২৮ বছর আগে ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনায় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতীসহ মোট ৩২জন অভিযুক্তকে বুধবার অব্যাহতি দিয়েছে ভারতের আদালত। কোর্টের এই বিতর্কিত রায় নিয়ে ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। হতাশা প্রকাশ করেছেন মুসলিম নেতারা। মসজিদ ভাঙার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রধান লিবেরহানও জানিয়েছেন, ‘ঘটনাটি চক্রান্ত ছিল। উমা ভারতী তার কাছে দায় স্বীকার করেছিলেন।’
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার দশ দিন পরে সাবেক বিচারপতি মনমোহন সিং লিবেরহানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। গতকাল ওই কমিশনের প্রধান মনমোহন সিং লিবেরহান জানান, বাবরি মসজিদ চক্রান্ত করেই ভাঙা হয়েছিল বলে তিনি এখনো মনে করে। তিনি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, তাতে চক্রান্তের কথাই বলা হয়েছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে লিবেরহান জানিয়েছেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত ছিল বাবরি ভাঙার পিছনে চক্রান্ত কাজ করেছে। আমি এখনো তা বিশ্বাস করি। বিস্তারিত পরিকল্পনা করে বাবরি ভাঙা হয়েছিল। উমা ভারতী ভাঙার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি দায়ও স্বীকার করেছিলেন। কোনো অদৃশ্য শক্তি বাবরি ভাঙেনি, মানুষই তা ভেঙেছিল।’ ২০০৯ সালে রিপোর্ট জমা দেয় লিবেরহান কমিশন। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘আদবানী, যোশী, উমা ভারতীরা সে সময়ের উত্তর প্রদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে বাবরি ভাঙার পরিকল্পনা করেছিলেন। পিছন থেকে মদত দিয়েছিলেন। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাবরি ধ্বংসকে সমর্থন করেছিলেন।’
হায়দারাবাদের এমপি ও মুসলিম সমাজের প্রথম সারির নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি প্রশ্ন করেন, ‘সারা দুনিয়া দেখেছে বাবরি ভাঙার দিনে সেখানে মঞ্চের ওপর বসে আদবানী-যোশীরা মিষ্টি বিলি করছিলেন। তাহলে তারা কীভাবে নির্দোষ হতে পারেন?’ তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরের ৬ তারিখে মসজিদটি কি জাদুবলে ধ্বংস হয়েছিল? কে করসেবকদেরকে জমায়েতের আহŸান জানিয়েছিল? মসজিদের ভেতরে মূর্তিও কি জাদুবলেই চলে এসেছিল?’ অন্যদিকে কোর্টে অব্যাহাতি পাওয়ার পর বিজেপির এই দুই প্রবীণ নেতাই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। আর ক্ষুব্ধ ও হতাশ মুসলিম নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, এই অভিযুক্তদের যদি সে দিনের ঘটনায় কোনও ভ‚মিকাই না-থাকে তাহলে মসজিদ ভাঙল কারা?
বস্তুত লখনৌতে বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক বুধবার দুপুরে রায় পড়ার শুরুতেই জানিয়ে দেন, মসজিদ ভেঙে ফেলার এই ঘটনা আদৌ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। মসজিদ ভেঙে ফেলার দিন বিজেপি নেতারা উন্মত্ত জনতাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বলেও আদালত মন্তব্য করেছে। বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক এস কে যাদব তার চাকরি জীবনের শেষ দিনটিতে জানিয়ে দেন, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি আদবানী-যোশী-উমা ভারতীর মতো নেতানেত্রীরা সেদিন মসজিদ ভাঙায় প্ররোচনা দিয়েছিলেন বলে- বরং তারা না কি সেটা আটকাতেই চেষ্টা করেছিলেন।
তবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দলের মতো সংগঠনের আরও যে অনেক নেতানেত্রী আদালতে খালাস পেলেন, তারা অনেকেই গতকালও জোর গলায় বলেছেন মসজিদ ভেঙে থাকলে বেশ করেছি। যেমন হিন্দু সন্ন্যাসিনী সাধ্বী ঋতম্ভরা। তিনি বলেছেন, ‘রামলালার জন্য ও সত্যের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে এই সব বাধাবিপত্তি আমি হাসিমুখে মেনে নিয়েছি।’ নব্বইয়ের দশকে ভারত জুড়ে ‘হিন্দুদের ভাবনার যে অবমাননা’ হয়েছে, বাবরি ভাঙা তারই প্রতিক্রিয়া বলেও দাবি করেন তিনি। জয়ভগবান গোয়েল নামে আর একজন অভিযুক্ত কোর্টে ঢোকার আগেই মিডিয়াকে বলে যান, মসজিদ ভাঙার জন্য তিনি মোটেও লজ্জিত নন। বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির নেতা জাফরইয়াব জিলানি আবার বলছেন, ‘যেখানে মাত্র দুজন সাক্ষীর ভিত্তিতে খুনের আসামিকেও সাজা দেওয়া যায় সেখানে কয়েক ডজন সাক্ষী থাকার পরও আদালত কীভাবে বলতে পারে কোনও প্রমাণ নেই?’ তিনি বলেন, ‘আর এই সাক্ষীদের মধ্যে পুলিশ বা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্তারাও ছিলেন যারা মুসলমান নন। ছিল অসংখ্য মিডিয়া রিপোর্ট, ফোটোগ্রাফারদের ছবি।’
বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি আজকের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রায় তিন দশক পর বুধবার প্রথম সেই ঘটনায় বিচারবিভাগের রায় এল ঠিকই - কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একপেশে এই রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বা ভারতের মুসলিম সমাজ কোনও বিচার পেল না। সূত্র : বিবিসি বাংলা, ডয়চে ভেলে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন