কঠিন বিষয়কেকে সহজ করে বুঝানোর জন্য উপমা দেওয়া হয়। কারণ উপমা দ্বারা দ্রুত দুর্বোধ্য বিষয় উপলব্ধি করা যায়। ভাবাতুর বিষয়কে চাক্ষুষ করে তোলে। আমাদের প্রিয় নবী সা: তাঁর সাহাবীদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। পরকালের ভয়ংকর দৃশ্যকে উপমার মাধ্যমে চিত্রায়িত করেছেন। হাদীসে এমন কিছু উপমা রয়েছে যেগুলো নিয়ে ভাবলে মুমিনের ঈমানে জোয়ার আসে। এমনি একটি উপমা হচ্ছে মৌমাছি ও মুমিনকে নিয়ে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা: হতে বর্ণিত: রাসূল সা: বলেন : ঐ সত্তার শপথ যার পবিত্র হস্তে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবন,নিশ্চয় মুমিনগণ হলো মৌমাছির মতো। উত্তম জিনিস খায় উত্তম জিনিস তাঁর পেট থেকে বের হয়। সে (ফুলের) উপর বসে এবং তাকে নষ্ট কিংবা ভেঙ্গে ফেলে না।( মুসনাদে আহমদ:৬৮৭২)
রাসূল সা: মুমিনের উপমা দিয়েছেন মৌমাছির সাথে এই দুজনের মাঝে চমৎকার কিছু মিল রয়েছে। মৌমাছির চরিত্র, আচরণ এবং কর্মকান্ডে অসাধারণ মিল রয়েছে। একটু সু² দৃষ্টিতে চিন্তা করলে খুঁজে পাবো।
আমীরের অনুসরণ: সুষ্ঠু সমাজ গড়তে আমীরের অনুসরনের বিকল্প নেই। যোগ্য,সৎ ও আদর্শবান নেতা ব্যতিত কোন আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা হতে পারে না। তাই পরিবার, সমাজ, দল ও রাষ্ট্র নিখুঁতভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের। যার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হবে পরিবার, সমাজ, দল বা রাষ্ট্রের লোকজন। আর এই আনুগত্যের মাধ্যমে সমাজে শান্তির সুবাতাস বইবে। প্রতিটি মৌচাকেই একজন রাণী থাকে যার নেতৃত্বে মৌ বাহীনি চলে। নিজেদের সম্পূর্ণ রুপে তার কাছে সোপর্দ করে দেয়। সে যেভাবে পরিচালনা করবে সেটাই শিরোধর্য। তদ্রুপ প্রকৃত মুমিনগন তাদের নেতাকে পূর্ণরুপে আনুগত্য করে। নিজেদের মাঝে বিবাদ করে না। সম্প্রতি ও সৌহর্দ্য বজায় চলে। মহান আল্লাহ বলেন: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।(সূরা নিসা:৫৯)
উৎকৃষ্ট জিনিস ভক্ষণ করে: মৌমাছি যে কোন যায়গা থেকে মধু আহরণ করে না। অপবিত্র ও অপরিচ্ছন্ন যায়গায় বসে না। পবিত্র জিনিস সে আহরণ করে। তার মুখ থেকে নি:সৃত মধুও স্বচ্ছ ও পবিত্র। তেমনি একজন মুমিন ও তার অন্তর স্বচ্ছ, ঈমানের আলোয় আলোকিত। অন্তর কলুষমুক্ত। আর তাঁর বিশুদ্ধ অন্তর উৎকৃষ্ট জিনস পছন্দ করবে। তখন তার উপার্জন,তার কথা ,ইবাদাত,খাবার,পানীয় ও পরিধান করার আসবাবপত্র সব হবে পবিত্র। যেটি হাদীসে এসেছে। আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন: হে লোক সকল ! আল্লাহ তা’আলা পবিত্র। তিনি পবিত্র জিনিস ব্যতীত কিছু কবুল করেন না। আল্লাহ তাঁর রাসূলদেরকে যেসব বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন, মু’মিনদেরকেও সেসব বিষয়ের হুকুম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকাজ কর। তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবগত” (সূরা আল-মু’মিনূন ৫১)। তিনি আরো বলেনঃ “হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমি যে রিযিক দিয়েছি তা হতে পবিত্র বস্তু আহার কর” (সূরা আল বাক্বারাহঃ ১৭২)। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত এবং সারা শরীর ধূলি মলিন। সে আসমানের দিকে হাত দরায করে বলে, হে আমার প্রভু! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দু’আ কিভাবে কবুল হতে পারে?(জামে তিরমিজি:২৯৮৯)
কোন কিছুর ক্ষতি করে না: মৌপোকা যে কোন ফুলের উপর বসে না। বরং ফুলের ওপর বসতে গিয়ে তারা প্রথমে লক্ষ্য করে যে, তারা যদি ফুলের ওপর বসে, তবে ফুলটির কোনো ক্ষতি হবে কি না? এরপর তারা বিবেচনা করে ফুলের মাঝে মধুর পরিমাণ ও অবস্থা। যদি মধু আহরণ করার উপযুক্ত হয় তাহলে তারা শুধু ফুল থেকে ততটুকু মধুই গ্রহণ করে, যতটুকু গ্রহণ করলে ফুলের পরাগায়ন-গর্ভধারণ এবং ফল ফলাতে কোনো সমস্যা না হয়। এর ব্যতিক্রম হলে মৌমাছিরা শুধু ওড়ে কিন্তু বসে না- বরং অন্য ফুলের কাছে চলে যায়। তেমনি মুমিনগন কারো ক্ষতি করে রিযিক অন্বেষণ করে না। যে সকল যায়গায় গেলে ক্ষতি সম্ভাবনা রয়েছে সেখান থেকে এরিয়ে চলে। বরং তারা মানুষের কল্যাণে সর্বদা এগিয়ে আসে। ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান করে আর মন্দ কাজ থেকে নিজেও দূরে থাকে ও অন্যকে বাধা প্রদান করে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, ‘ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতি সহ্যও করা যাবে না। যে অন্যের ক্ষতি করল আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে তার সঙ্গে শত্রুতা করবে আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন।’ (সুনানে দারা কুতনি, হাদিস: ২৮৮)
তারা কর্মঠ ও পরিশ্রমী: মৌমাছি উদ্যমতার সাথে সে তার কাজ করে যায়। কারণ অলসতা উদ্যমহীন ও কর্মবিমুখতা কোন জাতির উন্নতি বয়ে আনতে পারে না। বরং তা নিজেদের অবক্ষয় ডেকে আনে। তাই মধুফোকা সর্বদা তার নিজেদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যায়। তেমনি একজন মুমিন তার জান মাল সময় সামর্থ দিয়ে উদ্যমতার সাথে কাজ করে যায়। এর দ্বার সে সফলতার মুখ দেখতে পায়। কারণ পরিশ্রম হলো উন্নতির অন্যতম সিঁড়ি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত।
আমানতদার: মৌমাছিরা মধু আহরণ থেকে নিয়ে পৌছানো পর্যন্ত পূর্ণ আমানতদারীর সাথে দায়িত্ব পালন করে। তারা তাদের রাণীর আদেশ এমনভাবে পালন করে যে এক এক বিন্দু মধুও তাদের পাকস্থলিতে রাখে না। কখনো তারা মধুকে নিজের সম্পদ মনে করে না। তেমনি একজন মুমিন তার সম্পদ তার কাছে আমানত মনে করে। যত্রতত্র ব্যবহার করে না। নিষিদ্ধ পথে ব্যয় করে না। যে পথে ব্যয় করলে আল্লাহ ও তার রাসূল খুশি হবেন সে পথেই ব্যয় করে। বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করে সম্পদ নষ্ট করে না। (ফয়জুল কাদীর :৫১১)
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা-১২৩০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন