বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাবরি মসজিদ মামলার রিভিউ প্রসঙ্গে

মুহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

খবরে প্রকাশ, ৯ নভেম্বরের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড। আমরা মনে করি, আদালতের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারে এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে না দেখে, বরং শেষ সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। উত্থাপিত অসঙ্গতিগুলোর যৌক্তিক মূল্যায়ন একটি মন্দ দৃষ্টান্তের অনাকাক্সিক্ষত ও অশুভ পরিণতি থেকে ভারতের মতো একটি দেশের সুনাম-সংহতি রক্ষার জন্য শেষ সুযোগ হিসেবেও জরুরি। আর আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতও এটাই।

ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবতাকে এড়িয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু ‘ধর্ম বিশ্বাসে’র নামে যে রায় দিলেন আদালত, তাকে একবিংশ শতাব্দির সভ্যতার চাকা আদিম যুগের দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার এক ধরনের ব্যর্থ প্রয়াশ বলা যেতে পারে। ‘হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসকে কী করে অস্বীকার করবেন আদালত’, সুপ্রিমকোর্টের এমন জিজ্ঞাসার মধ্যে সত্য উদঘাটনের আপোসহীন দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের পরিবর্তে সংশয় মিশ্রিত এক ধরনের অসহায়ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ যে ঘটেছে তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য আবেগ ও বিশ্বাসের ডানায় ভর করে রায় দেয়ার নজির এটাই একমাত্র না হলেও ৪শত বছরের ইতিহাসে বোধ করি এই প্রথম।

১৬১৬ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি। ‘সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে’ খ্রীষ্ট ধর্মবিরোধী এমন বক্তব্য প্রচারের অপরাধে রোমের আদালত গ্যালিলিওকে কারাগারে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং তাঁর সকল বইপত্র এবং গবেষণাকর্মও নিষিদ্ধ করেছিলেন। এটা ৪শত বছর আগের কথা। সন্দেহ নেই, সেই দিনের রায়ে গ্যালিলিওর হার হয়নি বরং হেরেছেন আদালত, পক্ষান্তরে জয় হয়েছিল অজ্ঞতা আর অন্ধবিশ্বাসেরই। আমাদের কাছে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, রোমীয় আদালতের সেই অভিন্ন চেতনা ও বিশ্বাসের রজ্জুতে একবিংশ শতাব্দির কোনো আদালত এভাবে বন্দি হতে পারেন কেমন করে? হ্যাঁ, একইভাবে বিশ্বাস ও সংস্কারের দোহাই তুলে সক্রেটিসকেও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন এথেন্সের আদালত আড়াই হাজার বছর আগে। তাই সংশয়, সভ্যতার চাকা ফের আদিম যুগের দিকে ঘুরতে শুরু করলো না তো সবার অলক্ষ্যেই!

বাবরী মসজিদ মামলার রায় ও রায়ের বিরুদ্ধে ‘রিভিউ পিটিশন’ এর যৌক্তিক মূল্যায়ন আজকের আলোচনার বিষয়। এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন যে, রায়ের ভিত্তি হিসেবে আদালত যখন ‘হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস’কে বিবেচনায় নিলেন তখন মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস একেবারেই বিবেচনার বাইরে কেন? আমরা এই মৌলিক প্রশ্নের আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে রায়টির দিকে আর একবার দৃষ্টি দেয়া যাক।

১। সুপ্রিমকোর্ট একদিকে মজলুমের শেষ আশ্রয়, অন্যদিকে সংবিধানের রক্ষকও। ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে এ ধরনের একটি মামলার একতরফা রায় দেয়ার সুযোগ ভারতীয় সংবিধানে না থাকলে সংবিধানে ঘঁষা মাঝার আগেই এর রায় অসাংবিধানিক ও এখতিয়ার বহির্ভূত বিবেচিত হবে না কেন?

২। ‘অনুরাগ বিরাগ বর্জিত চেতনা’ ন্যায়বিচারের পূর্বশর্ত হলে ‘হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসকে কেমন করে অস্বীকার করবেন আদালত’ খোদ আদালতের এমন একটি মানসিক অবস্থানকে কোনোমতে অনুরাগ বিরাগবর্জিত চেতনার বর্হিপ্রকাশ বলা যায় কি?

৩। এখন থেকে শুধু বিশ্বাসের দোহাই তুলে কেউ কারো স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তা অস্বীকার করা হবে কীভাবে, নাকি এক্ষেত্রেও নাগরিকত্ব আইনের অভিন্ন চেতনায় কেবল মাত্র তাজমহল, কুতুব মিনার, বা লালকিল্লার মতো মুসলিম ঐতিহ্যগুলো পাল্টিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই তা ব্যবহৃত হতে থাকবে?

৪। মসজিদে মূর্তি স্থাপন বা মসজিদ ধ্বংস করা আদালতের বিবেচনায় বেআইনী কাজ হয়ে থাকলে অপরাধীদের শাস্তি বিধান এবং মসজিদ পুননির্মাণের ব্যবস্থা না করে মন্দিরে রূপান্তরের জন্য সেই তাদের হাতেই তুলে দেয়ার রায় স্ববিরোধিতার মতো নয় কী?

৫। রাম মন্দিরের জায়গা জবরদখলপূর্বকই মসজিদ নির্মাণ হয়েছে, এ বিষয়ে আদালত সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাসী হয়ে থাকলে জবর দখলদারদেরকেই দ্বিগুণ ভ‚মি মুফতে প্রদানের নৈতিক ভিত্তি কী? অতঃপর আগামীতেও কেউ যদি মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ গড়ার মতো কাজে উৎসাহী হয় তাদের বেলায়ও কী একই ফয়সালা দেয়া হবে?

৬। প্রতœতাত্তিক খননেও যখন মন্দিরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল না তারপরও কেবল ‘বিশ^াস’কে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার চেয়ে লটারির ব্যবস্থা নেয়াই কি যুক্তি ও ইনসাফের নিকটতর ছিল না।

৭। ‘হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস কী করে অস্বীকার করবেন আদালত’ এটি যদি বিব্রত ও দ্বিধাগ্রস্থ কোনো অসহায় মজলুমের আকুতি হয়ে থাকে তবে বিচারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না নেয়ার নৈতিক ভিত্তিটা কী? পক্ষান্তরে এটি যদি সত্য সন্ধানের প্রেরণা ও জিজ্ঞাসা হয়ে থাকে তাহলে জবাবের অপেক্ষা না করেই রায় দেয়ার যৌক্তিক ও নৈতিক ভিত্তিটা কী হতে পারে?

৮। অবসরে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে জটিল ও বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে চলার চেতনাই যেখানে সক্রিয় থাকার কথা, সেখানে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গেগৈ ১শত ৩৪ বছরে কুল-কিনারা হয়নি যে মামলার তেমন একটি মামলার রায় দিয়ে যাওয়ার জন্য হঠাৎ করেই নিজেকে যোগ্য ভাবার কারণ যাইহোক এই রায়ে ‘ধর্ম বিশ^াস’ এর অভিনব ও অপ্রাসঙ্গিক অবতারণা ছাড়া অন্য কোনো কারিশমার ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায় কি? রায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও প্রধান বিচারপতিকে উচ্ছ¡সিত অভিনন্দন জানাতে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। ধরেই নিলাম, এতে আইনের কোনো ধারা লঙ্ঘিত হয়নি, কিন্তু আইনগত বাধা না থাকাই কী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির জন্য সব?

৯। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, রামের জন্মস্থান রামায়নে বর্ণিত রাম আর রাম ভক্ত হনুমানের সাথে দশানন রাক্ষসরাজ রাবনের যুদ্ধ ও সীতা উদ্ধারসহ ইত্যকার ঘটনাবলী আদৌ হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসের অংশ কিনা? যদি তাই হয়ে থাকে তবে কীভাবে? বেদ, পুরান, উপনিষদ কী তাই বলে? পক্ষান্তরে যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে আদালত ‘হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট হওয়া উচিত নয় কি?

১০। আদালত হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অস্বীকার নাইবা করলেন, কিন্তু মুসলমানদেরও যে একটা ধর্ম আছে, আছে ধর্ম বিশ্বাস তা অস্বীকার বা উপেক্ষা করবেন কেন? মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসও যদি যুগপৎ বিবেচনায় নেয়া হতো তাহলে রায় যে ভিন্নতর হতে পারতো না তা কেমন করে বলা যাবে? যেহেতু তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি তাই ‘রিভিউ আপিল’ বিবেচনার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হতে পারে এমন প্রত্যাশা থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয় মুসলমানদের লালিত চেতনা ও বিশ্বাস এর সমর্থনে আল-কুরআনের কতিপয় উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরছি।

ইসলামী শরীয়াহ মতে, মসজিদ নির্মাণের জন্য ভ‚মির বৈধ মালিকানা পূর্বশর্ত। অপবিত্র স্থানে যেমনি নামাজ হয় না, তেমনি জবরদখলকৃত মসজিদেও না। কুরআনপাকে এ ধরনের কোনো মসজিদে দাঁড়াতেও রাসুল (সা.)কে নিষেধ করা হয়েছে, যার ভিত্তি সত্য-সততা ও তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

কুরআনপাকের ভাষায়: ‘আল্লাহ সাক্ষী ওরা নিশ্চয় মিথ্যাবাদী। তুমি নামাজের জন্য এর মধ্যে কখনো দাঁড়াবে না, যে মসজিদের ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই ধর্ম-কর্মের জন্য স্থাপিত ওখানেই নামাজের জন্য তোমার দাঁড়ানো উচিত।’ সূরা তাওবা: ১০৭, ১০৮। এরপর আরো বলা হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহর ভয় ও সন্তুষ্টির উপর সে ব্যক্তি উত্তম না যে তার ঘরের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে পতন্মুখ একটি গর্তের কিনারায় এবং যা তাকে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়বে?’

‘আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দল দিয়ে আর এক দলকে বাধা না দিতেন তাহলে মঠ-গির্জা, ভজনালয় ও মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেত যেখানে আল্লাহর নাম বেশি স্মরণ করা হয়।’ সূরা হজ্জ: ৪০। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে কুরানপাকের কতিপয় নির্দেশনা অপ্রাসঙ্গিক নয় বিবেচনায় তুলে ধরা হলো: ‘আর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে সকল দেব দেবীর উপাসনা করে তোমরা তাদের গাল দেবে না, কেননা তাহলে অজ্ঞানতাবশত তারাও আল্লাহকে গাল দেবে।’ সূরা আল্ আনআম: ১০৮ ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমরা তোমাদের ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না।’ সূরা নিসা ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমার ধর্ম আমার।’ সূরা কাফিরুন: ৬ ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি ব্যতিত কেউ কাউকে হত্যা করলো সে যেন গোটা মানবতাকেই হত্যা করলো। (পক্ষান্তরে) কেউ যদি একজন মানুষেরও জীবন রক্ষা করলো তো যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই রক্ষা করলো।’

বলা হতে পারে, এসব নির্দেশনা ও নীতিকথা মুসলমানদের জীবনে অনুশীলিত হয় কতটুকু আর এর সাথে আলোচ্য মামলার সম্পর্কইবা কী? সম্পর্কের কথাই আগে বলি। মসজিদ তো নামাজ পড়ার জন্যই কেউ করেন। তাহলে এমন মসজিদ যেখানে দাঁড়ানোই নিষেধ সেখানে নামাজ পড়বে কে এবং কেন? অন্যের উপাসনালয়ে হাত দেয়ার অধিকারই যে ধর্মে দেয়নি কোনো মুসলমানকে বরং সাবধান করা হয়েছে জাহান্নামের সেই ক্ষেত্রে একজন বিশ্বাসী তাই করতে যাবেন কোন দুঃখে? বাবরের মতো ইতিহাসনন্দিত একজন মহৎ ও উদার শাসকই তা করবেন কোন স্বার্থে, যাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বিরাগভাজন হবে?

উপসংহারে বলতে চাই, আদালতের মর্যাদা ও ভাবমর্যাদার সাথে ইনসাফের বিষয়টি অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। আমরা চাই রিভিউ পিটিউশনের রায়ে যেন সেই ইনসাফ তথা আদালতের বিজয়টাই সুনিশ্চিত হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন