করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আক্রমণে ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এই রোগের প্রধান উপসর্গ -শুস্ক কাশি ও জ্বর, শরীর দূর্বল ও ব্যথা, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা, কখনো পেট খারাপ। সাধারণত শুস্ক কাশি ও জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ। ভাইরাসটির ‹ইনকিউবেশন পিরিয়ড› ১৪ দিন। এটি এতো বড় পরিসরে প্রদাহ তৈরি করে যে, রোগীর পুরো শরীর ভেঙ্গে পড়ে এবং এক সঙ্গে একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যেতে পারে।
দেখা যাচ্ছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় নারী ও পুরুষ পৃথক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করে বিধায় পুরুষরা আক্রান্ত হয় বেশী এবং মৃত্যুর হারও বেশী। নারী আক্রান্তরা সাদা রক্ত কণিকার মতো টি-লিম্পোসাইটের মাধ্যমে জোরালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করতে পারে। অন্য দিকে বয়স্ক ও পুরুষদের ক্ষেত্রে টি-সেল অ্যাক্টিভিটি কম বলে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাও দূর্বল।
করোনাভাইরাস দ্রুতই নিজের মধ্যে পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাসের রূপ পরিবর্তনের হার ৭.২৩ শতাংশ কিন্তু বাংলাদেশে এই হার ১২.৬০ শতাংশ। গবেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে মোট ২৮টি প্রোটিন থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ‹স্পাইক› প্রোটিন এবং এই প্রোটিন দিয়েই সে আক্রমণ করে। সারা বিশ্বে ৬ ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার মার্ক ওয়ালপোর্ট বলেছেন, কোভিড-১৯ কোন না-কোন আদলে আমাদের সাথে আজীবন থেকে যেতে পারে।
করোনাভাইরাস
বিশ্বে কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার প্রায় ৩ মাস পর ৮ মার্চ›২০ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরও দেশের প্রশাসন প্রমমেই সেভাবে জোরাল কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তার মাসুলও জনগন দিয়ে চলেছে। কিন্তু এভাবেতো চলতে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেকেন্ড ওয়েভের (দ্বিতীয় দফা) করোনাভাইরাস আরো বেশী শক্তিশালী হবে। করোনাভাইরাস যাতে দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে সেজন্য নিজের মধ্যে পরিবর্তন করে নিয়েছে। ভাইরাসের মুকুটসদৃশ স্পাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। পরিবর্তিত ভাইরাসের মধ্যে যে স্পাইকগুলো রয়েছে সেগুলোর আক্রমণ এবং মানুষের শরীরের কোষকে ধরে রাখার ক্ষমতা বেশী। প্রতিনিয়ত চরিত্র বদলানোর কারণে ভাইরাসটি বেশ শক্তিশালী। স্পাইক প্রোটিনকে ঢেকে রেখেছে শর্করা জাতীয় অনু ‹গ্লাইক্যান› নামক ‹বর্মবস্ত্র›। বর্মবস্ত্রটি স্পাইক প্রোটিনের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেয় না কোন অ্যান্টিবডিকে। ফলে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা একটু কঠিন হয়ে যায়। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, তারা অন্ততঃ ৩০টি ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন এবং চলতি বছরেই বাজারে ভ্যাকসিন এসে যাবে মর্মে তারা আশাবাদী।
করোনাভাইরাস যে চরিত্র প্রদর্শন করছে তাতে আপাততঃ এটা বলা যায় ভাইরাসটি কখনোই নির্মূল হবে না। ভ্যাকসিন আবিস্কার হলেও সুস্থ থাকার জন্য মানুষকে নির্দিষ্ট সময় পরপর ভ্যাকসিনটি গ্রহণ করতে হবে। এটি ক্রমেই জটিল ও ধূর্ত হয়ে উঠছে। পুরোপুরি কার্যকর ভ্যাকসিন আসার আগে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারীতে ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশে শীত পড়া শুরু হয়েছে। ঐ সব দেশে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে করোনার ‹সেকেন্ড ওয়েভ ‹ বা দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ। ফলে কোন কোন দেশ নতুন করে পুরো লকডাউন করে দেওয়ার কথা ভাবছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে করোনার ‹সেকেন্ড ওয়েভ ‹ শুরু হয়েছে, যা মোকাবিলায় সরকার পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে করোনায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী সুস্থ হয়ে উঠলেও তার দেহে পরবর্তী ৩ মাস ভাইরাসটি থাকতে পারে। তবে সে ভাইরাস দূর্বল হওয়ার কারণে অন্য কারো দেহে সংক্রমিত হচ্ছে না। আশার কথা হলো, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না। বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের ৬৭.২২% সুস্থ এবং ১.৩৭% মৃত। সম্প্রতি আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি›র এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার ৪৫% মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আক্রান্তদের ২৪% এর বয়স ৬০ বছরের বেশী। বস্তিবাসীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ মানুষ এরই মধ্যে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার ৪৫% এবং বস্তিবাসী ৭৪% মানুষের দেহে ২ ধরনের অ্যান্টিবডি গড়ে উঠেছে।
করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার প্রাথমিক উপায় :
(১) করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ফেস-মাস্ক ব্যবহার কাঁচা (ক্রুড) ভ্যাকসিনের মতোই কাজ করে বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন। ক্যালিফোর্ণিয়া ইউনিভার্সিটির জার্ণালে বলা হয়েছে, মাস্কের মাধ্যমে অন্যের দেহে স্বল্প পরিমাণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এক ধরনের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া নিয়মিত হাত ধোয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, অপ্রয়োজনে বের না যাওয়া ইত্যাদিতো মানতেই হবে।
(২) ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেলে ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়িয়ে তাতে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শমত কিছু শ্বাসের ব্যয়ামও করা যায়।
শিশু কিশোরের উপর করোনার প্রভাব : করোনার এই মহামারিতে সারা দেশেই শিশু কিশোররা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তারা যা করতে চায় তা করতে না পারাটা তাদের মানসিক যন্ত্রণার অন্যতম কারণ। সংক্রমণের ভয়ে দেশের অনেক শিশুকে সাধারণ অসুখেও সঠিক সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয় না। অনেক শিশু জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় টিকাও পাচ্ছে না। ফলে করোনা উত্তরকালে শিশুরা একটি বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে। করোনা আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে পৃথক ইউনিট না থাকায় অভিভাবকরা সব সময় একটি আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। অন্যদিকে আক্রান্ত শিশুকে দ্রুত সুস্থ করতে কেউ কেউ ভুল মাত্রায় ওষুধ দিচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। আক্রান্ত অনেক শিশুর ডায়রিয়া হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায় শিশুকে সঠিক ভাবে তৈরী খাবার সেলাইন সঠিক নিয়মে খাওয়াতে হবে। অন্যথায় শিশুর ব্রেইনে স্ট্রোকসহ অন্যান্য মারাত্মক ব্যধির আশংকা রয়েছে।
করোনা চিকিৎসায় ‘সাজেদা হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ : সেপ্টেম্বর ২০ মাসের প্রথম সপ্তাহে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়লে আমাকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জস্থ (সিমরাইল, চিটাগাংরোড) সাজেদা হাসপাতালে গত ১০ সেপ্টেম্বর’২০ ভর্তি হই। সেখানে আমি গত ১৭ সেপ্টেম্বর›২০ পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ আসিফ মুজতবা›র সার্বিক তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধিন ছিলাম। হাসপাতালটিতে ডাঃ মুজতবার মতো মোট ৩০ জন ডাক্তার, মিসেস রেশমার মতো ৫০ জন স্টাফ নার্স এবং ৭০ জন সেবাকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা গ্রহণরত অবস্থায় যে সেবা শুশ্রূষা আমি পেয়েছি তা অতুলনীয় এবং নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। হাসপাতাল নেওয়া হলে নিয়ম মোতাবেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হয়। এরপর থেকে পরিবার-পরিজনসহ বাকী দুনিয়া থেকে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমার দেখভালের সার্বিক দায়িত্ব চলে যায় নিবেদিত প্রাণ ডাঃ মুজতবার মতো ডাক্তারবৃন্দ ও মিসেস রেশমার মতো দায়িত্বশীল নার্সবৃন্দের নিকট। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখানে আমার মতো সকল কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা শতভাগ বিনা মূল্যে চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, রোগীদের বিনা মূল্যে ৩ বেলা খাবারও পরিবেশন করা হচ্ছে নিয়মিত।
১৬ সেপ্টেম্বর›২০ রাতে ডাঃ মুজতবা আমাকে জানালেন, আপনার নেগেটিভ রিপোর্ট এসে গেছে। আর এক মূহুর্ত নয়, আপনাকে আগামীকাল দুপুরে রিলিজ করে দেওয়া হবে। যথারীতি পরের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর›২০ আমাকে বিদায় করার সময় পরবর্তী ১৪ দিন আমাকে কি কি ওষুধ খেতে হবে এবং কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার একটি ফর্দ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। যা এক কথায় অসাধারণ। পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং অনুজ দীপু ও পুত্র সিয়ামের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে আছে, কারন এদের পরামর্শেই আমি এখানে ভর্তি হয়েছিলাম। এরকম একটি ভাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পেরে আমি উৎফুল্ল।
সাজেদা হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ কিছু কথা:
বাংলাদেশে সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ সম্পূর্ণ অলাভজনক সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান হলো ‘সাজেদা ফাউন্ডেশন’। চিকিৎসা সেবা প্রদান এই প্রতিষ্ঠানের বহুবিধ জনসেবা মূলক কর্মকান্ডের মধ্যে অন্যতম। আপামর জনসাধারণের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মিসেস জাহেদা ফিজ্জা কবীর নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জস্থ সিমরাইল (চিটাগংরোড) এলাকায় একটি এবং রাজধানী ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি মোট দু›টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সাজেদা হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ প্রাথমিক ভাবে ৫০ সজ্জা বিশিষ্ট একটি সাধারণ হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ রুপে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের আইসোলেশন এবং চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। শুরুর দিকে এখানে গর্ভবতী সেবা, শিশু বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, অর্থোপিডিক্স, সার্জারী, প্যাথলজি, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফীসহ যাবতীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্বিক তদারকির অধিনে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি রেনেটা›র সাথে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি রোগীর সার্বিক সেবা, আইসোলেশন, ভেন্টিলেশন, ডায়ালাইসিস, আইসিইউ-সহ যাবতীয় সুযোগ এখানে প্রদান করা হয়। তাছাড়া ২৪ ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসতো রয়েছেই।
প্রতিদিন এখানে প্রায় ১৫০ জন রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। গত সেপ্টেম্বর’২০ মাসে সর্বমোট ৬৫০জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে হাসপাতালটিতে।
ড. হাবিবুর রহমান খান
শিক্ষা ও জনসংযোগবিদ,
পরিচালক, জনতার টিভি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন