শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রবীণদের জন্য আনন্দ আশ্রয় গড়ে তুলুন

আলহাজ্ব এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

জাতিসংঘের আহবানে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় গুরুত্বের সংগে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়ে আসছে।

মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি, এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে প্রবীণসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। এক বেসরকারী জরিপে জানা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবনযাপন করছেন। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত দরকারী প্রস্তুতি আমাদের নাই।

অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরী। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে, প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা, আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

সামাজিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছেন বাইরে থেকে তা বুঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ী পাহারা, সন্তান দেখাশুনা, বাজার করানো, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমানজনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, বৃদ্ধ পিতা মাতাকে আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়ীটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেক বাবা-মা, সন্তান ও পুত্রবধূর কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলে, মেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে।

অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়ীতে তালা বন্ধ করে রেখে স্বামী-স্ত্রী তাদের কর্মস্থলে চলে যায়। অনেক সময় অনেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একাকী রুমে আটকা রেখে ৫/৭ দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে চলে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নিতে চায়না। অনেক প্রবীণদের থাকার জায়গাও নিম্নমানের হয়ে থাকে। যেমন, বাড়ীর নিচতলায়, বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরীঘরে, গোয়ালঘরে এমনকি বাড়ীর কাজের লোকের সাথে অমানবিকভাবে থাকতে দেওয়া হয়। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও বিভিন্ন অজুহাতে অসুস্থ পিতা-মাতার এতটুকু খোঁজ-খবর পর্যন্ত নিতে চায় না। আবার অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও দারিদ্র্যতার কারণে বাবা-মার যত্ন নিতে পারেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভাল মন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বলের জন্য বলেন, ‘আমি খুব ভাল আছি’। যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযত্ন, অবহেলার শিকার হন। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের ন্যূনতম দায়ীত্ব তাদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে।

প্রবীণদের দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে অনিবার্যভাবেই এই অবহেলা ও কষ্টের শিকার হতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মার পরিচর্যা বা সেবা যত্ন করতে পারে না। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা-মাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এই সব নানা কারণে দিন দিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সু-সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়ীতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায়, কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে স্ব-ইচ্ছায় প্রবীণরা থাকতে চাইবেন।

প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি এই ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, ভাল নার্সিং ব্যবস্থা, ভাল মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যেকোনো প্রবীণ স্বেচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী একসাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে একসাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপনজনরা দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন, বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে তারাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারী খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে তারা স্বেচ্ছায় কিছুদিন নিজের বাড়ীতে, কিছুদিন ‘আনন্দ আশ্রয়ে’ থাকতে পারবেন।

অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তোলার জন্য সকলে এগিয়ে এলে প্রবীণদের এই আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে এই উদ্যোগকে বেশীরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজের দানশীল ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিৎ। পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন