ভিন্নমতালম্বী শিক্ষকদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলেও তদন্ত কমিটির সুপারিশ স্বত্তে¡ও পার পেয়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের (ঢাবি) সরকারপন্থী শিক্ষকরা। একই ধরনের অপরাধে কারো চাকুরিচ্যুতি হলেও কেউবা আছেন বহাল তবিয়তে। বিগত কয়েক বছরে ঢাবি প্রশাসনের বিভিন্ন প্রশাসনিক উদ্যোগ পর্যালোচনা করে এমনটিই পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের এহেন দ্বিচারিতা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালের অক্টোবরে ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ওরফে বাহালুলের বিরুদ্ধে বিভাগের একাধিক ছাত্রীর সাথে যৌন নিপীড়ন ও কুকর্মের অভিযোগ উঠে। এতে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তিন মাস এবং ২০১৩ সালের ১ জুন হতে এক বছরের জন্য বিভাগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এরপর ২৮ ফেব্রæয়ারি ২০১৩ তারিখে বিভাগের ৫ জন্য শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটিতে আহŸায়ক ছিলেন; প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইবরাহিম (বর্তমানে পিএলআর)। সদস্যরা হলেন; ড. মো: আতাউর রহমান মিয়াজী, প্রফেসর ড. আব্দুল বাছির, একেএম খাদেমুল হক ও সুরাইয়া আখতার। একই বছরের ২৫ মার্চ বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ৩ পৃষ্ঠা সম্বলিত বিস্তারিত প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেন। যেখানে বলা হয়েছে- ভুক্তভোগী ছাত্রী ও অভিযুক্ত শিক্ষক বাহালুলের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘বাহালুল শিক্ষকসুলভ গÐি অতিক্রম করে ছাত্রীদের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তা নৈতিক স্খলন ছাড়া কিছু নয়। অতএব নৈতিক স্খলনের অপরাধে মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বাহালুলের বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুকূলে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির বিবেচনার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হলো। সেইসাথে বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশ ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে একাডেমিক কমিটি তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে’।
তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন ও সুপারিশের পরও বাহালুলের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত জুলাই মাসে অ্যাকাডেমিক কমিটির সভায় কয়েকজন শিক্ষক বাহালুলকে বিভাগের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার দাবি তোলেন। ঢাবি ফার্স্ট স্ট্যাটিউটের ৪৫(৩)(৪) উপধারায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩’র আদেশের ৫৬(৩) উপধারায় স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। সেখানে বলা আছে- ‘নৈতিক স্খলন, অদক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও চাকুরিবিধি পরিপন্থী’ কাজের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে টার্মিনেট করা যেতে পারে। অথচ তাকে ক্লাসে ফেরানোর উদ্যোগ দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভাগের একাধিক শিক্ষক।
২০১৮ সালের ২৬ মার্চ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখার কারণে বিশ^বিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ড. মোর্শেদের নিবন্ধ লেখার বিষয়টি উল্লিখিত অপরাধের কোনোটিতেই পড়ে না। তারপরও কেবল ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে ড. মোর্শেদকে বেআইনিভাবে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় বলে ঢাবি সাদা দলের অভিযোগ। অন্যদিকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বাহালুল নৈতিক স্খলন করেও বিশ^বিদ্যালয়ের সকল সুবিধা ভোগ করেছন। ইসলামের ইতিহাস বিভাগের জন্য তদন্ত কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. আব্দুল বাছিরকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হন নি। বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. মোশাররফ হোসাইন ভুঁইয়ার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
২০১৩ সালে বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ এমরান হুসাইনকে ‘ছাত্রীকে নিপীড়ণ’র অভিযোগে বিশ^বিদ্যালয় থেকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। তিনিও বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। একইভাবে ঠুনকো অজুহাতে বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলামকে ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনিও ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে তাকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি। পরে তিনি জেনেছেন যে, তাকে বিভাগের ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অব্যাহতি দেয়া হয়। চাকুরি ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্ন হন ড. সাইফুল ইসলাম। নানা ধাপ পেরিয়ে আদালত তার পক্ষে রায় দিলে তিনি ২০১৯ সালে বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর যোগদান পত্র জমা দেন। তিনটা চিঠি দিয়েছিলেন। সর্বশেষ চূড়ান্ত চিঠি দিয়েছিলেন ভিসিকে। কিন্তু তাকে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়নি। সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেয়নি। আদালতের আদেশ মোতাবেক আমার যোগদানে কোনো বাধা নেই। তদুপরি বিশ^বিদ্যালয়ের আদেশ ভঙ্গ করে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে বলে জানান ড. সাইফুল ইসলাম।
২০১৭ সালের ৩য় বর্ষ ষষ্ঠ সেমিস্টারে ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের দুই প্রফেসর তৈরি করা ফলাফলে অসঙ্গতির অভিযোগ এনে ফল পুন:নীরিক্ষণের দাবি জানায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকদ্বয় হলেন- ড. আবদুস সবুর খান ও ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। এরপর ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটি গঠিত ও পুন:টেবুলেটর নিযুক্ত করা হয়। পুন:নীরিক্ষিত ফলাফলে ১১ শিক্ষার্থীর চারটি কোর্সের সর্বমোট ৮০’র বেশি স্থানে প্রাপ্ত নম্বরের কমবেশি করার প্রমাণ মেলে। সর্বশেষ এবছরের গত ১৭ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুন:টেবুলেটরদ্বয়। মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ২০১৭ সালে ঢাবি ক্লাবের সেক্রেটারি থাকাকালে টাকার বিনিময়ে তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেন বলে অভিযোগ উঠে। সে বিষয়েও তদন্ত কমিটি অনিয়ম পায়। এই শিক্ষক অনিয়ম করে নীলক্ষেত হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হয়ে নানা অপকর্ম করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো: হারুন অর রশিদ। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে পিএইচডি থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। এতো বড় অনিয়মের পরও বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। তিনি সরকারপন্থ’ী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।
জানতে চাইলে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম সরকার বলেন, পরীক্ষার ফলাফলে কিছু অসঙ্গতি ছিল। সেটা সংশোধন করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ^বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন আছে। তারাই দেখবেন। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন।
সা¤প্রতিক বিশ^বিদ্যালয়ে অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে গবেষণা জালিয়াতি করেও পার পেয়ে যাওয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী প্রফেসর সামিয়া রহমান এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান। এছাড়াও ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু নাসের মুহম্মদ সাইফ। এছাড়াও নৈতিক স্খলনের পরেও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের রাখঢাকের কারণে পার পেয়ে গেছেন রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. জি এম গোলজার হোসেন।
বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, কেউ গুরুতর অপরাধ করলে তার প্রাপ্য শাস্তি পাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিশ^বিদ্যালয়ের দ্বিচারিতা করা হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু কেউ লঘু অপরাধ করে গুরুদÐ পাবেন এটা অনাকাক্সিক্ষত এবং খারাপ দৃষ্টান্ত। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও গর্বের প্রতিষ্ঠান। এখানে ন্যায় বিচার হবে এটা সবারই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা খর্ব করার অধিকার কারো নেই। কেননা বিশ^বিদ্যালয় চলে তার নিজস্ব আইনে।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনে মন্তব্য জানতে মোবাইলে কল দিলে ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান এবং প্রোভিসি (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ সামাদ কল রিসিভ করেন নি।
সার্বিক বিষয়ে প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, এগুলো আসলে কাম্য নয়। বিশ^বিদ্যালয়ে সবার জন্য একই নিয়ম হওয়া উচিত। নিয়ম কারো জন্য আছে, কারো জন্য নাই, কারো জন্য খÐিত এগুলো হওয়া উচিত না। আস্তে আস্তে আমার মনে হয় এ বিষয়গুলোর সমাধান হবে। অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষকদের একটা অংশের মধ্যে নৈতিক স্খলনের বড় কারণ হলো, মাস্টার্স হওয়ার পরেই শিক্ষক হিসেবে ঢুকে যায়। তাদের মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের আদর্শ এবং অনুশীলন এর সমন্বয় হয় না। এ কারণে এমন কর্মকাÐের সাথে তারা জড়িত হয়ে পড়েন। এগুলো ধীরে ধীরে আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করছি। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদে এথিক্যাল কমিটি গঠন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছড়াও গবেষণা জালিয়াতি বন্ধেও কমিটি করেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন