শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ১২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

চলতি শীত মৌসুমে ঠান্ডাজনিত রোগের কারণে করোনা সংক্রমণ বাড়ার যথেষ্ট আশংকা রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপে সেকেন্ড ওয়েভে শুরু হয়ে থার্ড ওয়েভ শুরুর কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানে গত কয়েকদিনে গড়ে প্রতিদিন ২ লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এখন বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে ২৭ জনই ইউরোপীয় দেশগুলোর বাসিন্দা। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৮১ লাখের বেশী রোগী শনাক্ত হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটাই ভালো। বাংলাদেশে ৪ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯১ জন, আর মারা গেছে ৬ হাজার ৭৭২ জন। চলতি শীত মৌসুমে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কার পর তা মোকাবিলায় গত সেপ্টেম্বরে এর রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তুতি নাজুক হলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ সামলানো কঠিন হবে। এতে সংক্রমণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে, যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্ততি সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন। দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দেশে করোনা ভাইরাস ৮মার্চ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গত ৭ মাসে কোনদিনই এ মৃত্যুর মিছিল থেমে থাকেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতির বেশি অবনতি হলে গরীব দেশ হিসাবে তা সামাল দেয়া আমাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। কাজেই সংক্রমণ যাতে না বাড়ে, সেদিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া দরকার। করোনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল ছিল। গত জুন-জুলাই মাসে করোনার প্রকোপ দেখা দিলে অনেক সাধারণ রোগী হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনী, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে করোনা সন্দেহের কারণে জরুরী চিকিৎসা না পেয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ছোটাছুটি করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন অনাকাক্সিক্ষত অবহেলার কারণে বিনা চিকিৎসায় অনেকে বাড়িতেই মৃত্যুবরণ করেছে।

দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, ইতোমধ্যে মন্ত্রীসহ ঊর্দ্ধতন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন শিল্পপতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এস. আলম গ্রুপের পরিচালক ৫টি ব্যাংক সহ ৩৫ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক মোরশেদুল আলম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র একটি ভেন্টিলেটরের অভাবে পরিবারের সকলের সামনে মৃত্যুবরণ করেন। দেশে এস.আলম গ্রুপের মত অনেক শিল্পপতি, আমলা, জনপ্রতিনিধি আছেন, যারা সাধারণ জ্বর-কাশিতেও চিকিৎসা ও চেকআপের জন্য বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আসেন।

দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে শিক্ষা ও চিকিৎসা। স্পর্শকাতর এ দুটি বিষয়কে কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নাই। কিন্তু দুর্নীতি অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এই দুটি বিষয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চিকিৎসা খাতে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বাজেট থাকা সত্তে¡ও চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি না হবার কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব শুধু সাধারণ রোগীদেরই নয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারি আমলা ছাড়াও এমপি-মন্ত্রীদেরও আস্থার অভাব রয়েছে। এ অনাস্থার কারণেই তারা প্রায়ই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা না থাকার কারণ হচ্ছে, প্রয়োজনীয় দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি না হওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা, মেধাবী চিকিৎসকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা, কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়াও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে জরুরী রোগী দেখানোর ক্ষেত্রে অধিক সিরিয়াল, বেশির ভাগ নির্ভুল রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে এক ডায়গনস্টিক সেন্টারের সাথে অন্য ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টের মিল না থাকা, অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের অভাব, প্রয়োজনীয় ডাক্তারের স্বল্পতা, ডাক্তারদের বাসা, চেম্বার ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। দেশে প্রতি বছর সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ৪ হাজার ৬৮ জন ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে ৬ হাজার ২৩৩ জন অর্থাৎ কমবেশি ১০ হাজার ২৯৯ জন ডাক্তার পাস করেন। অথচ হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের সংকট প্রায় লেগেই থাকে। এতে করে প্রতি উপজেলায় ৩/৪ লাখ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা ডাক্তারের স্বল্পতায় ঠিকমত চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

দেশে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা রয়েছে। ডিএমডিসি’র ২০১৮ সালের তথ্যমতে, আমাদের দেশে মোট ডাক্তারের হিসাব আনুযায়ী ১৮৪৭ জন মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার নিয়োজিত। তাছাড়া চিকিৎসকদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করার কারণে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক দেশের বাইরে চলে যায়। ফলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকের স্বল্পতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কিছু ডাক্তারের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটা বড় কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। অনেক ডাক্তারের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট না করলে তারা গ্রহণ করতে চান না। এছাড়াও ভুল রোগ নির্ণয়, ভুল অপারেশন ও ওষুধের দাম অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় রোগীরা দেশের চিকিৎসার উপর অনেকটা বিমুখ হচ্ছে। বর্তমান সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির কারণে ইদানিং সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে এখন স্বল্প খরচে অনেক ভালো নির্ভুল চিকিৎসা হচ্ছে। এছাড়াও দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারী ইন্সটিটিউটসহ বেশ কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল তৈরি হওয়ায় আমরা তার সুফল ভোগ করছি। তাছাড়া ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের পাশেই আন্তর্জাতিক মানের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। এখানে সব ধরনের জটিল রোগের অপারেশন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা অধিক গুরুত্ব বহন করে এবং বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারকে অবশ্যই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিরপেক্ষতার সাথে দুর্নীতি দমন করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে মেধাবীরাই চিকিৎসার মতো মহৎ পেশায় সেবা দিয়ে থাকেন। এ কারণে, তাদের অবহেলা করার কোন সুযোগ নাই। সমাজে তাদের সর্বোচ্চ মর্যাদা, বেতনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যোগ্য ডাক্তারদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন হলে মেধাবী ডাক্তারদের বিদেশে যাওয়া বন্ধ হবে এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন ঘটবে। এতে দেশের জনগণের চিকিৎসার প্রতি আস্থা ফিরে আসবে এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বন্ধ হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয়, জেলা শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানে দেশে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। অসংখ্য মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে মারা যাচ্ছে। অন্তত প্রত্যেক মেডিকেল কলেজে করোনারী কেয়ার ইউনিট (সি, সি, ইউ) চালু থাকলে বেশির ভাগ রোগী বাঁচানো সম্ভব। ডাক্তারদের ডিউটির ক্ষেত্রে সেবামূলক মনোভাব ও আন্তরিকতা থাকতে হবে। ডিউটির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ডাক্তারদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য চিকিৎসা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। এতে দেশ উন্নয়নের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা সৃষ্টি হলে আশেপাশের দেশ থেকে রোগী আমাদের দেশে চিকিৎসা নিতে আসবে। এতে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে। সকল চিকিৎসা দেশে হলে মানুষের অনেক কষ্ট লাঘব হবে। কম টাকায় চিকিৎসা পাবে ও দুঃসময়ে আপনজন কাছে থাকবে। এতে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বাড়বে এবং ভবিষ্যতে করোনা ভাইরাসের মত বিপর্যয় মোকাবিলা করা সহজ হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন