গত ২২ আগস্ট ময়মনসিংহের ভালুকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৪জনসহ ৬ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের বহনকারী প্রাইভেটকার ইউটার্ন নেয়ার সময় একটি বাস তাকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গত ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলপুরে একটি মাইক্রোবাস উল্টে পুকুরে পড়ে গেলে এক পরিবারের কয়েকজনসহ ৬ জন নিহত হয়। খবরে বলা হয়, চালক ঘুম ঘুম অবস্থায় মাইক্রোবাসটি চালাচ্ছিল। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তা পুকুরে গিয়ে পড়ে। গত ৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি নৈশকোচ চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জে কয়েকটি ভ্যান ও কয়েকজন যাত্রীকে ধাক্কা দিলে ৬ জন নিহত হয়। দীর্ঘ বাস চালনায় ক্লান্ত ও ঘুম ঘুম ভাবের কারণে বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি বলে প্রকাশ। চলতি মাসে দেশে আরো সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৩টি ঘটনা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হলো এ জন্য যে, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব বা অদক্ষতা যেমন দুর্ঘটনার কারণ, তেমনি চালকদের অবিরাম যান চালনাজনিত ক্লান্তি ও ঘুমভাবও দুর্ঘটনার কারণ। আর এও দেখা যাচ্ছে, একেকটি দুর্ঘটনায় পুরো পরিবার পর্যন্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই বিশেষ উদ্বেগের বিষয়।
করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার আগে প্রায় এমন কোনো দিন ছিল না, যে দিন সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি না ঘটেছে। করোনাকালে যাতায়াত-যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ায় দুর্ঘটনা কম হয়েছে। পুনরায় সব কিছু খুলে দেয়ার প্রেক্ষাপটে যানবাহন চলাচল প্রায় আগের অবস্থায় এসে গেছে। সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশ কার্যত লকডাউনের আওতায় ছিল। এ সময়ও সড়কে ১২০৫ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগের দু’মাসের দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৭০০’র বেশি। ৭ মাসে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এটা সহজেই অনুমান করা যায়, এই যে প্রতি বছর এত মানুষ নিহত হচ্ছে, তার মধ্যে একই পরিবারের একাধিক সদস্য কিংবা পুরো পরিবারও রয়েছে। নিহতদের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও আছে। কোনো পরিবারের একাধিক সদস্য হারানো ওই পরিবারের জীবিত সদস্যদের জন্য কতটা বেদনাদায়ক, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তেমনি পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনা আত্মীয়-স্বজনদের জন্য মর্মন্তদ বললেও কম বলা হয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যখন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তখন ওই পরিবার সম্পূর্ণ নিরালম্ব হয়ে পড়ে। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়, তাদেরও কম সংখ্যকই স্বাভাবিক জীবন ও কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়। এভাবে প্রতিবছর কত পরিবার যে বিপর্যস্ত ও অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই। এক সময় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়েছিল। ক্ষতিপূরণের জন্য বিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিধির এখনো কোনো হদিস নেই। কবে বিধি পাস ও কার্যকর হবে এবং প্রাপক ক্ষতিপূরণ পাবে, কেউ বলতে পারেনা। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে আছে। দ্রুত বিচার, উপযুক্ত শাস্তি এবং দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অনেক কমতো। সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা রোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। যানবাহনের লাইসেন্সসহ নানা ক্ষেত্রে টাকা আদায় করার ব্যাপারে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খুবই পারঙ্গম। অথচ সেবার কোনো দেখা নেই। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই অবহিত। বলা হয়ে থাকে, চালক অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুললে দুর্ঘটনা কমতে পারে। এদিকে সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের নজর নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’বছর আগে দূরপাল্লার যানবাহনের জন্য দু’জন চালক এবং সড়ক-মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে ১৪ লাখ ভুয়া চালক আছে। তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
দুর্ঘটনার জন্য একমাত্র চালকই দায়ী নয়। ত্রু টিপূর্ণ যানবাহন, রাস্তার অপ্রশস্ততা, ট্রাফিক ব্যবস্থার ত্রু টি, সড়ক-মহাসড়ক দখল, ধীরগতির যানবাহন চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই ইত্যাদিও দায়ী। কাজেই, দুর্ঘটনা কমাতে হলে চালকদের, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষ চালকদের নিয়োগ দিতে হবে। তেমনি গোটা সড়ক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন সাধন করতে হবে। কোথায় যানবাহনের গতি শ্লথ করতে হবে, ইউটার্ন নিতে হলে কীভাবে নিতে হবে, এটা যেমন চালকদের জানতে হবে, তেমনি যাত্রী-পথচারীদেরও জানতে হবে চলাচলের নিয়ম-কানুন। ট্রাফিক বিধি মান্য করা চালকদের জন্য বাধ্যতামূলক। একইভাবে যাত্রী- পথচারীদের জন্যও বাধ্যতামূলক। দুর্ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে কাউকে দায়ী করা ঠিক নয়। কার ত্রু টি বা ভুলের জন্য দুর্ঘটনা, সেটা আগে জানতে হবে, তার পরে আঙুল তুলতে হবে। কার্যত সড়ক ব্যবস্থাপনা বিশৃংখল ও ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে সুশাসনের আওতায় এলে তা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে এর বিকল্প নেই। তথ্য হলো জ্ঞান, যা মানুষকে সমৃদ্ধ, সতর্ক ও সাবধান হতে অনুপ্রাণিত করে। এ নিরিখে সড়ক সংক্রান্ত বিধিবিধান সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনসহ নানাভাবে এই প্রচারণা চালাতে পারে। এব্যাপারে পুলিশও তার সহযোগী হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আকস্মিক ও অনভিপ্রেত। এটা কমাতে পারলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আসবে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষয়ক্ষতিও কমবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন