বোরো বীজতলা শুকিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে
বোরো আবাদে বাড়ি সেচ খরচে দিশেহারা কৃষক
খরায় ঝরে পড়ছে আম ও লিচুর মুকুল
খনার বচনে আছে- ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্য রাজার পূর্ণ দেশ’। তবে এবছর পৌষ গেল মাঘ গেল, ফাগুনেরও ১ সপ্তাহ চলে গেল, বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় বসন্তেই গ্রীষ্মকালের খরার কবলে পড়েছে দেশ। নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, নালা সব শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। গ্রীষ্মের মতো বিল-মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির। পানির উৎসগুলো প্রায় সর্বত্র পানিশূন্য হয়ে গেছে। সেই সাথে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর স্থানভেদে কোথাও ৮ থেকে ১০ ফুট, কোথাও ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচের দিকে নেমে গেছে। ন্যূনতম স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে চারদিকে রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি। কৃষি-খামার, জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব।
এই খরা পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সর্বত্র, বোরো আবাদ, মৌসুমী ফল ও ফসল, ক্ষেত-খামার, মাছের চাষ থেকে শুরু করে সমগ্র কৃষি খাত চরম সঙ্কটাপন্ন। ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদ। বোরো ধানের বীজতলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও বা শুকিয়ে আগুনে পোড়ার মতো লাল হয়ে যাচ্ছে। ফলের বাগান শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আমের মুকুল ও লিচুর মুকুল ঝরে পড়ছে। চাষাবাদে পানির অভাব পূরণ করতে গিয়ে সেচের বাড়তি খরচ জোগাতে কৃষকের হিমশিম অবস্থা। অনাবৃষ্টি-খরার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিজমি ও খাবার পানিতে লবণাক্ততার আগ্রাসন বৃদ্ধি পেয়েছে।
আবহাওয়া বিভাগের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে দেশের কোথাও সামান্য বৃষ্টিপাতও হয়নি। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি টানা ৩ মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টির শতকরা ৮৮ ভাগই ঝরেনি। অর্থাৎ গেল ৩ মাসেরও বেশি সময় অনাবৃষ্টিতে কেটেছে। চলতি ফেব্রæয়ারি ও আগামী মার্চ মাসেও স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত অর্থাৎ খরা-অনাবৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে আবহাওয়া পূর্বাভাসে এমনটা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় খরাদশা চলতে পারে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ মাস।
দীর্ঘসময় বৃষ্টি না হওয়ায় বোরো আবাদসহ অন্যান্য ফল-ফসল আবাদ পুরো সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় অর্থাৎ ভ‚-উপরিভাগের পানির সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় এখনই ভ‚গর্ভস্থ পানি অত্যধিক হারে উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নামছেই। ভয়াবহ মাত্রায় হ্রাস পাচ্ছে ভ‚-উপরিভাগ ও ভ‚গর্ভস্থ পানির স্টক। মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টিও না হওয়ায় মাটির উপরের উৎসগুলোতে এবং মাটির নিচে পানি রিচার্জ হচ্ছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় খরার ঝুঁকি আরও বাড়ছে এবং তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়ছে কৃষি খাত। দীর্ঘসময় অনাবৃষ্টির ফলে সারাদেশে কৃষি খাতের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন রফিক মুহাম্মদ।
রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর চলে গেছে অনেক নিচে। খরার উচ্চ ঝুঁকিতে রাজশাহীসহ উত্তরের ছয় জেলা। দেশের ২২ জেলা খরার ঝুঁকিতে থাকলেও খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ছয় জেলা। এগুলো হলো: রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের বাংলাদেশ ক্লাইমেট এন্ড ডিজাষ্টার রিকস এটলাস শীর্ষক প্রতিবেদনে এতথ্য এসেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে মওসুমভিত্তিক জলবায়ুর এলোমেলো আচরণে শীত হচ্ছে স্বল্পকালীন খরা হচ্ছে প্রলম্বিত। কমে গেছে ভয়ানকভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। বৃষ্টিনির্ভর ফসল এখন সেচনির্ভর ফসলে পরিণত হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে বছরজুড়েই মাটির নিচ থেকে পানি তুলে চাষাবাদ করা হচ্ছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাতালের পানি পুনঃভরন হচ্ছে না। ফলে পানির স্তর নামছেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে অনেক স্থানে পানির নাগাল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মোটা দাগে রাজশাহী অঞ্চলের পানি সঙ্কট তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ হিসেবে লাইফলাইন খ্যাত প্রমত্ত পদ্মা নদীকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। পদ্মা নদীর ওপর ভারতের ফারাক্কাসহ অসংখ্য ড্যাম ব্যারেজ ক্যানেল দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহারের মধ্যদিয়ে এর মরণ দশা শুরু হয়েছে। যার ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের সর্বক্ষেত্রে। পদ্মা মরে যাওয়ায় অর্ধশত শাখা নদনদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। খাল বিল বছরজুড়ে থাকছে পানিশূন্য। ফলে কৃষি মৎস্য নৌপথ জীববৈচিত্র্য সব হারিয়ে সব ক্ষেত্রেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে। জেলে, মাঝি তার পেশা বদলিয়েছে। নদীভাঙনে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আব্দুল সালামের অভিমত রাজশাহী এমনিতে উষ্ণতম জেলা। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। ফলে খরা প্রলম্বিত হচ্ছে। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বয়ে এনেছে প্রলম্বিত খরা। টানা বৃষ্টিহীনতা এমনকি শীত মৌসুমেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না হওয়া। সবকিছু মিলিয়ে পানির শঙ্কা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। দীর্ঘসময় বৃষ্টি না হওয়ার ফলে বোরো আবাদ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি খরার কবলে ঝরে পড়ছে আমের মুকুল। আম বাগানেও এখন সেচ দিতে হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি নিয়ে কাজ করছেন প্রফেসর ড. সরওয়ার জাহান সজল বলেন, মৌসুমভিত্তিক জলবায়ুর যে স্ট্রাকচার তা এখন আর ঠিক নেই। এখন সময়ে বৃষ্টি না হয়ে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে গরম বাড়ছে। খাদ্যনিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বরেন্দ্র অঞ্চলে অধিক পরিমাণে ধান চাষ হচ্ছে। অন্যান্য ফসলও আবাদ হচ্ছে। এতে ভ‚গর্ভস্ত পানির উপর চাপ বাড়ছে। পানির স্তর ক্রমশ: নিচের দিকে নামছে। এরমধ্যে রাজশাহীতে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। যে পরিমাণ পানি চাষাবাদের জন্য উত্তোলন হয়, তার রিচার্জের পরিমাণ অনেক কম। ফলে পানির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরনে ভ‚গর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, সাড়ে তিন মাস হয়ে গেল বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে বগুড়ার করতোয়া, বাঙালি, ইছামতি, নাগর, গাঙ নৈ প্রভৃতি নদনদীসহ খালবিল সব শুকিয়ে গেছে। ফলে এ মৌসুমের প্রধান ফসল বোরো ধান ও বোরো ধানের বীজতলাসহ অন্যান্য ফসল সম্পূর্ণ সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে বেড়ে যাবে ফসলের উৎপাদন খরচ। একই সাথে নদনদী ও খালবিলের ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা পড়েছে চরম বেকায়দায়।
বগুড়া সদরের শাখারিয়ায় অবস্থিত বৃহত্তম নুরইল বিলের পাশের জেলে পল্লির জেলেরা জানিয়েছেন, এমন খরা ও একটানা বৃষ্টিহীন পরিবেশ তাদের স্মরণে আাসে না। তারা বলেন, বিল নুরুইল চৈত্র-বৈশাখের আগে শুকায় না। অথচ এবার মাঘ মাসেই শুকিয়ে গেছে বিল নুরুইল। ফলে তাদের এখন বেকার জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
নামুজা এলাকার একটি ৩০ বিঘা আমবাগানের মালিক জাহেদুর রহমান জানালেন, এবার মধ্যমাঘেই তার বাগানের গাছগুলো ঝাঁকড়া আমের মুকুলে ছেয়ে গেছে । কিন্তু এখন বৃষ্টির অভাবে সেগুলো শুকিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ২/১ দিনের মধ্যে ভারি বৃষ্টিপাত না হলে এবার আমের উৎপাদন খুবই কমে যাবে বলে তার আশঙ্কা। বগুড়ার কৃষি কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এ সপ্তাহের মধ্যে ২/১ বার মাঝারি বা ভারী বৃষ্টিপাত হলে আমজাতীয় ফলের তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
সিলেট থেকে ফয়সাল আমীন জানান, চলতি মৌসুমে ব্যাপক পরিমাণ অনাবাদি জমি বোরো চাষের আওতায় এসেছে সিলেটে। কিন্তু বোরো চাষে পর্যাপ্ত সেচের পানি না থাকায় বিড়ম্বনার শেষ নেই কৃষকদের। হাওর অঞ্চলে বিলের মৎস্য আহরণ শেষ হওয়ায় সেগুলো পানি শুকিয়ে তলানিতে। তাই বোরো ধানে পানি সেচ নিয়ে সংগ্রাম চালাচ্ছেন কৃষকরা। এছাড়া পানি সেচে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
এখন মৌসুমি সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যস্ত কৃষকরা। সামনে বৃষ্টি দেখা মিলবে, এতে কৃষকদের মধ্যে আসবে স্বস্তি। অপরদিকে, সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে আমের উৎপাদন না হলেও প্রায় প্রতি বাড়িতে প্রচুর আমের গাছ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে এ আমে চাহিদার বড় একটি অংশ এতে পূরণ হয়। এবারও গাছে গাছে মুকুল এসেছে। তবে বৃষ্টি না হলে সেই মকুল ঝরে পড়বে।
কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক জানান, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় শুকিয়ে গেছে, খাল-নদী-পুকুর। শুকিয়ে গেছে, প্রধান প্রধান নদী বাঁকখালী, মাতামুহুরীসহ শাখা নদীগুলোও। এর উপর অনাবৃষ্টি ভাবিয়ে তুলেছে কক্সবাজারের কৃষকদের। এতে করে সমস্যা হচ্ছে বোরো চাষ ও সবজি চাষে। আর এতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে খাদ্য উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে।
বাঁকখালী, নাফনদী, ঈদগাঁও, ফুলেশ্বরী ও মাতামুহুরীসহ নদীগুলোর উৎপত্তিস্থলের বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য জানা না থাকলেও ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই নদীগুলোর স্রোত। খরস্রোতা বাঁকখালী নদীর কিছু অংশ ঘিরে রয়েছে জেলার কক্সবাজার সদর, রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা।
এদিকে চলতি শুষ্ক মৌসুমে পুকুর, নদী-খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কক্সবাজার জেলায় খাদ্যে উদ্ধৃতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। জেলার ফসলি জমিতে পানি সরবরাহের অন্যতম খাল-নদী শুকিয়ে গেছে। প্রধান নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ নেই বললেই চলে। প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর দুই পাড়ে বোরো আর রবিশষ্যের যে উৎপাদন হত তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ভোক্তভোগী কৃষকদের মতে প্রায় ৫০০ হেক্টরের বেশি জমিতে বোরো ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না কৃষক। তবে কৃষি কর্মকর্তা ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপক‚লীয় এলাকায় পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক কৃষকের মতে, ‘নদীতে এক ফোটা পানি নেই স্কিম কর্তৃপক্ষ কয়েকটি গভীর নলক‚প বসিয়েও পানি সরবরাহ করতে পারছে না। সব মিলে চলছে পানির তীব্র সঙ্কট।
মানিকগঞ্জ থেকে শাহীন তারেক জানান, দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না থাকায় মানিকগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে ভয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল বিল পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। নদীতে পানি না থাকায় জেলেরা নদী থেকে মাছ শিকার করতে পারছে না। এতে বিপাকে পড়েছে জেলার শত শত জেলে পরিবার। অপর দিকে ফসলি জমিতেও এর প্রভাব পড়েছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বিকল্প উপায়ে শ্যালোমেশিন দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে করে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে ঝিটকা উজানপাড়া গ্রামের কৃষক করিম দেওয়ান জানান, আবাদের শুরু থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় হালি পেঁয়াজ ও বিন্দুমরিচের ক্ষেতে শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে। এতে আমাদের খচর বেড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টির দরকার। বৃষ্টি নেই বলেই মেশিন দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে।
নেত্রকোণা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ্ জানান, গত দুই মাসেরও বেশি সময় বৃষ্টি না হওয়ায় নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠের ফসলি বোরো জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নেত্রকোণা জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪ শত ৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো আবাদ করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমি। বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদী খাল বিলগুলো শুকিয়ে গেছে। কৃষকরা প্রাকৃতিক উৎস থেকে জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ দিতে না পারায় অনেক জায়গায় বোরো জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা শ্যালোমেশিন বসিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে বোরোর আবাদ ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার লাইট গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার নদী ও খালগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে সঠিক সময়ে জমিতে চারা রোপণ করতে পারিনি। আটপাড়া উপজেলার রূপ চন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক খোকন মিয়া বলেন, দুই বিঘা জমিতে বোর ধান চাষের জন্য বীজতলা তৈরি করেছি। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় তা জমিতে রোপণ করতে পারছি না। পানির অভাবে বীজতলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। শুরুতেই পানি সেচের যে টাকা খরচ হচ্ছে আবাদ শেষে আমাদের লোকসানে পড়তে হবে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বেশিরভাগ কৃষক সেচ যন্ত্রের সাহায্যে জমি তৈরি এবং সে জমিতে বোরো ধান আবাদ করছে। এতে কৃষকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
সুনামগঞ্জ থেকে মো: হাসান চৌধুরী জানান, পৌষ-মাঘ শেষ, চলতি মাসেও বৃষ্টির দেখা নেই। খরায় নদী-নালা খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। এতে বোরো ফসলসহ অন্যান্য সবজি ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার কৃষকরা ফসল উৎপাদন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এ ছাড়াও জেলে মাঝিরা খালে-বিলে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
সদর উপজেলা মোহনপুর গ্রামের কৃষক শাহিন মিয়া বলেন, চাষাবাদের উৎপাদিত ফসলের আয় থেকে পুরো বছরের আমার সংসার খরচ চলে। এবার মাঘে বৃষ্টি না হওয়ায় ৬০ শতাংশ বোরো ফসল ও ৩০ শতাংশ সবজি ক্ষেত রোদের তাপে পুড়ে গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি আম গাছের মুকুল ঝরে গেছে। এখন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার খরচ কীভাবে চালাব ভেবেই পাচ্ছি না।
বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, শস্যভাÐার হিসেবে পরিচিত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় দীর্ঘদিনের একটানা খরার তীব্রতায় ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। রোদে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে ধানের চারাসহ অন্যান্য ফসলাদি। বরগুনায় গত ২ মাসের অধিক সময় ধরে বৃষ্টি নেই। একটানা দীর্ঘদিন ধরে খরা অব্যাহত থাকায় নদীনালা-পুকুর-খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ফসলি জমির সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। ফসলি জমিতে সেচ ব্যবস্থা না থাকায় ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পরেছেন কৃষক। বরগুনা সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠ ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সদর উপজেলার বড় লবণগোলা গ্রামের কৃষক জাফর মল্লিক জানান, সেচের পানির মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানি না থাকায় জমি ফেটে যাচ্ছে। অথচ আর্থিক সঙ্কটে তিনি জমিতে সেচ দিতে পারেননি। পানির অভাবে ফসল বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
জয়পুরহাট থেকে মশিউর রহমান খান জানান, জয়পুরহাট ধান, আলু ও সরিষা চাষের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের সবজি এ জেলার কৃষকরা উৎপাদন করেন। বিগত দুই মাস কোনো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার প্রত্যেকটি খাল-বিল, নদী-নালাসহ আবাদি জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে জেলার কৃষকরা বেশ চিন্তিত। তারা মনে করছেন, আর কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত না হলে ফসল সেচের জন্য গুনতে হবে অতিরিক্ত টাকা। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। জয়পুরহাটে ক্ষেতলাল উপজেলার খানপাড়া গ্রামের কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, আমি পাঁচ বিঘা জমিতে ইরি রোপণ করব; কিন্তু আমার ইরির চারাগাছগুলো পানি অভাবে মরে যাচ্ছে। তাছাড়া পানির অভাবে জমি চাষ করতে পারছি না এ সময়টা বৃষ্টির খুব দরকার।
ফরিদপুর থেকে আনোয়ার জাহিদ জানান, টানা ২ মাস বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি না থাকায় ফরিদপুর জেলার ৯ উপজেলা সদরের নদীনালা-খাল-বিল-পুকুর-ডোবা সব শুকিয়ে গেছে। ফলে তিন ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ৯ উপজেলার আবাদি জমির সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে এবং পদ্মাসহ পদ্মার প্রধান প্রধান শাখা নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে। ফলে জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসাবাড়ি ও ইরিবøকের টিউবওয়েলের পানি না উঠায় সংশ্লিষ্ট সকল কাজ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি অনাবৃষ্টিতে মাটির রস কমে যাওয়ায় আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। এ ছাড়াও বোরো ধানের বীজতলাসহ অন্যান্য ফসল ও সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফলে কৃষকরা পড়ছে চরম বিপাকে। এ বিষয়ে ফরিদপুর সদর থানার ডিক্রিচড় এলাকার আদর্শ কৃষক সেকেন মেম্বর বলেন পদ্মার, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া বাড়ির পাশে খাল পুকুর সব শুকিয়ে গেছে। সদরপুর পদ্মা পাড়ের জেলে খবির মাতুব্বর বলেন, ভাই পদ্মার পানি এতটাই কমে গেছে যে দীর্ষদিন যাবত নদীতে মাছ ধরতে পারছি না।
নোয়াখালী থেকে এহসানুল আলম খসরু জানান, প্রায় ৩ মাস সময় নোয়াখালী জেলায় বৃষ্টি না হওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এখানকার নানা ফসল উৎপাদন। প্রান্তিক চাষিরা আছে চরম হতাশায়। পুকুর, খাল, নদী-নালা ক্রমাগত শুকিয়ে পানিশূন্য হবার শঙ্কায় আছে জনপদবাসী। চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো চাষ এবং নানা ধরনের রবি-খরিপ ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয় দেখা দিয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং অসহনীয় লোড শেডিংয়ের জনভোগান্তি বেড়েই চলেছে। দীর্ঘসময় বৃষ্টি না হওয়ায় নানাধরনের পোকামাকড়ে আক্রান্ত হচ্ছে, তরমুজসহ নানা খরিপ জাতের ফসল। সুবর্ণচরের তরমুজ চাষি আবদুল্লাহ বলেন, বৃষ্টি না হলে শুধু সেচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারব না। ইরি-বোরো এবং তরমুজ বাঙ্গি চাষে অনেক টাকা খরচ করে এখন হতাশায় আছি।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী থেকে এস কে সাত্তার জানান, শেরপুরের ঝিনাইগাতী. শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী গারো পাহাড়ে বোরো চাষে বাড়তি সেচ খরচে বিপাকে পড়ছেন কৃষকরা। সেচনির্ভর বোরো চাষে ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিনির্ভর ফসল উৎপাদন। এতে বোরো চাষে গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়বে এবং বিরূপ প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন