রায়হান হত্যার ঘটনায় সিলেটের রাজপথ হয়ে উঠেছে বেসামাল। কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায় সেই প্রশ্ন এখন নানাজনে। এর কারণ ঘটনার মূল হোতা এসআই আকবরের পলায়ন। তার গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে প্রশমিত হতে পারে বেদনার্থ, ক্ষুব্ধ মানুষের মনের আগুন। কিন্তু পুলিশ সূত্র বলছে, আকবর ছাড়া বরখাস্ত ও প্রত্যাহারকৃত অন্য ৬ জন রয়েছে তাদের হেফাজতে। আকবর গ্রেফতার না হওয়া পুলিশের ব্যর্থতা না ইতিবাচক কোন কৌশল সেই প্রশ্ন নিয়ে কৌতুল অনেকের মনে।
এদিকে, রায়হান হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দল-মত নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে এসেছিল আমজনতা। মিছিলে- স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল নগরী। দাবি কেবল একটাই ‘গ্রেফতার চাই, ফাঁসি চাই’। এছাড়া নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আরোপ করা হয়েছিল বাড়তি নিরাপত্তা। রায়হান হত্যার ঘটনায় ফুঁসে ওঠা জনতার হাত থেকে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসএমপি’র বিশেষায়িত ইউনিট ‘ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (সিআরটি)’র একদল সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। অপরদিকে, এখনও অবিরাম কাঁদছে রায়হানের পরিবার। কথা ছিল স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে পাড়ি দেবে আমেরিকায়। সেই স্বপ্ন-স্বাধ গুঁড়িয়ে দিয়েছে আইনি পোশাকের আড়ালে যমদূত এসআই আকবর।
আকবরকে গ্রেফতার না করা ব্যর্থতা না কৌশল : রায়হান হত্যার প্রধান হোতা এসআই আকবর এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। লাপাত্তা সে। কোথায় গেছে? এ প্রশ্ন এখন বিলিয়ন ডলারের। অবিশ্বাস্য ঠেকছে আমজনতার মধ্যেও। সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে চাঞ্চল্যকর গণধর্ষণ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ধরতে র্যাব-পুলিশের দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই প্রশংসা উবে যাচ্ছে আকবর পলাতক ঘটনার মধ্যে দিয়ে। এসএমপি কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলছেন, আকবর ছাড়া সাময়িক বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হওয়া সকল পুলিশ সদস্যরা মেট্রোপলিটন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। এসআই আকবর যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে এ জন্য সকল সীমান্তে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। মামলা তদন্তকারী পিবিআই চাইলে যে কোনো সময় এদেরকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন এসএমপি কমিশনার। এদিকে আকবর এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় হাজারো প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে সচেতন মহলে। পুলিশের ব্যর্থতা না কোন কৌশল তাও ভাবছেন অনেকে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, আকবর এই মুহূর্তে গ্রেফতার হলে পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপট হয়ে যেতে পারে নিয়ন্ত্রনহীন।
রাজপথে আমজনতা : রায়হান হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বাদ জুমা নগরীর কোর্ট পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের জনতা প্রতিবাদ মিছিল ও সভা করেছে। নামাজের পর নগরীর কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ ও কালেক্টরেট জামে মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদ থেকে মুসল্লিরা রায়হান হত্যার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে বের হন মিছিল সহকারে। দল-মত নির্বিশেষে সবাই ছিল রাস্তায়। মিছিলে-স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে নগরী। মিছিলগুলো নগরীর বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে কোর্ট পয়েন্ট ও কামরান চত্বরে এসে সভায় মিলিত হয়। এছাড়াও উলামা পরিষদ সিলেট, উলামা মাশায়েখ পরিষদ সিলেট ও ইসলামি ঐক্যজোট এবং সমমনা দলগুলো রায়হান হত্যাসহ দেশব্যাপী খুন, ধর্ষণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে মিছিল এবং মানববন্ধন করে। বিভিন্ন সংগঠনের এসব প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনকালে মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে বন্দরবাজার ও আশপাশ এলাকা। রায়হানের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে ফাঁসি নিশ্চিতের দাবি জানান হাজার হাজার জনতা। এদিকে, উলামা পরিষদ সিলেটের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে একাত্মতা পোষণ করে এতে যোগ দেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।
বন্দরবাজার ফাঁড়িতে বাড়তি নিরাপত্তা : বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আরোপ ছিল বাড়তি নিরাপত্তা। রায়হান হত্যার ঘটনায় ফুঁসে ওঠা জনতার হাত থেকে ফাঁড়ি রক্ষা ও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তায় ছিল এসএমপি’র বিশেষায়িত ইউনিট ‘ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (সিআরটি)’র একদল সদস্য। গতকাল জুমার নামাজের পর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ ও কালেক্টরেট জামে মসজিদ থেকে মুসল্লিরা রায়হান হত্যার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের দ্রæত গ্রেফতারের দাবিতে বের হন বিশাল মিছিল সহকারে। মিছিল সহকারে নগরীর অন্যান্য স্থান থেকেও বন্দরমুখী হন প্রতিবাদী জনতা। এসময় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে ফাঁড়ির সামনে সিআরটি’র একদল সদস্যকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এসময় ফাঁড়ির প্রধান ফটক বন্ধ করে ভেতরে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। এ বিষয়ে সিলেট কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি সেলিম মিঞা বলেন, অনাকাক্সিক্ষত সব ধরণের পরিস্থিতি এড়াতে বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে দায়িত্ব পালন করছেন সিআরটি’র একটি টিম।
আমেরিকার স্বপ্ন পূরণ হল না রায়হানের : আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল রায়হানের। আমেরিকায় বসবাসকারী রায়হানের এক চাচার নিকট থেকে গত জুলাই মাসে চলে আসে স্পন্সরশিপ। দেনা করে মেডিক্যালসহ অন্যান্য কাজ দ্রæত সম্পন্ন করে রায়হান। আমেরিকান অ্যাম্বেসির (দূতাবাসের) ফি জোগাড় করার পর তার অ্যাম্বেসিতে ওঠার (ভিসা পাওয়ার জন্য দাঁড়ানোর) কথা ছিল। কিন্তু এই ফি জোগাড় করতে দেরি হওয়াই হয়তো রায়হানের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী-কন্যাসহ আগামী নভেম্বরে ভিসার জন্য দাঁড়ানোর কথা ছিল রায়হানের। তবে ভিসা পাওয়ার আগেই হঠাৎ যেন যমদূত হয়ে সামনে দাঁড়ালেন এসআই আকবর। তার কারণেই রায়হান পরিবারের সব স্বপ্ন এখন ভেঙে চুরমার। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করে আবারও সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। দুই মাসের সন্তান কোলে স্ত্রী তান্নির স্বপ্ন ছিল একটা সুখের সংসার। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন রায়হান। তাকে হারিয়ে দু’মাস বয়সী মেয়ে আলফাকে নিয়ে বাকরুদ্ধ রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তিন্নি (২২)। রায়হানের বড় বোন রুবা আক্তার থাকেন লন্ডনে। ভাইকে শেষ মুহূর্তে এক পলক না দেখতে পেরে আক্ষেপের শেষ নেই তার। দেশে না এলেও তিনি ভাই হত্যার বিচার চেয়ে লন্ডনে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। রায়হানের মা সালমা বেগম জানান, অনেক কষ্ট করেছি ছেলেমেয়েকে নিয়ে, যা কেউ না দেখলে বুঝতে পারতো না। সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে এসআই আকবর ও তার সহযোগীরা। এমন পরিণতি হবে আমার, জীবনেও ভাবিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন