কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে শহিদুন্নবী জুয়েল নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ পোড়ানোর ঘটনায় আলেম সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রশাসন। গতকাল শনিবার পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গত ২৯ অক্টোবর পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় এরমধ্যেই ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
লোমহর্ষক ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অপরদিকে র্যাবের পক্ষ থেকেও ছায়া তদন্ত করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মসজিদে কোরআন-হাসিদের বই পোড়ানোর অধিযোগে বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষের হাতে নিহতের পর লাশ পোড়ানো যুবকের নাম শহিদুন্নবী জুয়েল। তিনি রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রীপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সুলতান যোবাইয়েরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ওই এলাকা ঘুরতে গিয়েছিলেন।
পাটগ্রামে আলেম সমাজের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওহাব ভূঞা, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দেবদাশ ভট্টাচার্য্য, জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু জাফর, পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা, পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহার, পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মোহন্ত উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে বৈঠকে পাটগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ পাঁচ শতাধিক আলেম উপস্থিত ছিলেন। আলেমরা বুড়িমারী মসজিদের ২৯ অক্টোবরের ন্যাক্করজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। গুজব না ছড়িয়ে তদন্ত সংস্থা ও প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আলেম সমাজের প্রতি আহ্বান জানান প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা।
ঘটনার বর্ণনায় পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সুলতান যোবাইয়ের আব্দার নামে একজন সঙ্গীসহ বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। তারা বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন।
নামাজের পর পাঠ করার জন্য মসজিদের তাকে রাখা কোরআন শরীফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ের ওপর পড়ে যায়। এ সময় তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত শহিদুন্নবী জুয়েল ও সুলতান যোবাইয়েরকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হন।
সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে পেট্রোল ও কাঠ দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।
সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকাগুলি ছোড়ে পুলিশ।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ও পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি র্যাবের সদস্যরা টহল অব্যাহত রেখেছেন।
গতকাল বৈঠকের পর রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দেবদাস ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা হচ্ছে এবং কিছু আসামিকে শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যদেরও শনাক্তের কাজ চলছে। এ ঘটনায় যারা যতটুকু অপরাধী তাদের ততটুকু শাস্তির আওতায় আনা হবে। বাহিরাগত বা বিশেষ কোনো দলের লোক সম্পৃক্ত কি-না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শনাক্ত আসামিদের গ্রেফতার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওহাব ভূঞা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনায় দোষীরা কেউ ছাড় পাবে না। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বলেছেন- ‘তিনি উপস্থিতদের অনেককেই চেনেন না’। সুতরাং এসব বহিরাগত কারা এবং কীভাবে এসেছেন সব কিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য হাফিজুল ইসলাম জানান, পবিত্র কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে হত্যার পর লাশ নিয়ে বুড়িমারী প্রথম বাঁশকল এলাকায় জয় ট্রেডার্সের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা লালমনিরহাট-বুড়িমারী জাতীয় মহাসড়কের ওপর কাঠখড়ি ও পেট্রোল ঢেলে লাশে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতির সম্পর্কে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিন বলেন, আমি আসরের নামাজ শেষ করে বাইরে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পাই খাদেম জুবেদ আলীকে দুইজন অপরিচিত ব্যক্তি সালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করে কথা বলছিল। এরপর তারা মসজিদের ভেতরে ঢুকে যায়। আমিও চলে যাই। পরে হত্যাকান্ডের খবর শুনে এসেছি। ওই মসজিদের খাদেম জুবেদ আলী বলেন, আমাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে বলা হয় যে, কোরআন শরিফ ও হাদিস রাখার মসজিদের তাকে নাকি অস্ত্র আছে। এ কথা বলে তাদের (দুর্বৃত্ত) একজন খোঁজ শুরু করেন। একপর্যায়ে সবকিছু তছনছ করেন। এ সময় মসজিদের বাইরে অবস্থানরত হোসেন আলী (৩৫) নামে এক মুসল্লিসহ ৫-৬ জন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করে দুইজনকে আটক করে বাইরে নিয়ে আসেন। মসজিদের বারান্দার সিঁড়িতে প্রথম দফায় তাদের মারধর করা হয়। পরে হাফিজুল ইসলাম মেম্বার এসে তাদের নিয়ে যায়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করে।
ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, আছরের নামাজ শেষে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুইজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি আসেন। মসজিদের খাদেম জুবেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের একজন মসজিদে প্রবেশ করে কোরআন-হাদিসের বই রাখার তাকে অস্ত্র আছে দাবি করে তল্লাশি শুরু করেন। একপর্যায়ে মসজিদের সামনে থাকা ৫-৬ জন মুসল্লি মসজিদের প্রবেশ করে ওই ব্যক্তিকে এবং বারান্দায় থাকা অপর ব্যক্তিকে মারধর করেন। খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই দুই ব্যক্তিকে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষের ভেতরে ঢুকে তালা লাগিয়ে রক্ষার চেষ্টা করি। তবে মুহূর্তে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হতে থাকেন। আমি ও স্থানীয় রফিকুল ইসলাম প্রধান নামে এক ব্যক্তি পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত, ইউএনও কামরুন নাহার, উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম নেওয়াজ নিশাতকে ফোন করে ঘটনাস্থলে আসতে বলি। এরই মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা উত্তেজিত হয়ে পরিষদের দরজা-জানালা ভেঙে এক দুর্র্বৃত্তকে বাইরে বের করে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ নিয়ে লালমনিরহাট-বুড়িমারী জাতীয় মহাসড়কের বুড়িমারী প্রথম বাঁশকল এলাকায় গেলে কিছু লোক কাঠখড়ি ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেখানে ৫-৬ হাজার উত্তেজিত মানুষ ছিল, কারো কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
লালমনিরহাট পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় নিহত শহীদুন্নবীর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম পরিবারের পক্ষে গত শুক্রবার রাতে পাটগ্রাম থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় ২০-৩০ জনের নাম পরিচয় উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়। একই দিন দ্বিতীয় মামলাটি করেন পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত। এ মামলায় শহীদুন্নবীকে ছিনিয়ে নিতে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভাঙচুরসহ আসবাবের ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০ থেকে ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাধাদান ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অভিযোগে তৃতীয় মামলাটি করেন পাটগ্রাম থানার এসআই শাহজাহান আলী। এসব মামলার বিপরীতে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পুলিশ তদন্তের স্বার্থে এখন তাঁদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন