পবিত্র কুরআনুল কারীমের ৭১ নং সূরা নূহের ২৩তম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা বললো, তোমরা কিছুতেই নিজেদের উপাস্যকে ত্যাগ করবে না, ছাড়বে না ওয়াদ্দাআ এবং সুউওয়াকে, ইয়াগুছা, ইয়াউকা, নাসরাকেও নয়।’ (নূহ: ২৩) এ সূরায় আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে মানুষের মনগড়া হাতে তৈরি মাবুদদের বিসর্জন না দেয়ার কারণে সাধারণ শাস্তি আপতিত হয়েছে বলে ঘোষিত হয়েছে। এসব মূর্তিকেই প্রিয় নবী সা.-এর সময়কালেও কোনো কোনো সম্প্রদায় পূজা-অর্চনা করতো। যার ধারাবাহিকতা বর্তমানেও আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আমরা নিজেদেরকে মুমিন-মুসলমান দাবি করলেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এহেন শিরক থেকে নিজেদের রক্ষা করি না। করার চেষ্টাও করি কি? আমরা সম্ভবত বাই-চান্স মুসলমান বিধায় এ ধরনের শিরক থেকে বাঁচার চিন্তাও করি না। বাই-চয়েস মুসলমান হলে এ ধরনের শিরকের ধারে-কাছে যাওয়ার প্রশ্নও উঠতো না। মুষ্টিমেয় মুমিন-মুসলিমের এ ধরনের শিরক-বিদআত দেখলেই গায়ে আগুন জ্বলবে, এটাই ঈমানের দাবি। এ দাবি উচ্চকিত করার জন্যে যুগে যুগে দেশে দেশে অনেক বনী আদম বুকের তাজা খুন ঝরিয়েছে। এ ধারাবাহিকতা এখনও প্রবহমান। এ পর্যায়ে আমরা মূর্তি-ভাস্কর্যের উত্থান এবং গতি-ধারা কুরআন-হাদিসের আলোকে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো।
নূহ আ.-এর যুগে মূর্তিপূজা
পবিত্র কুরআনের বর্ণিত আয়াতে আমরা নিম্নের এ পাঁচটি মূর্তি বা ভাস্কর্যের উল্লেখ পাই:
ওয়াদ্দা: এটি ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার মূর্তি। যে না-কি স্বীয় ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা দ্বারা পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। আকৃতি পুরুষের।
সুওয়াআ: প্রতিষ্ঠিত করা ও স্থিত থাকাকে বলা হয় সুওয়াআ। এটি বাকায়ে আলমের মূর্তি। নারীর আকৃতি।
ইয়াগূছা: এটা গাওছুন থেকে নিষ্পন্ন। অর্থ হচ্ছে, ফরিয়াদ শ্রবণকারী। এটি প্রয়োজন পূরণ আর বিপদাপদ থেকে মুক্তির মূর্তি ছিলো। ঘোড়ার আকৃতির। দ্রুত দৌড়ে সাহায্যকারী। হিন্দুরা এটিকে ইন্দ্র মূর্তি বলে ব্যাখ্যা করে।
ইয়াউকা: এটা আওক থেকে নিষ্পন্ন। অর্থ, বাধা দেয়া ও অপনোদন করা। এটি শত্রুদের এবং অন্যান্য বিপদাপদ দূর করার জন্য বাঘের আকৃতির মূর্তি ছিলো।
নাসরা: এটা দীর্ঘ জীবনের মূর্তি। স্বর্ণ ঈগলের ন্যায় এর আকৃতি।
আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে ওই পাঞ্জেতনের নাম উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে হযরত নূহ আ.-এর সম্প্রদায় পূজার যোগ্য ভাবতো। আল্লাহতায়ালা যেগুলোকে হযরত নূহ আ.-এর মাধ্যমে ওই সম্প্রদায়কে সংশোধনের আদেশ দেন। তাই, হযরত নূহ আ. ৯৫০ বছরব্যাপী অবিরাম তাবলীগ করতে থাকেন। কিন্তু ওসব লোক কিছুতেই তাদের মনগড়া পূজা-অর্চনা পরিত্যাগ করতে সায় দিলো না। বুখারী শরীফ পৃ. ৭৩২-এ রয়েছে: ওয়াদ্দা, সুওয়াআ, ইয়াগূছা, ইয়াউকা ও নাসরা- এরা ছিলো আল্লাহর বান্দা এবং পুণ্যাত্মা ব্যক্তিত্ব। এরা নূহ আ.-এর সম্প্রদায়ের পূর্বেই গত হয়েছেন। তারা মারা গেলে শয়তান তার সম্প্রদায়ের লোকদের মনের মধ্যে এ প্ররোচণা প্রবেশ করায় এই বলে: এসব বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব যেখানে যেখানে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন, সেসব স্থানে প্রত্যেকের পৃথক প্রতিমা তৈরি করে দাঁড় করিয়ে দাও আর সেখানেই ওসব বুজুর্গের নামকরণ কর ওসব মূর্তির। লোকেরা ঠিক তা-ই করলো। তখন কিন্তু ওসব মূর্তি তারা তৈরি করেছিলো মাত্র। এরপর ওসব মূর্তি স্ব স্ব নাম অনুযায়ী আকৃতি ধারণ করেছিলো। এরপর যখন স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওই বংশের নির্মাতারা মরে গেলো এবং এ ধারাপরম্পরা হলো দীর্ঘ। তখন আর লোকদের মধ্যে পূর্ববর্তী আসল ঘটনা এবং নেপথ্য কাহিনী সম্পর্কে আর কোনো জ্ঞান থাকলো না। তখনই তারা ওসব মূর্তির পূজা-অর্চনা আরম্ভ করে দিলো, যা নির্ঘাত শিরক।
এরপর যখন এসব লোকও মারা গেলো এবং একটা দীর্ঘ যুগপরম্পরা অতিবাহিত হয়ে গেলো, তখন এই সুযোগে ইবলীস পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণ করা লোকদের অন্তরে এ প্ররোচণা দিয়ে দিলো, পূর্বেকার লোকেরা এসব মূর্তির পূজা-অর্চনা করতো এবং এগুলো থেকেই পেতো তৃপ্তি। অর্থাৎ, ওসব লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলো যে, ওসব বুজুর্গ লোক দোয়া করতেন, তবেই ঝরতো মুষলধারে বৃষ্টি। তাই, ইবলীস প্ররোচণা দিলো যে, তোমাদের বাপ-দাদারা এ মূর্তিগুলোর সামনেই প্রার্থনা করলে তবেই পেতো পানি। এখন তোমরাও ওগুলোর কাছেই চাও। আর ওগুলোকে কর সম্মান, তবেই তোমাদের মন-বাসনা পূর্ণ হবে নিশ্চয়।
মুফাসসির ইবনে কাছীর প্রমুখ লিখেছেন, হযরত নূহ আ.-এর সম্প্রদায় আল্লাহতায়ালা ছাড়া ওয়াদ্দা, সূওয়াআ, ইয়াগুছা, ইয়াউকা এবং নাসরা-কে স্ব স্ব আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী কার্য-সম্পাদনকারী, প্রয়োজন পূরণকারী এবং সমস্যা সমাধানকারী ভেবেছে। আর আল্লাহতায়ালার রাসূল হযরত নূহ আ.-এর সাথে মতানৈক্য করেছে। শেষে পানিতে ডুবে বারযাখী আগুনে প্রবেশ করেছে। আর এসব লোক আল্লাহতায়ালা ছাড়া আল্লাহতায়ালার ওসব প্রিয় বান্দা ওয়াদ্দা, সুওয়াআ, ইয়াগুছা, ইয়াউকা ও নাসরা-কে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণকারী মনে করতো। আর যারা একমাত্র আল্লাহতায়ালাকেই মনোবাসনা পূর্ণকারী মনে করতো আল্লাহতায়ালা তাদেরকেই রক্ষা করেছেন।
এভাবে কুরআনের বিভিন্ন তাফসীর এবং বিশুদ্ধ হাদিসে পুরাকালের মূর্তি ও স্ট্যাচু পূজার ব্যাপারে তুল্য-মূল্য বিশ্লেষণ:
জাহেলি যুগে আরবদের মূর্তিপূজা
অবশ্য ওয়াদ্দা, সুওয়াআ, ইয়াগুছা, ইয়াউকা ও নাসরা-এর মূর্তি ছাড়াও আরবে অগণন মূর্তি ছিলো, যেগুলোকে আরবের অধিবাসীরা মনে করতো মাবুদ বা উপাস্য। এগুলোও ছিলো আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য বান্দাদেরই মূর্তি। এগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরূপ:
লাত: হযরত ইমাম বুখারী রহ. হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে সনদসহ বর্ণনা করেছেন, লাত ছিলো একজন বুযুর্গ ব্যক্তি। যিনি হাজিদের ছাতু গুলিয়ে পান করাতেন। ইবনে জারীর হযরত ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও রবী ইবনে আনাস থেকে বর্ণনায় এও লিখেছেন যে, যখন ওই লাত বাবা মরে গেলো, তখন তার কবরের ওপর কাপড় চড়ানো হতে থাকে। ধীরে ধীরে তার আকৃতির মূর্তি তৈরি করে এ ধারণা বদ্ধমূল করে নিলো যে, এর আত্মাও পাথরের মূর্তির মধ্যে সেঁটে গেছে।
উয্যা: এ নারী ছিলেন একজন বুড়ো মা। কুরাইশদের অন্তরে এ মায়ের ছিলো অনেক বড় মাহাত্ম্য। হযরত আবু সুফিয়ান রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কুফর অবস্থায় এ ধারণা করে ছিলেন যে, উহুদ যুদ্ধে আমাদের এ মা উযযার সাহায্যে বিজয় অর্জিত হয়েছে। এছাড়া কুরাইশ গোত্রের লোকেরা লাত বাবার ন্যায় উযযা মায়েরও শপথ করতো। আর ওই কসমকে সর্বাবস্থায় পূর্ণ করতো।
মানাত: এও ছিলো একজন নারী। আরবের বিখ্যাত গোত্র খোযায়া, আওস ও খাজরাজ ছাড়া আর আর আরব গোত্রও ইসলাম গ্রহণের পূর্বে জাহেলি যুগে মানাত বিবির ইবাদাত করতো। আর সমুদ্রের মুছাল্লাছল এর তীরে কাদীদ নামক স্থানের ওপর মানাত বিবির মূর্তি স্থাপিত হয়েছিলো। তার সম্মানার্থে ওসব লোক বায়তুল্লাহর হজ্জের ইহরামও ওই মানাত বিবির মূর্তির স্থানে পৌঁছে তবেই বাঁধতো।
ইব্রাহীম ও ইসমাইল: কুরাইশরা সাইয়্যেদেনা হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল আ.-এর ন্যায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের মূর্তিও বানিয়ে রেখেছিলো। তাঁরা তাঁদের হাতে ওই ধরনের কাঠসমূহ আঁকড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন, যে ধরনের কাঠসমূহ দ্বারা কুরাইশ গোত্রের লোকেরা ফাল বা ভাগ্য গণনার কার্য সম্পাদন করতো। হযরত নবী করীম সা. মক্কা বিজয়ের পর যখন হযরত ইব্রাহীম ও হযরত ইসমাইল আ.-এর মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ভূপাতিত করেন, তখন এও ইরশাদ করেছিলেন যে, মুশরিকদের ওপর আশ্চর্য হতে হয়, মূর্খ-নাদানরা ভালো করেই জানতো, হযরত ইব্রাহীম আ. কখনো পাসা নিক্ষেপ করেননি।
হুবল: এ সম্পর্কেও এটা জানা আবশ্যক, এটাও কোন মামুলি পাথর ছিলো না। বরং হুবল এবং এ ধরনের আরো ক’টি মূর্তিও ছিলো মানুষেরই। সাইয়্যেদ আমীর আলী মালিহাবাদী তদীয় তাফসীর মাওয়াহিবুর রহমান পারা ৩০, পৃ. ৭৮৯ ‘আমি ইবাদাত করি না তোমরা যার ইবাদাত কর’- এর অধীনে লিখেছেন, হুবলের হাকীকত হলো এই, সে ছিলো একজন মানুষ। যাকে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেন। এরপর নির্ধারিত সময়ে তাকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করান। মুশরিকরা একটা পাথর খোদাই করে রাখলো, আর বললো, এটা আমাদের হুবল। আর স্বীয় ধারণায় বললো, হে হুবল: তুমি এ পাথরের মধ্যে এসে প্রবেশ কর। আর দাবি করে বসলো, সে এসে গেছে।
খ্রিস্টানদের ঈসা আ.-এর মূর্তি পূজা
মাসীহ : ইনি আল্লাহর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূল আর ছিলেন কিতাবধারী পয়গাম্বর। ইহুদীরা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আর মোকদ্দমা দাঁড় করিয়ে তাঁকে শূলে ঝুলানোর ন্যায় শাস্তির যোগ্য বলেও ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাঁকে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং আকাশমন্ডলীর ওপর জীবিতই উঠিয়ে নিয়েছেন। আর খ্রিস্টানদের ফেলে দিয়েছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। কেউ বা বললো, তিনি ক্রুশের উপরে মারা গেছেন আর তৃতীয় দিন জীবিত হয়ে উঠেন এবং চলে গেছেন আকাশমন্ডলীর ওপর। আর তাদের ধারণা মতে, যে শূলের ওপর তিনি জীবন দিয়েছিলেন চিহ্নস্বরূপ আজো তার আকৃতি ঘরসমূহে, উপাসনাগারসমূহে এবং স্ব স্ব গলায় ঝোলায়। কোন কোন ব্যক্তিত্ব হযরত ঈসা আ. ও তাঁর শ্রদ্ধা ভাজন মা হযরত মরিয়াম আ.-এর মূর্তিসমূহ ঘর-বাড়ি ইত্যাদিতে শোভা বর্ধনের জন্য রাখে ঝুলিয়ে। আর তাঁকে বলে আল্লাহতায়ালার পুত্র, আর এও বলে, আল্লাহতায়ালা (খোদাওয়ান্দে বাপ) হযরত ঈসা আ. কে আকাশের বিভিন্ন স্থানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং সব ধরনের রাজত্বের ইখতিয়ার, সামর্থ্য, শাসন-ক্ষমতা এবংবিধ অভিধায় তাকে সুউচ্চ করেছেন, সবকিছু করে দিয়েছেন তার পদানত। তাকেই সব জিনিসের বানিয়েছেন সর্দার। তিনিই সর্বোতোভাবে সব কিছু বাস্তবায়ন কর্তা। (দ্র. আফসিউন ১:২০-২২)।
শত শত হাজার হাজার বছরের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে প্রতীয়মান হবে, ইবলীস শয়তান মানবমন্ডলীকে বিভ্রান্ত করে আল্লাহর একত্ববাদ থেকে ভিন্ন মত ও পথে ধাবিত করার জন্য হেন কোনো পন্থা নেই যা সে গ্রহণ করে নি। শিরকের উপাদান ৫ বলি আর ৩৬০ বলি-গাণিতিক বিশ্লেষণটা মুখ্য আদৌ নয়। কারণ, সভ্যতার বিভিন্ন বাঁকে বনী আদমকে বিভ্রান্ত করার জন্য অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মনগড়া চোখ-ধাঁধানো নিত্য-নতুন আবিষ্কার নিয়ে হাজির হয়। আমাদের ন্যায় বোকা মানুষগুলোকে দিয়ে তাদের ব্যবসাটা করে বগল বাজাতে থাকে। মূর্তি বলি, পুতুল বলি, স্ট্যাচু বলি, খেলনা বলি, শো-পিচ বলি- এ সব কিছুর একটাই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, মুমিন-মুসলমানের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে ছলে-বলে-কৌশলে শিরকটা সেঁটে দিতে হবে। দিবস-রজনী তাদের গবেষণার এটাই বিষয়। আর আমরা মুসলমানরা মূল ও মৌলিক জ্ঞানের অভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে তুলি তৃপ্তির ঢেঁকুর। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি, আমরা নামসর্বস্ব মুসলমান? যদি তা না হই তাহলে আমাদের কুরআন-হাদীস প্রদর্শিত মত ও পথকেই বেছে নিতে হবে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, অনুবাদক, সংগঠক ও সম্পাদক, আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন