করোনা মহামারী ইতোমধ্যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করেছে। শুরুর দিকে এই ভাইরাসের আগ্রাসনের তীব্রতা দেখে সাতশ কোটি মানুষ আতংকিত ছিল, ঘরবন্দি ছিল। এখন আতংক কিছুটা কমলেও নানান পেশার মানুষের জীবন স্বাভাবিক হয়নি। কার্যত মার্চ/২০২০ থেকে জুন/২০২০ পর্যন্ত করোনাভাইরাস বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের ৫০ লাখ শ্রমিক, শপিংমলের দোকান মালিক এবং কর্মচারী, পর্যটন পেশার সমুদয় মানুষ, পরিবহন শ্রমিক, লাখ লাখ রিকশাচালক, হোটেল রেস্টুরেন্ট কর্মচারীসহ বহু পেশার মানুষকে কর্মহীন করে রেখেছিল। এখন মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কারণ এর বিকল্প নেই। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স এবং কৃষিখাত এই তিনটিকে বিবেচনা করা হয়। পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্স পুরোপুরি সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতির গতি এবং ইচ্ছার সাথে সর্ম্পকযুক্ত। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি করোনা মহামারীর শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং আরও অনেক দেশ যখন তৈরী পোশাক কারখানার ক্রয় আদেশ একের পর এক বাতিল করল। যেকারণে সরকার বাধ্য হলো এই খাতে প্রথমেই প্রণোদনা ঘোষণা করতে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭ লাখ লোক বিদেশে কাজ করতে যেতো এবং এদের বড় অংশ তরুণ। মার্চ/২০২০ থেকে থেকে আগস্ট/২০২০ পর্যন্ত কোন শ্রমিক বিদেশ যেতে পারেনি। উপরন্ত অনুমান করা হচ্ছে, বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে প্রবাসী শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে ফিরবে। এক জাতীয় দৈনিকে দেখলাম সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস ঢাকায় পাঠানো চিঠিতে বলেছে, আগামী তিন বছর ১০ লাখ বাংলাদেশি চাকরি হারাতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারিয়েছে ১৭ লাখ তরুণ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রভাবে জুন/২০২০ পর্যন্ত কর্মহীন হয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়া লোকের সংখ্যা ১৬ শতাংশ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর এক গবেষণা হতে দেখা যায়, দেশে জীবিকা নির্বাহের ভালো সুযোগ পেলে ৯৯ শতাংশ সম্ভাব্য অভিবাসী দেশেই থাকতে চান। আইওএম-এর আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি/২০২০ হতে জুন /২০২০ সময়কালে যেসব প্রবাসী দেশে ফিরেছেন তাঁদের ৭০ শতাংশ জীবিকা সংকটে পড়েছেন আর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন ৫৫ শতাংশ। একমাত্র কৃষি খাত আমাদের নিজস্ব। দেশে করোনার চরম আগ্রাসনের সময় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা বন্ধ হলেও একমাত্র যে খাতটি সচল ছিল তা হলো কৃষি। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন কমেছে এমন কথা কেউ বলেননি। বিগত এক দশকে ধারাবাহিক উন্নয়নের মাধমে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং মাছ উৎপাদনে চতুর্থ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-২০১৮ এর তথ্য মতে, কৃষিখাতে নিয়োজিত জনশক্তি ২ কোটি ৪৩ লাখ। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের আরও সুযোগ রয়েছে; সুযোগ রয়েছে এই জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি জীবনমান উন্নয়ন এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে হতে দেখা যায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি ও খাদ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় করেছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ^ব্যাংক জানিয়েছে, প্রতিবছর খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানি করতে বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর আমাদের ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানিতে ব্যয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, ডাল জাতীয় শস্য আমাদানিতে ব্যয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, পেঁয়াজ আমদানিতে ব্যয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা, গম আমদানিতে ব্যয় প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা, চিনি আমদানিতে ব্যয় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা, সুগন্ধী চাল,আদা, রসুন অন্যান্য মসলা আমদানিতে ব্যয়ের পরিমাণ মোটেও কম নয়। বীজ ফসল আমদানি ব্যয়ের সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও এর পরিমাণ সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) কৃষকের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ বীজ সরবরাহ করতে পারছে আর বীজ কোম্পানীগুলো সরবরাহ করছে ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো। ফলে স্থানীয় কৃষকের উৎপাদিত ৮০ শতাংশ মানহীন বীজ ব্যবহার হচ্ছে ফসল উৎপাদনে। প্রয়োজনীয় বীজ উৎপাদন করতে না পারায় জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নানাভাবে। বীজ আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে; বীজের অপ্রতুলতা কাজে লাগিয়ে মানহীন বীজের প্যাকেটে আমদানিকৃত উচ্চফলনশীল বীজের ট্যাগ লাগিয়ে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা; আর সকল উপকরণ প্রয়োগ করে কাংখিত ফসল পাচ্ছেনা কৃষক। কৃষি বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, শুধুমাত্র উন্নতমানের ভালো বীজ ব্যবহার করে ২০ থেকে ২৫ ভাগ ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমরা যদি গবেষণার মাধ্যমে ফসলের জাত উন্নয়ন, উন্নত চাষপ্রযুক্তি প্রবর্তন, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ এবং বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে পারি তাহলে কৃষিপণ্য ও বীজ ফসল আমদানিখাতে যে ব্যয় তা দেশেই রয়ে যাবে। সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান এবং নতুন উদ্যোক্তা। বিদেশ ফেরত কর্মী এবং বেকার তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় একটি ক্ষেত্র হতে পারে প্রাণিসম্পদ। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও ঢাকা মেট্টোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতি গত ১১ জুলাই ২০২০ খ্রি: তারিখে সংবাদ সম্মেলনে দাবী করেন, পাশর্^বর্তীদেশগুলো গরু পাচার করে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর নিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। তাঁরা এও বলেছেন পশুপালন খাতে বাংলাদেশের কৃষকদের কৃষিঋণের মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে প্রতিবছর ৬০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
সমগ্র দুনিয়া যখন করোনা মহামারী থেকে নিজেদের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শত রকম স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে তখন আমাদেরও সার্মথ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে সাজাতে হলে যেসব কৃষিপণ্য দেশে উৎপাদন হয় তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমদানি বন্ধ করে উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন কৃষি গবেষণা বাড়ানো এবং যারা কৃষিকাজে নিয়োজিত তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষে নিতে হবে। বিদেশ ফেরত রেমিট্যান্স যোদ্ধা যারা কৃষি কাজে আগ্রহী তাঁদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলাও প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, যখন দেশের খামারীগণ বুঝতে পারলো কুরবানির জন্য বিদেশ থেকে আর গরু আনা হবেনা তার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে কুরবাণীর পশুতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেলাম। এক কোটির অধিক কোরবানির পশু ঈদ মৌসুমে বিক্রি করে অন্তত ৫০ লাখ প্রান্তিক কৃষক/খামারী ভালো অংকের টাকা হাতে পায়। কারো কারো বছরের খরচের টাকা হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে বহুশিক্ষিত তরুণ গরু মোটাতাজাকরণ খামার গড়ে তুলেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে (২০১৮) দেশে দুধের ঘাটতি ছিল প্রায় ৭০ লাখ টন। আমার বিশ্বাস যদি দুগ্ধ খামারীরা নিশ্চিত হতে পারে আর দুধ আমদানি হবে না তা হলে আগামী ৩ বছরের মধ্যে দুধ উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো। কারণ ঘাটতি থাকার পরও যখন দুধের ন্যায্য মূল্য পেতে খামারীকে আন্দোলন করতে হয় তখন বিদেশ ফেরত ব্যক্তি বা বেকার তরুণ উদ্যোক্তা হবার সাহস পায়না। অথচ প্রতিবছর কৃষিপণ্য এবং বীজ ফসলের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে আমাদের আরও জোর দিয়ে ভাবতে হবে কারণ প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ২২ থেকে ২৫ লাখ তরুণ। সরকার করোনার কারণে বিদেশ ফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংককে ৫শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসার পর ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা ঋণ পাচ্ছেন আর বিমান বন্দরে ফিরেই পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা। সরকার তাঁর সাধ্যমতো প্রবাসীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সমস্যা হলো, আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ৯৮% অদক্ষ শ্রমিক। এই অদক্ষ শ্রমিক ভাইয়েরা দেশে ফিরে টাকা পেলেই উদ্যোক্তা হয়ে যাবে তা সম্ভব নয়। তাই সরকারের শুধু বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের নয়, দেশে যারা কৃষি ভিত্তিক পেশায় নিয়োজিত আছেন এবং কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ খাতে যারা উদ্যোক্তা হতে চান তাঁদেরকে কারিগরিভাবে স্বাবলম্বী করে দেয়া। কারণ মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যতজন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হয়েছেন তার চাইতে বেশি উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সঠিক কারিগরি জ্ঞান না থাকা এবং বাজারমূল্য স্থিতিশীল না থাকার কারণে। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে পারলে করোনা মহামারী মোকাবেলায় এবং করোনা পরবর্তী সময়ে আধুনিক কৃষি হতে পারে দেশের বেকার সমস্যা সমাধান এবং স্বনির্ভরতার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র।
লেখক: কৃষিবিদ, টিভি নাট্যকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন