আজিজুল ইসলাম একটি ডেভেলপার কোম্পানির সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন। বেতন পেতেন ১৮ হাজার টাকা। রামপুরায় ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। একমাত্র সন্তানকে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করে ছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারি তার সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। গত জুলাই মাসে কোরবানি ঈদের আগে অফিস তাকেসহ আরও কয়েকজনকে ছাঁটাই করে। এরপর থেকে তিনি বেকার। তার ওপর লাগামহীন দ্রব্যল্যের ঊর্ধ্বগতি তার জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। একটা চাকরি জোগাড় করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেননি। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাস সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল তা ভেঙে খেয়েছেন। স্ত্রীর কিছু অলংকার ছিল তাও বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন। আত্মীয়-পরিচিতদের কাছ থেকে ধার-দেনাও করেছেন। এখন আর চলতে পারছেন না।
আজিজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, করোনা শুরুর পর অর্থাৎ গত মার্চ থেকে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে তা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং এখন প্রায় সব জিনিসের দামই বাড়ছে। আলুর দাম কম ছিল অথচ এখন ৫০ টাকা কেজি হয়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণে আমার মতো ছোট সংসারেরও মাসে দু’তিন হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। অথচ এক টাকাও আয় নেই। ধারদেনা করেও চলতে পারছি না। তাই চলতি গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বেসরকারি ব্যংকে চাকরি করেন আহাদ। গতকাল খিলগাঁও রেলগেইট মার্কেটে বাজার করতে আসেন। কথা হয় তার সাথে। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সাথে বলেন, মিডিয়াতে একটি খবর বেশ ভালোভাবে প্রচার করা হয়েছে। খবরটি হলো- জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় বেড়ে ৮৮৬ ডলার হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর তা বাড়বে ৪ শতাংশ। খবরটা খুশির। কিন্তু জিডিপির এ আয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে কী পারছে সাধারণ মানুষ। মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে বাজারে পণ্যের দাম যে আকাশচুম্বী তার হিসাব কিভাবে মিলাবেন?
তিনি বলেন, জিডিপির এ খবর আসার অনেক আগ থেকেই বাজারে আগুন। পেঁয়াজ নিয়ে হইচই চলছে এক বছর ধরে। এবছরই পেঁয়াজ ডাবল সেঞ্চুরি পার করেছে। এখন একই অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সরকারের অবস্থা এমন মিডিয়া কিছু লিখলে তারা জানতে পারেন পণ্যমূল্য বাড়ছে। সিন্ডিকেট আছে। সহজ প্রশ্নের উত্তর বাজারে জানতে চাইলে বলে আমরা কি করব? আমরা কিনি বেশি দামে, বেচি বেশি দামে। কাঁচামরিচের দাম তিনশত টাকা ছুঁইছুঁই। ভাত কমিয়ে আলু খান, চালের ওপর চাপ কমান। সরকারের এই সেøাগান এখন আর চলেছে না। যে আলু ছিল গরিবের খাবার। তাতেও এখন দুষ্টচক্রের হাত। আলু লাগামহীন ছুটে চলেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা দিয়ে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কে শোনে কার কথা। বাজারে যে কোনো সবজি এখন ১০০ টাকা। মানুষ সবজি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। যে আলু ছিল মানুষের খাদ্য তালিকার দুঃসময়ের সঙ্গী তাও এখন পাতে জুটছে না। গরিব, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ বাঁচবে কি করে?
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের এরকমই ত্রাহি অবস্থা। বাজারে গত জুলাই থেকে চড়া সবজির দাম। দুই সপ্তাহে দর আরও বেড়েছে। যেসব সবজি আগে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে ছিল, সেটা এখন ৭০ থেকে ১০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবজির দাম কমতে আরও মাসখানেক লাগবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকেরা নতুন সবজি আবাদ শুরু করেছেন। ওই সবজি এলেই শুধু দাম কমতে পারে। সবজির মতো চাল, পেঁয়াজ ও আলুর দাম নির্ভর করছে নতুন মৌসুম ও সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর। আর ভোজ্যতেলের দাম কমতে পারে শুধু বিশ্ববাজারে দর পড়তে শুরু করলে। ফলে শিগগিরই মানুষের দুর্ভোগ কমছে না।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দাম বেঁধে দেওয়া ও জরিমানার কৌশলও এখন কাজ করছে না। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার পর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে ব্যাপক অভিযান চালায়। ব্যবসায়ীদের বিপুল জরিমানা করা হয়। কিন্তু প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম এখনো ৯০ থেকে ১০০ টাকায় রয়ে গেছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ৭ অক্টোবর আলুর দাম প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বেঁধে দিয়ে তা কার্যকরের জন্য জেলা প্রশাসকদের চিঠি পাঠায়। বাজারে নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। গতকাল প্রতি কেজি আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। আর কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানে আলু বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজিতে। ফলে পাইকারি বাজারে দাম তিন টাকার মতো কমেছে বলে দেখা যায়। অথচ পাইকারির জন্য নির্ধারিত দাম প্রতি কেজি ২৫ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিলগেটে সরু ও মাঝারি চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়। ঢাকার খুচরা বাজারে অবশ্য দাম কমেনি। প্রতি কেজি ভালো মানের মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা এবং সরু চাল ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাল, ডাল ও তেলসহ ৩০টিরও বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে করে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠার উপক্রম হয়ে পড়েছে। করোনা মহামারির সময় দ্রব্যমূল্যের এমন লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার সামিল। বাজার নিয়ন্ত্রণে জোরাল মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন ক্রেতা সাধারণ। রাত পোহালেই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। বাধা দেয়ার যেন কেউ নেই। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজ করছে। অসাধু ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার ব্যবস্থা। বর্তমান বাজারে ৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি বিক্রি করা হচ্ছে না। শুধু সবজির বাজারেই লাগামহীন অবস্থা বিরাজ করছে তা নয়, প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামে উর্ধ্বগতির ঢেউ লেগেছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনদের জীবনে নেমে এসছে চরম দুর্ভোগ।
রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে মাস দুয়েকের বেশি সময় ধরে ঢাকার বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে শাকসবজি ও কাঁচামরিচ। বর্তমানে কাঁচামরিচ কেজি প্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে আবারও অস্বাভাবিকভাবে পেঁয়াজের দাম ও আলুর দাম বেড়েছে। গতকাল রাজধানীর, শান্তিনগর, ফকিরাপুল, মালিবাগ, খিলগাঁও রেলগেইট বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে সব ধরনের সবজির বাড়তি দাম দেখা গেছে। আলু কোথাও ৪৫ কোথাও ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের দামও বাড়ছে। দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির। তবে গরু ও খাসির গোশতের দাম আগের মতই আছে। খিলগাঁও রেলগেইট কাঁচাবাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজি ৮৫ টাকা থেকে ৯০ টাকা দরে। আদা, রসুন ও আলুর দামও বেড়েছে। আলু খুচরা বাজারে গতকাল বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজি। দেশি রসুন বিক্রি হয় ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হয় ১৩০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি। আমদানি করা আদার কেজি ২২০ থেকে ২৪০ টাকা বিক্রি হয়। সব ধরনের শাকসবজির দাম চড়া। শুধু কাঁচা পেঁপে ছাড়া প্রায় সব সবজির কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। কাঁচা পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি। ঝিঙ্গা, ধুন্দল, চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি। টমেটোর কেজি ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। গাঁজর আমদানি করাটা ৯০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি। লাউ প্রতিটি ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা। গোল বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর লম্বা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। দাম বৃদ্ধির ধারায় রয়েছে ব্রয়লার মুরগিও। গত সপ্তাহে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও গতকাল তার দাম উঠেছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। পাকিস্তানি কক মুরগি ২৩০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা এবং লেয়ার মুরগি ২৩০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা যায়। তবে এদিন গরুর গোশতের কেজি ৫৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। খাসির গোশতের কেজি ৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
এ দিকে ইলিশ ধরা বন্ধ হওয়ার পর বাজারে মাছের দাম কিছুটা বেড়েছে। শান্তিনগর বাজারে গতকাল চাষের কই ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, পাঙাশ ১৫০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৬০-১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা যায়। দুই কেজি আকারের রুই মাছের কেজি চাওয়া হয় ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। চিংড়ি, বেলে, বোয়াল, চিতল, আইড়, বাইম ইত্যাদি মাছের প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। সবজি রান্নার ছোট কচুরি চিংড়িও ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন