র হি মা আ ক্তা র মৌ
নিপুদের বাড়ি থেকে স্কুল যেতে তিনটা রাস্তা পড়ে। একটা রাস্তা ওদের বাড়ির সাথে, আর একটা রাস্তা স্কুলের সাথে। নিপুরা চার ভাইবোন। নিপু মেঝো। ছোট দুই ভাই নিপুর বেশ কয়েক বছরের ছোট। নিপু আর নাজু মাত্র একবছর এগারো মাসের বড় ছোট।
নিপু যেমন দুরন্ত নাজু ঠিক তেমনি শান্ত। কথায় কথায় অন্যরা বলে মেঝোগুলো এমনিই হয়। মানে মেঝোগুলো একটু দুষ্ট হয়। এই বিষয়টা কাজে লাগায় নিপু। যখন নিজে দোষ করে, নিজেই বলে...
-মেঝোরা একটু এমনি হয়।
আবার অন্য সময় বলে...
-আমি আবার মেঝো হলাম কবে? আমার মা-বাবার দুই ছেলে দুই মেয়ে। এখানে কেউই মেঝো নেই। দুষ্টের কথা শুনে সবাই হাসে।
স্কুলে যাবার তিন রাস্তার মাঝে আছে বড় দুটি মাঠ। খেলার মাঠ নয়। ফসলি মাঠ। যেখানে শুধু ধান আবাদ হয়। বর্ষার সময় পুরো মাঠে পানি উপচে পড়ে। রাস্তার অনেক অংশও ডুবে যায়। কিছু জায়গা উঁচু কিছু জায়গা নিচু।
ওদের বাড়ি থেকে স্কুল যেতে শুকনো সময়ে মাঠের মাঝে দিয়ে হেঁটে যেতে পনেরো-ষোল মিনিট লাগে। ফসলি মাঠে পানি উঠলে ঘুরে যেতে সময় লাগে পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট।
বর্ষার সময় যখন পুরো মাঠে আর রাস্তা ডুবে যায় তখন স্কুলে যাওয়া খুব কষ্টকর। সে সময় দুটো পথ খোলা থাকে। হয় বড় রাস্তা ঘুরে ঘুরে যেতে হয়, সময় লাগে ঘণ্টার উপরে, নয়তো নৌকায় করে।
নিপুদের নিজের কোন নৌকা নেই। তবে হেদায়েত কাকাদের আছে। কিন্তু হেদায়েত কাকার মেয়ে নুরী লেখাপড়ায় খুব ফাঁকিবাজ। স্কুলে না যেতে পারলেই বাঁচে। আর দুষ্ট নিপু লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ হলেও স্কুল যাওয়ায় তার কোন আলসেমি নেই। বলতে গেলে নিপু স্কুলে যায় ভালো সময় কাটাতে, বান্ধবীদের সাথে হৈ হুলো করেই দিন পার করে।
কিন্তু পুরো বর্ষার সময় স্কুল না গেলে তো নিপু একেবারে বন্ধি হয়ে যাবে। স্কুলে যাবার জন্যে ছটফট করে। নিপুর মা সানু বলে...
-এত স্কুল স্কুল করছিস, যাবি কি ভাবে। ওত রাস্তা ঘুরে যাওয়ার দরকার নাই।
-মা তুমি হেদায়েত কাকাকে বলো আমাদের একটু কোষা নৌকায় করে দিয়ে আসতে।
-তা কি করে, নুরী তো যাবে না। নুরী গেলে না হয় ওরা সাথে যেতে পারতি।
-মা তুমি তো জানো নুরী খুব অলস, ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
-তা হলে যাবার দরকার নেই।
নিপুর মাথায় তখন বুদ্ধি ফুটতে থাকে। যে ভাবে হোক নুরীকে স্কুলে যাবার জন্যে রাজি করাতে হবে। সকাল হলেই নুরীর পেছনে ছুটে। স্কুলে যেতে রাজি করাতে চায়। কিন্তু নুরীর এক কথা...
-আমার যেতে ভালো লাগে না। তার উপর কত হোমওয়ার্ক দেয়। আমি যাব না। নুরী আর নিপু একই ক্লাসে পড়ে। নিপু নুরীকে বলে...
-তোকে হোমওয়ার্ক নিয়ে ভাবতে হবে না। তা আমিই করে দিব। তবুও চল সবাই মিলে স্কুলে যাই।
নুরী দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বলে...
-বাবা আমি স্কুলে যাব। তুমি আমাকে কোষা নৌকায় করে দিয়ে আসো।
বাবাতো আর মেয়ের কথা ফেলিতে পার না, ফাঁকিবাজ মেয়ে স্কুল যেতে চেয়েছে, এ তো অনেক কিছু।
-যাও রেডি হও। আমি নৌকা বের করছি।
নুরী দ্রুত গিয়ে নিপু আর নাজু আপাকে খবর দেয়। সবাই মিলে কোষা নৌকায় করে স্কুলে যায়।
বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করে ফসলের মাঠে। ধানের খেতে শাপলা আর পদ্মফুল। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। কোষা নৌকার একেবারে সামনে বসে নিপু। দুপাশে হাত বাড়িয়ে শাপলা তোলে নেয়। পদ্মপাতায় ব্যাঙাচি বসে থাকে, নিপু ব্যাঙাচিকে ভয় দেখিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। স্কুল পৌঁছে বুদ্ধি করে কৌশলে হেদায়েত কাকাকে বলে...
-কাকা ছুটির সময় আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমরা আস্তে আস্তে চলে যাব।
স্কুল ছুটি হলে সেই ডুবে যাওয়া রাস্তা দিয়ে ওরা একসাথে বাসায় ফিরে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও তার চেয়ে বেশি। দুষ্ট নিপু ইচ্ছা করেই এপাশ ওপাশ করে পড়ে যায়। এরপর কোমর বা গলা ভিজিয়ে বাড়ি ফিরে।
কয়েকদিন এইভাবে যাওয়ার পর নুরী আবার মত পালটায়। যাবে বলে দেয়। কিন্তু নিপু নতুন বুদ্ধি খুঁজতে থাকে। নিজের ভাগের টিফিনটুকু নুরীকে দিবে বলে ও প্রতিশ্রুতি দেয়। তবুও তার স্কুল যাওয়া চাই।
বর্ষার শেষের দিকে শাপলা ফুলগুলো পাকা পোক্ত হয়ে ভ্যাট হয়। নিপু স্কুল যেতে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয়।
এখন সে সবের কিছুই নেই। ফসলের মাঠের অর্ধেক ভরে গেছে নতুন বসত বাড়ি দিয়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। এইসব দেখে নিপুর মন খারাপ হয়। তবে সেই কাঁচা রাস্তা এখন পাকা হওয়ায় খুব খুশি নিপু। সেই কষ্ট এখন করতে হয় না কাউকে।
নিপু বলে যেমনি কষ্ট হয়েছে, আনন্দের মাত্রা ছিলো অনেক বেশি। এখন পুরো গ্রাম খুঁজলে দু-একটা কোষা নৌকা খুঁজে পাবে না কেউ। শহরের বহুতল ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখে আর কল্পনায় হারায়, অজান্তেই ঘুরে বেড়ায় সেই কোষা নৌকায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন