হক মানে অধিকার। প্রাপ্য আবশ্যিক অধিকার, অর্জিত আবশ্যিক অধিকার ও সামষ্টিক অধিকার।
একজন মানুষের জীবনে কতগুলো হক বা অধিকার আছে যা সে জন্মগতভাবে প্রাপ্ত হয়। জন্ম স্থানের পরিচিতি বা নাগরিকত্ব তার জন্মগত অধিকার। মায়ের দুধের অধিকার, ভাষার অধিকার, হাসি আনন্দে বড় হওয়ার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার মাতা পিতার সম্পদের অধিকার এগুলো তার জন্ম সুত্রে পাওয়া। এগুলো কেউ কেড়ে নিতে পারেনা। এই হক সকল শিশুর, সকল মানুষের, সকল ধর্মানুসারীর। প্রত্যেক শিশু স্বকীয়তা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। জন্মের পরে তার অভিভাবক তাকে যে ধর্মের অনুসারী করে সে সেই ধর্মের অনুসারী হয়ে বড় হয়। উত্তম ধর্ম শিক্ষা পাওয়াও তার অধিকার।
উল্লেখ্য, ‘হক’ শব্দটি নাহকের বিপরীত, নাহক মানে বাতিল। ‘হক কথা’ বলতে সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলাকে বুঝায়। কুরআনিক নির্দেশনা মোতাবেক ‘হক’ পালনে ইবাদত হয় আর নাহকে গুনাহগার হয়। যেখানে হকের ইনসাফের কার্যক্রম শুরু হয় সেখানে নাহক থাকতে পারেনা। অর্থাৎ হক আর বাতিল এক সাথে চলতে পারেনা। সত্য আর মিথ্যা দুটি বিপরীত। যেমন কেউ নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষনা করলো তাহলে সে অমুসলিমদের কোন কাজ করবেনা এটাই স্বাভাবিক।
আল্লাহ ছোট একটি সূরার মধ্যে হকের মর্যাদা বর্ণণা করেছেন,সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, কিন্তু তারা ব্যতিত যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথা ও সবর করার উপদেশ দেয়।’ (সূরা আল-আসর, আয়াত : ২-৩) এখানে হকের গুরুত্ব দিয়ে পরষ্পরে ন্যায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করণে সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রতি তাগীদ দেয়া হয়েছে । আর হক পরিপূর্ণ করার মধ্য দিয়ে ক্ষতি থেকে বাঁচার সুন্দর ফর্মূলাও দিয়েছেন।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে হক তিন প্রকার যথা হাক্কুল্লাহ, হাক্কুল ওলেদাইন, হাক্কুন নাস আজমায়িন। আল্লাহর হক ও বান্দার হক বুঝাতে ‘হাক্কুল্লাহ’ ও ‘হাক্কুল ইবাদ’দুটি বাক্য ব্যবহার করা হয়। আর হাক্কুন্নাছ বলতে সাধারণ সকল মানুষের প্রতি মানুষের হক বুঝানো হয়েছে। হক সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করছি।
এক, হাক্কুল্লাহ এর অর্থ এক কথায়- আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে আল্লাহ বললেন, ‹আসলেম› ইমান আনো- তিনি বললেন আসলামতু লিরাব্বিল আলামীন- ঈমান আনলাম পৃথিবীর রবের প্রতি। তাৎক্ষনিক জবাব দিয়ে তিনি নিজেকে আল্লাহর সকল ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। মানে সম্পূর্ন রূপে তাঁর হুকুম পালন করতে প্রস্তুত। আল্লাহর জন্য করনীয় অন্যতম ইবাদত নামায। নামায খুশু খুযুর সাথে আদায় করা, রুকু সিজদার তাসবীহ সমুহের অর্থ বুঝে বুঝে অতি ধীরে সদা সর্বদা নিজেকে তাঁর প্রতি অবনত রাখাই আল্লাহর হক। প্রকাশ্যে বা গোপনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলাই হক।
দুই, মাতা পিতার প্রতি হক হলো- তাদের আনুগত্য করা। আদেশ নিষেধ মেনে চলা। এখানে শর্ত হলো যতক্ষণ তাঁরা আল্লাহর আনুগত্যের ভেতরের বিষয়ে নির্দেশ দিবেন ততক্ষণ। আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা বা এমন নির্দেশ যা মান্য করলে আল্লাহর আনুগত্য হয় না বরং শিরক বা আল্লাহর আনুগত্যে বাধা সৃষ্টি করে তা মানা যাবেনা। তবে মা বাবা যেমনই হোন না কেন তাদের কল্যাণ কামনা করা সকল সন্তানের হক বা কর্তব্য। অনেকে মাতা পিতাকে বিভিন্ন কারণে অপছন্দ করে এটাও করা যাবেনা কারণ বোখারী শরীফের ৬৩১১ নাম্বার হাদিসে- আসবাগ ইবনু ফারাজ (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ তোমরা তোমাদের পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না (অস্বীকার করো না)। কেননা, যে ব্যাক্তি আপন পিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় (পিতাকে অস্বীকার করে) এটি কুফরী।
তিন, জন সাধারণের প্রতি হক হলো- “তোমরা পরষ্পরে সৎ কাজের আদেশ করো আর অসৎ কাজে নিষেধ করো।গ্ধ এখানে একটি পরিবার একটি সমাজ একটি রাষ্ট্রের কথা লুকাইত। রাষ্ট্র প্রধানের যেমন রাষ্ট্রের জন সাধারণের কল্যাণে জন সাধারনের সম্পদ দখল করে রাস্তা ঘাট নির্মানের হক আছে তেমনি সাধারণ জনগনও রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ও শান্তিতে থাকার হক রয়েছে। রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণে সব করবেন। জনগণও রাষ্ট্রের আনুগত্য করবেন। এভাবে সবাই সবাইকে সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করবে এটাই হলো পরষ্পরের হক। প্রতিবেশির ভালো মন্দে খেয়াল রাখা, চলাচলের রাস্তা পরিষ্কার রাখা, কারো সমস্যা থাকলে তা সমাধানের ব্যবস্থা করা। কেউ অভাবে থাকলে সবাই মিলে সহযোগিতা করা।
এছাড়া কোরআনের একটি আয়াতে আল্লাহর হক ও বান্দার হকের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, মিসকিন, নিকটাত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহংকারী। (সুরা আন-নিসা, আয়াত : ৩৬)
হক শব্দটি মুসলিম সমাজে ভিন্ন অর্থে ব্যাপক পরিচিত ও সমাদৃত। তাহলো আত্বীয়দের মধ্যে আল্লাহর নির্ধারিত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি প্র্প্তা হওয়া। হক শব্দটি জমিজমা ও পূর্ব ওয়ারিশ থেকে প্রাপ্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সমস্যাও বেশি হয় সম্পত্তির হক নিয়ে। (চলবে)
লেখক : গবেষক, শিক্ষাবিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন