেশে ওষুধ বাণিজ্যের এই অরাজক পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র মুখ্য ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাঝে মাঝে কিছু কার্যক্রম চোখে পড়লেও কঠোর মনিটরিং ও কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ভেজালকারীরা বেপরোয়া। বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই এ অপরাধ। নতুন কৌশল অবলম্বন করে নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে অপরাধীরা। তাদেরই একজন কেরানীগঞ্জের রাসেল। সে নিজেই কেমিস্ট, নিজেই ফার্মাসিস্ট, আবার ওষুধ কোম্পানির মালিকও। স্কয়ার, বেক্সিমকো, অপসোনিন এবং ইনসেপটার মতো নামিদামি কোম্পানির মোড়ক, বোতল হুবহু নকল করে বছরের পর বছর ধরে অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত রাসেল। রাসেলের মতো ঢাকার মুগদার বাদশা, মিরপুরের সালাউদ্দিন বাবু, পান্থপথের মোহাম্মদ আলী খান, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর এম এ বারেক নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এই অপরাধে তাদের একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে গেছে পুরোনো ব্যবসায়।
দেশে বর্তমানে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজার। এভাবে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ওষুধ শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। সেজন্য সরকারকে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত এবং মান নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ কোন ওষুধ নকল বা ভেজাল কিনা সেটি রোগীতো নয়ই, অনেক সময় চিকিৎসকের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, নকল ওষুধ প্রস্তুত ও ভেজাল ওষুধ বিপণনে রাজধানীর মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট, ফার্মেসি সংগঠন, বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কোন কোন নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সরকারের মাঠ পর্যায়ে থাকা ড্রাগ সুপারদের যোগসাজশে দেশজুড়ে সংঘবদ্ধভাবে গড়ে উঠেছে নকল-ভেজাল ওষুধের বিশাল নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থের ভেজাল, নকল এবং নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয়।
ওষুধ কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম সাফিউজ্জামান বলছেন, বর্তমানে যারা ভেজাল ওষুধ বানান, তারা সমিতির সদস্য নয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেছেন, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খোলাবাজারে কোনোভাবেই বিক্রি হতে পারে না। যারা এ ধরনের কাঁচামাল বিক্রির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাহলেই ছোট ছোট কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি হওয়া মানহীন ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, যে কোন ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পারেন। মানহীন ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন