জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে আর আন্দোলন না করার আশ্বাস দিয়েছেন আলেমরা। শুরু হওয়া আলোচনা চলবে, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে সৃষ্ট অস্থিরতা নিরসনে সোমবার রাতে দেশের শীর্ষ আলেমদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই তথ্য জানান।
ঢাকায় ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপে হেফাজতে ইসলামের নেতাসহ কওমি আলেমরা বিরোধিতা করে আসছেন। এর মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর রাতের কোনো একসময় কুষ্টিয়া শহরের পাঁচরাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ডান হাত, পুরো মুখ ও বাম হাতের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘ধানমন্ডিতে আমার বাসভবনে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতি ও আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাওলানা মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে দেশের ১২ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম একসঙ্গে বসি এবং মতবিনিময় করি। সেই সভায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, মাওলানা মাহফুজুল হক, ওবায়দুল রহমান নদভী, মাওলানা মো. নুরুল ইসলামসহ ১২ জন আলেম উপস্থিত ছিলেন। আমাদের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী (ফরিদুল হক খান), ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আমাদের অতিরিক্ত সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘৫ ডিসেম্বর সারাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা মাহমুদুল হাসানের ডাকে এক হয়েছিলেন। সেখানে তারা অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি পত্র তারা প্রেরণ করেছিলেন, সেই পত্রের কপিও তারা আমাদের দিয়েছেন। সেটার বিষয়ে আলাপ-আলোচনার বিষয়েই আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন। একটা ফলপ্রসূ আলাপ হয়েছে।’‘সিদ্ধান্ত এই রকমই আমরা যেসব আলাপ করেছি, এগুলো নিয়ে আরও আলাপ হবে। আমরা মনে করি, আলাপের মাধ্যমে আমরা সব সমস্যার সমাধান করব। আমরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারব।
তিনি আরো বলেন, যেসব কথাবার্তা তাদের আলাপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে, সেগুলোর সবই আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। তারাও হৃদয় দিয়ে ধারণ করেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের জাতির পিতাকে। তারাও স্বীকার করেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন খাঁটি মুসলমান, তার ঈমানি দায়িত্ব যেগুলো সেগুলো তিনি পালন করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটুকুু সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্য যেটুকু হয়েছে আরও যেসব প্রশ্ন আছে, আমরা ঐকমত্যের মাধ্যমে শেষ করতে পারব, ইনশাআল্লাহ। তাদের পাঁচটি প্রস্তাবের সবগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা সবগুলো বিষয়েই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। আলাপ-আলোচনা যে শুরু হয়েছে, এটা চলবে।
ভাস্কর্যের বিষয়ে তারা কী বলেছেন- এ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ করবেন। আলাপ শুরু হয়েছে, আলাপের মাধ্যমেই আমরা এগুলো সব শেষ করব।
তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পরিবর্তে মুজিব মিনার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তারা কি এখনও সেই অবস্থানে আছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যথার্থই বলেছেন, ওখানে একটি মুজিব মিনার তৈরি করার জন্য, কুতুব মিনারের আদলে। তারপর তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছেন। সবকিছুই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। যতটুকু আলাপ করেছি আমরা মনে করি একটি সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তারা এই আবেদন রেখেছেন, কেউ যাতে রাস্তায় নেমে এসে ভাঙচুর না করেন। কেউ যেন এসে কোনো ধরনের শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে, এ ব্যাপারে তারা আমাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্যে আসছেন।
আসাদুজ্জামান খান আরও বলেন, ফেসবুকে নানা ধরনের উত্তেজনা ছড়ানোর যে প্রয়াস চলছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে তারাও কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কোথাও যাতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কেউ না করেন সেই আহ্বানও তারা রেখেছেন।
তিনি বলেন, পাঁচটি দাবি তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই শেষ কতে চান। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আশা করি আলোচনার মাধ্যমেই ফয়সালা করতে পারব। এর মানে তাদের দাবিই শেষ পর্যন্ত আপনাদের মানতে হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মানতে হচ্ছে, সেটা আমি বলিনি। আপনি কিন্তু অন্যরকম বললেন। আমি বলেছি আলোচনার মাধ্যমে আমরা শেষ করব।
যে ইস্যু নিয়ে আলোচনা তা সংবিধানপরিপন্থী, এ বিষয়ে একটি আইন আছে। যেখানে দিয়ে কথা বলা দরকার সেখানে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় তারা আলোচনা করছে। সরকার কি নতজানু নীতি নিয়েছে এক্ষেত্রে- একজন সাংবাদিকের এমন জিজ্ঞাসার জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। সরকার কখনও নতজানু নীতিতে বিশ্বাস করে না।’
‘তারা বলেছেন, কোনো রকমের আন্দোলন তারা করবেন না। পাঁচটি দাবি আলোচনার মাধ্যমে তারা শেষ করতে চান। এগুলো সংবিধানবিরোধী হলে তো তা মানার শক্তি আমাদের নেই। আমরা সংবিধানের বাইরে যাব না। আমরা কারো ধর্মীয় সেন্টিমেন্টেও আঘাত করতে চাই না। আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে চাই’ বলেন আসাদুজ্জামান খান।
ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে সরকার দোটানায় কিনা- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সংবিধানের বাইরে যাব না। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত দেব না। আমরা আলোচনার মাধ্যমে শেষ করব। ভাস্কর্য যেখানে যেভাবে আছে সেভাবে থাকবে কি থাকবে না, আমরা সবগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।’
‘স্পষ্ট কথা হলো- ভাস্কর্য কেন করা হয়? এটাকে কিন্তু পূজা করা হয় না। এটা মূর্তি নয়। আমরা বলছি, জন্মজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু কে ছিলেন, হৃদয়ে ধারণ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখতে চাচ্ছি। সবই আলোচনার মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাধানে আসব বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাদের দেয়া পাঁচটি প্রস্তাবনা নিয়ে কথাবার্তা চলছে।’
ভাস্কর্য নির্মাণের বিষয়ে সরকার কি নমনীয়- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘নমনীয়র কথা আমি বলিনি। আমরা বলেছি আলোচনার মাধ্যমে শেষ করব। সেখানে ভাস্কর্য থাকবে না- এটা আমি কখনও বলিনি। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এগুলো শেষ করব। আমি স্পষ্ট করে বলছি, কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে ভাস্কর্য ওখানে থাকবে না, ওখান থেকে সরিয়ে দেব। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এই জায়গায় অন্য কিছু হবে।’
‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা দেখা করতে চেয়েছেন, আমরা প্রস্তাব দেব। তিনি রাজি হলে দেখা করবেন। কোভিড-১৯ এর কারণে প্রধানমন্ত্রীকে সুস্থ রাখাও আমাদের কর্তব্য। উনি যদি দেখা করতে ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’
এই পরিস্থিতিতে ভাস্কর্য নির্মাণকাজ কি চলমান থাকবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘চলমান তো আছেই। সেগুলো সবই আপনারা দেখছেন। আমরা আলোচনার মাধ্যমেই শেষ করব।’
বিকল্প প্রস্তাবে মিনার ও ভাস্কর্য কি একসঙ্গে থাকবে- এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘না। আমরা বলছি কোনোটাই সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা নিয়ে আরও আলোচনা হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা বড় পরিসরে আলাপ করবেন।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন