শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

জান্নাতুল মাওয়া নাজ | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৮ এএম

পরিবেশ দূষণ বেড়েই চলেছে। বেশ কিছু সূচকে অগ্রগতি সত্তে¡ও জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পরিবেশ দূষিত হলে অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যে। আবার বিপর্যস্ত বন, ভূমি ও নদী-খাল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ। সরকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নয়, পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার দাবিনামা অগ্রাহ্য করার প্রবণতাও রয়েছে। ফলে খাল-বিল-জলাশয় এবং বন দখলে উন্মুখ লোকজনকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জনগণের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জনসচেতনতা ও সরকারের সক্রিয়তা দরকার।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দমিত না হয়ে তা থেকে রক্ষা পেতে সম্ভাব্য উদ্যোগ নেয়াটাই হতে পারে সফল হওয়ার সোপান। বাংলাদেশে বৈরী আবহাওয়ার কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। এই নিয়ে সর্বত্র উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে এই বিপর্যয় নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা সোচ্চার বটে। বিপর্যয় কাটাতে বিশ্বের দেশগুলো যত সচেতন ও উদ্যোগী যে তুলনায় বাংলাদেশ সচেতন নয়। অথচ ইতোমধ্যে পরিবেশ এর মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যত তথ্য-উপাত্ত হাতের কাছে পাওয়া যায় তার বিশ্লেষণ শেষে পরিবেশবাদীরা উৎকণ্ঠিত। কিন্তু সে তুলনায় দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বিষয়টি এখনো কোনো এজেন্ডা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবেশ হচ্ছে, কোনো একটি জীবের অস্তিত্ব বা বিকাশের ওপর ক্রিয়াশীল সামগ্রিক পরিপারির্শ্বকতা। যেমন- চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু ও প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য জীব ও জৈব উপাদান। বিশ্ব পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এ অবনতি হয়েছে আরো দ্রুত।

ব্যতিক্রমধর্মী ভৌগোলিক অবস্থানের এই জনপদ বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। প্রায় ১৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার পানি নেমে আসে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী দিয়ে। এই পানির মাত্র শতকরা আট ভাগ নিষ্কাশন এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্গত। বেশির ভাগ নিষ্কাশন অববাহিকা প্রতিবেশী দেশগুলোয় অবস্থিত। বাংলাদেশে ২৫০টিরও বেশি বড় নদ-নদী রয়েছে। এসব বড় নদীর মধ্যে পরিবর্তনশীল মেঘনা এবং খুব পরিবর্তনশীল পদ্মা ও যমুনাকে এ শ্রেণিভুক্ত করা যায়। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নে পানি বন্যার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। নদীভাঙন এবং আকস্মিক বন্যায় নদী প্লাবিত, তীর ভাঙা, জমি বিলীন হওয়ায় স্বাভাবিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট, অসংখ্য চর জেগে ওঠার কারণে নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে। তাতে ঘনঘন আকস্মিক বন্যায় ফসলহানিসহ মানুষের জীবনে পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে। এসব বিপর্যয় ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তেমন সজাগ সচেতন নয়। তাছাড়া যেসব নদী বড় বড় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, সেগুলো ভয়াবহ দূষণের কবলে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রযুক্তির বর্ধিত ব্যবহার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রীর কারণেও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ময়লা-আবর্জনা পরিবেশ দূষিত করছে। মোবাইল ফোন, মোবাইল ফোন টাওয়ার, ইন্টারনেটের জন্য ব্যবহৃত রাউটার যে পরিমাণ তেজষ্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে, তাতে মানুষ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের যা করতে হবে, তা হলো: ইটভাটার চিমনি সঠিক উচ্চতায় স্থাপন করতে হবে, অধিক ক্ষমতাস¤পন্ন রাউটার ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করতে হবে, মোবাইল টাওয়ার জনবহুল স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে, আবর্জনা রিসাইক্লিং পদ্ধতিকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং পুরনো যানবাহন রাস্তা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রাকৃতিক অনেক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে মানুষের কোনো হাত না থাকলেও মানুষই পারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে। প্রযুক্তিই উন্নতির ও সভ্যতার সোপান। তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের ধরন বা কৌশলই নির্ধারণ করে দেবে তা পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে। পরিবেশদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়েছে জনজীবনের ওপর। জাতিসংঘ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবেশদূষণের ফলে এশিয়ার আকাশে তিন কিলোমিটার পুরু ধোঁয়াশা জমেছে, যা এসিড বৃষ্টি ঘটাতে পারে। ফলে কোটি কোটি মানুষ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। প্রাকৃতিক দূষণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হেপাটাইটিস বি, পোলিও, কলেরা প্রভৃতি রোগ বাড়তে পারে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির অনুপ্রবেশ বাড়ার কারণে চামড়ার ক্যান্সার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বাড়তে পারে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজষ্ক্রিয়তার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। পরিবেশদূষণ রোধের চেষ্টা করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। যন্ত্র ও গাড়ি থেকে ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও সৌরশক্তিনির্ভর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে এবং বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পরিবেশদূষণের ফলে মানুষের অস্তিত্ব আজ সংকটে। সুস্থ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলাই হোক সবার অঙ্গীকার। মানুষের অসচেতনতার কারণে বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থের হুমকি। ব্যবহার করার পর অনেকে অবশিষ্ট ওষুধ ফেলে দিচ্ছে যেখানে-সেখানে। এতে করে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও অ্যান্টিবায়োটিকগুলো জীবাণু অপ্রতিরোধী হয়ে উঠছে। পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে, তা যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। খাবারের উচ্ছিষ্ট নিয়ে ফেলছে বাড়ির পাশের কোনো ড্রেনে। মশা জন্ম নিচ্ছে, ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু অথবা ম্যালেরিয়া। ওয়াসার পানির কারণেও ছড়াচ্ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। ফ্যাক্টরিগুলো ইটিপি ব্যবহার করে না, ফলে পানি দূষিত হচ্ছে এবং নদীর পানি ব্যবহার না করে করছে ভূগর্ভস্থ পানি। এতে দূষণের মাত্রা আরো বাড়ছে। সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। বস্তুত দূষণ রোধ ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। দূষণ রোধে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও এর সফল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। দেশে পানিদূষণের কারণেও প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায়। তাই পানিদূষণ রোধেও দ্উত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সব নদীকে দূষণমুক্ত করতে হবে। তা না হলে জনস্বাস্থ্য অচিরেই বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করে আমরা বরং নষ্টই করছি। কিন্তু মোকাবেলা করার আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। গাছ লাগিয়ে সৃষ্টি করতে পারি সবুজ প্রকৃতি।

সুস্থ পরিবেশগত পরিস্থিতি সুরক্ষা তথা সংরক্ষণে গৃহীত পরিবেশনীতির আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কালক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গোটা বিশ্বে পরিবেশগত অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের কারণে উপযোগী পরিবেশনীতি প্রণয়ন ও তার নীতি ও লক্ষ্যগুলো কার্যকরভাবে বা¯তবায়নের গুরুত্ব বেশির ভাগ দেশই দেয়া শুরু করেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো যাতে তাদের পরিবেশগত সমস্যাগুলো ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমিয়ে আনে তার জন্য বিশ্বব্যাপী চাপ সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশনীতি প্রণয়নের কৌশল অভিজ্ঞতাহীন একটি সাম্প্রতিক বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রশাসন ও পরিবেশগত অগ্রাধিকারগুলো শিল্পোন্নত বিশ্বেও অনুরূপ বিষয় থেকে অনেকটা ভিন্ন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করা নিয়ে সমস্যায় রয়েছে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এবং আন্তঃবিষয়ক জ্ঞানের তীব্র অভাব এই কাজটিকে কঠিনতর করেছে। ভৌত ও আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বাংলাদেশকে টেকসই ব্যবস্থাপনার একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র হিসেবে অভিহিত করা যায়। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পরিবেশ নীতির গুরুত্ব ও তার বাস্তবায়ন করা কঠিন হলেও তা থেকে পিছপা হলে তা হবে আত্মঘাতী। কেননা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষা পরিস্থিতির কারণে একটি অগ্রাধিকার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শহুরে এবং গ্রামীণ জনপদে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় অবনতি নিয়ে পরিবেশ আন্দোলনকারীদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েছে। একে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। দেশের সব শিল্প ও কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধন (ইটিপি) ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে জরাজীর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে, উচ্চ শব্দের ভেঁপু বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। শহরাঞ্চলের ময়লা ও আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিন দ্রব্য যেখানে-সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে, গ্রামাঞ্চলের ময়লা-আবর্জনা, মলমূত্র যাতে খাল-বিল বা নদীর পানিতে না মেশে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ করতে হবে, বনাঞ্চল সংরক্ষণ করতে হবে। সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ মানবজীবনকে সুন্দর করে, তাই পরিবেশ যাতে সুন্দর থাকে, মানুষের বাস উপযোগী হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন