শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

মুসাফির মদীনার পানে

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২০, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
(তিনি আরো বলেন) ব্যথা তো তখন থেকেই উধাও হয়ে গেলো, কিন্তু হাত নাড়াতে পারছিলাম না, সতের দিন পরে সরকারি হাসপাতালে এক্সরে করালাম, দেখা গেলো, হাঁড় দুই টুকরো হয়ে সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে, কিন্তু আমি চিকিৎসা করালাম না। পরে ধীরে ধীরে হাতও কাজ করতে শুরু করল, মদীনা মুনাওয়ারার সেই হাসপাতালের ডাক্তার মুহাম্মদ ইসমাঈল বললো: এটি বিশেষ চমকই বটে। কেননা ডাক্তারি শাস্ত্র মতে, এই হাত কাজই করতে পারে না। সেই এক্সরে এখনো আমার নিকট আছে, হাঁড় এখনো ভাঙাই রয়েছে, এই ভাঙা হাতেই তাফসীর লিখছি, আমি ভাঙা হাতটির এই চিকিৎসাই করিয়েছি যে, মহান আস্তানায় দাঁড়িয়ে আরয করলাম: “হুযুর! আমার হাত ভেঙে গেছে, হে আব্দুল্লাহ্ বিন আতীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ভাঙা হাটু জোড়া দানকারী! হে মুয়াজ বিন আফরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ভাঙা বাহু জোড়া দানকারী! আমার ভাঙা হাতটি জুড়ে দিন।”(তাফসীরে নঈমী, ৯/৩৮৮)

মদীনা মুনাওয়ারায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম পেশ করা খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। আহ! আমাদের জীবনেও সেই মুবারক মুহুর্ত আসতো। মনে রাখবেন, যার এই দরবারের উপিস্থিতির সৌভাগ্যে নসীব হয়েছে তার জন্য আবশ্যক যে, এই মহান দরবারের আদবের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা, কেননা সামান্যতম অসতর্কতাই কঠিন বঞ্চনার কারণ হতে পারে। আসুন! মদীনার সফর এবং রওযায়ে আকদাসের উপস্থিতির কিছু আদব শ্রবণ করি।

আল্লামা মুফতী আমজাদ আলী আযমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওযায় উপস্থিত হওয়ার আদব বর্ণনা করে বলেন: উপস্থিতিতে শুধুমাত্র পবিত্র যিয়ারতেরই নিয়্যত করুন। হজ্ব যদি ফরয হয় তবে হজ্ব করেই মদীনা মুনাওয়ারায় উপস্থিত হোন। হ্যাঁ! যদি মদীনা মুনাওয়ারা পথে হয় তবে যিয়ারত করা ছাড়া হজ্ব করতে যাওয়া কঠিন বঞ্চনা ও অন্তর কঠোরতার কারণ। আর এই উপস্থিতিকে হজ্ব কবুলের এবং দ্বীন ও দুনিয়ার সৌভাগ্যের মাধ্যম ও ওসীলা বানান। যদি নফল হজ্ব হয় তবে অধিকার রয়েছে যে, প্রথমে হজ্ব থেকে পাক পবিত্র হয়ে মাহবুবের দরবারে উপস্থিত হবে কিংবা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে প্রথমে উপস্থিত হয়ে সেই উপস্থিতিকে হজ্বের মকবুলিয়্যত ও নূরানীয়্যতের ওসীলা বানাবে। সারা রাস্তায় দরূদ ও যিকিরে লিপ্ত থাকবে এবং মদীনা মুনাওয়ারা যতই নিকটে আসবে, আগ্রহ ও আকাক্সক্ষা আরো বৃদ্ধি করবে। যখন মদীনার হেরেম আসবে, উত্তম হলো পায়ে হেঁটে, কান্না করে, মাথা নত করে, দৃষ্টিকে নীচু করে, অধিকহারে দরূদ শরীফ পাঠ করতে করতে এবং সম্ভব হলে খালি পায়ে চলা। যখন নূরানী গম্বুজ দৃষ্টি গোচর হবে, অধিক হারে দরূদ ও সালাম পাঠ করবে। মসজিদে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে ঐসকল প্রয়োজনীয়তা থেকে অবসর হয়ে যাবে, যা দ্বারা মন না লাগার কারণ হয়, খুবই তাড়াতাড়ি অবসর হবে, এছাড়া কোন অযথা কথাবার্তায় লিপ্ত হবে না, দ্রুত ওযু ও মিসওয়াক করবে এবং গোসল করা উত্তম। সাদা পোষাক পরিধান করবে, আর তা নতুন হলে উত্তম। সুরমা ও সুগন্ধি লাগাবে এবং মেশক উত্তম। এবার দ্রুত পবিত্র আস্তানার দিকে অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সহিত মনোযোগি হবে, কান্না না এলে তবে কান্নার মতো ভঙ্গি করবে এবং মন থেকে কান্না করার চেষ্টা করবে। আর নিজের নিঃসঙ্গ অন্তর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অনুরোধ করবে। মসজিদে নববী শরীফে উপস্থিত হয়ে প্রথমে সালাত ও সালাম আরয করবে, অতঃপর একটু অপেক্ষা করবে, যেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজিরীর অনুমতি প্রার্থনা করছে, অতঃপর বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম বলে ডান পা প্রথমে রেখে একেবারে আদব সহকারে প্রবেশ করবে। চোখ, কান, মুখ, হাত, পা, অন্তর সবকিছুকে অন্য খেয়াল থেকে পবিত্র করে নিবে, পবিত্র মসজিদের নকশা ও কারুকাজের দিকে তাকাবে না। যদি এমন কেউ সামনে এসে যায় যার সাথে সালাম ও কথাবার্তা বলা প্রয়োজন, তবে যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে যাবে অন্যথায় প্রয়োজেনের অতিরিক্ত বলবে না, তবুও অন্তরকে হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে রাখবে। কখনোই মসজিদে নববীতে কোন শব্দকে চিৎকার করে বের করবেন না। বিশ্বাস রাখবে যে, হুযুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিকার ভাবে দুনিয়াবী শারীরিক জীবন দ্বারা তেমনি জীবিত, যেমনটি ওফাত শরীফের পূর্বে ছিলেন, তাঁর এবং সকল আম্বিয়ায়ে কিরামের মৃত্যু শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওয়াদাকে সত্যে পরিনত করতে মুহুর্তের জন্যই ছিলো। (বাহারে শরীয়ত, ১ম অংশ, ৬/১২২২-১২২৩) এবার আদব ও আগ্রহ সহকারে গর্দান ঝুকিয়ে, দৃষ্টিকে নিচু করে, অশ্রুসিক্ত করে, কাঁপতে কাঁপতে, গুনাহের প্রতি লজ্জিত হয়ে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া ও অনুগ্রহের প্রতি আশা রেখে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কদম শরীফের দিক দিয়ে সোনালী জালির সামনে রওযা শরীফে উপস্থিত হবে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নূরানী মাযারে কিবলামূখী অবস্থান করছেন, সুতরাং কদম মুবারকের দিক দিয়ে যদি মুসাফির উপস্থিত হয় তবে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কৃপা দৃষ্টি সোজাসুজি তার দিকেই হবে এবং এই বিষয়টি অশেষ আগ্রহান্বিত হওয়ার পাশাপাশি তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যের কারণও। কিবলাকে পিছনে দিয়ে কমপক্ষে চার হাত (দু’গজ) দূরে নামাযের ন্যায় হাত বেঁধে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুরানী চেহারার দিকে হয়ে দাঁড়াবে, কেননা ফতোওয়ায়ে আলমগীরি ও অন্যান্য কিতাবে রয়েছে- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এভাবে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে নামাযে দন্ডায়মান হয়। মনে রাখবেন! হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরানী মাযারে একেবারে প্রকাশ্য জীবনের ন্যায় জীবিত এবং উপস্থিত ব্যক্তিকেও দেখছেন বরং যিয়ারতকারীর মনে যে খেয়াল আসছে সে সম্পর্কেও অবহিত। খবরদার! জালি মুবারককে চুমু দেয়া বা হাত লাগানো থেকে বিরত থাকবে, কেননা তা আদবের পরিপন্থি; আমাদের হাত জালি মুবারককে স্পশ করার উপযুক্ত নয়, সুতরাং চার হাত (অর্থাৎ দু’গজ) দূরেই থাকবে, আদব এবং আগ্রহের পাশাপাশি কাতর কন্ঠে এই শব্দাবলী সহকারে সালাম আরয করবে:

অর্থাৎ হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার প্রতি সালাম এবং আল্লাহ তায়ালার রহমত এবং বরকত হোক। হে আল্লাহ তায়ালার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার প্রতি সালাম। হে আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টি থেকে উত্তম! আপনার প্রতি সালাম। হে গুনাহগারদের শাফায়াতকারী! আপনার প্রতি সালাম। আপনার প্রতি, আপনার পরিবার পরিজন ও সাহাবাদের প্রতি এবং আপনার সকল উম্মতের প্রতি সালাম।
কিন্তু মনে রাখবে যে, সালাম আরয করার সময় আওয়াজ বেশি উচ্চ এবং কঠোর যেনো না হয়, কেননা আমলই নষ্ট হয়ে যাবে এবং একেবারে ধীরেও যেনো না হয় বরং মধ্যম আওয়াজের হওয়া উচিৎ। (বাহারে শরীয়ত, ৬ষ্ট অংশ, ১/১২২৪-১২২৬) নূরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নিজের এবং আপন পিতা-মাতা, পীর, ওস্তাদ, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু এবং সকল মুসলমানের জন্য শাফায়াতের প্রার্থণা করুন, বারবার আরয করবে:
(ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনার শাফায়াতের ভিখারী)।

অতঃপর যদি কেউ সালাম আরয করার ওসীয়ত করে তা পূরণ করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত মদীনা তায়্যিবার হাজিরী নসীব হয়, একটি নিশ্বাসও অযথা নষ্ট করবে না, প্রয়োজন ছাড়া অধিকাংশ সময় মসজিদ শরীফে পবিত্রাবস্থায় উপস্থিত থাকবে, নামায ও তিলাওয়াত এবং দরূদ পাঠ করে সময় অতিবাহিত করবে, দুনিয়াবী কথাবার্তা শুধু এখানে নয় বরং যেকোন মসজিদে করা উচিৎ নয়। মদীনা তায়্যিবায় রোযা নসীব হলে, বিশেষতঃ গরমের মৌসুমে তবে কতই না উত্তম যে, এতে শাফাআতের ওয়াদা রয়েছে। এখানে প্রত্যেক নেকীই পঞ্চাশ হাজার (৫০,০০০) লিখা হয়, সুতরাং ইবাদত করার বেশী বেশী চেষ্টা করবে, পানাহার অবশ্যই কমিয়ে দিবে এবং যতটুকু সম্ভব সদকা করবে। নূরানী রওযায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করা ইবাদত, যেমনিভাবে পবিত্র কাবা বা কোরআনে করীম দেখা ইবাদত, তাই আদব সহকারে তা অধিকহারে করবে এবং দরূদ ও সালাম আরয করতে থাকবে। দিনে পাঁচবার বা কমপক্ষে সকাল-সন্ধ্যা রওযা শরীফে সালাম আরয করার জন্য উপস্থিত হবে। শহরের মধ্যে বা শহরের বাইরের যেখান থেকেই সবুজ গুম্বদের উপর দৃষ্টি পড়বে, দ্রুত হাত বেঁধে সেদিকে মুখ করে সালাত ও সালাম আরয করবে, এরূপ করা ছাড়া কখনো পথ অতিক্রম করবে না, কেননা এটা আদবের খেলাফ। রওযা শরীফের দিকে কখনোই পিঠ করবে না এবং যথাসম্ভব নামাযেও এমন স্থানে দাঁড়াবে না, যেখানে পিঠ করতে হয়। নূরানী রওযার তাওয়াফ করবে না, সিজদা করবে না, এর সামনে এতটুকু ঝুঁকবে না যে, রুকুর সমান হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ এর সম্মান তাঁর আনুগত্যের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। আর নূরানী রওযার সিজদা ও তাওয়াফ করা বা এর সামনে রুকুর সমান নত হওয়া রাসূলের আনুগত্যের পরিপন্থি। ( বাহারে শরীয়ত, ১ম অংশ, ৬/১২২৫-১২২৮ পৃ:)

মুসাফির চল মদীনা চল, মুসাফির চল মদীনা চল
আজি নহে তো কাল, মুসাফির চল মদীনা চল।

লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন