বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ। এ দেশে মুসলমানদের অবস্থান বেশ পুরনো। প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মুসলমানগণ এক ও অভিন্ন পদ্ধতিতে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে আসছিল। এতে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে একতা ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। কিন্তু ইদানীং কিছু লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশাল হাদিস-ভান্ডার হতে নামাজসহ ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন পদ্বতি সমাজে চালু করণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এতে সু-ফল লাভের বিপরীতে সর্বনাশ-ই বয়ে আনছে। মুসলমাদের একতার বন্ধনে ফাটল তৈরি হচ্ছে। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, কাদা ছোড়াছুড়ি বেড়েই চলছে। অথচ মুসলমানদের মাঝে ঐক্য অটুট রাখা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরানে ইরশাদ করেন: ‘তোমরা আল্লাহর রশিকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আলে-ইমরান : ১০৩) হাদিসে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করো, সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন-যাপন করো না। কারণ বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করলে শয়তানের কু-প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
কুরান-হাদিসের উক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের একতা ও সংঘবদ্ধতা অপরিহার্য জরুরি। আর তারা যে বিষয়ে মতভেদ বা ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত; তার কোনটাই ফরজ বা মৌলিক বিষয় নয়। আমাদের দেশের প্রায় মসজিদে নামাজ-পদ্ধতির ভিন্নতায় মুসল্লিগণ দু ভাগে বিভক্ত। এমনকি সামাজিকভাবেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অথচ মুসলিম সমাজে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা, বিভেদ তৈরি করা জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কুরানে এসেছে: ‘ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ। (সুরা বাকারা : ১৯১)
নামাজে সুরা ফাতেহা শেষে ‘আমিন’ আস্তে নাকি জোরে, হাত উত্তোলন কান নাকি কাঁধ বরাবর, হাত নাভির নিচে নাকি বুকে, প্রথম তাকবির ছাড়াও রফয়ে ইয়াদাইন বা উভয় হাত অতিরিক্ত উত্তোলন করা বা না করা, নামাজ-শেষে সম্মিলিত মুনাজাত করা না করা ইত্যাদি বিষয়ে মতভেদ ও দ্বন্দ্ব। মূলত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাজের পদ্ধতি একাধিক ছিল এবং সবগুলোই সুন্নাহ। সাহাবায়ে কেরাম একেকজন নবিজিকে যে পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করতে দেখেছেন, অনুরূপই বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও তাঁদের মাঝে এই মতপার্থক্য বিদ্যমান ছিল। তাই বলে তাঁরা তো এ নিয়ে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে মত্ত ছিল না! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবগুলো সুন্নাহ জীবন্ত রাখার মানসে মাযহাবের ইমামগণ ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন এবং সবাই কুরান-হাদিসের আলোকে সাধারণ মুসলমানের জন্য ইসলামের বিধি-বিধান সহজতর করে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ইসলামের প্রায় প্রথমদিক থেকেই হানাফি মাযহাব চালু হয়ে আসছে। যেমন শ্রীলংকায় গোড়া থেকেই শাফেয়ি মাযহাব চালু ছিল। আমাদের মতো দেশে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাবের অনুসরণ না করাই নিরাপদ। কেননা তাতে সাধারণ মুসলমানের মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। একই অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি চালু থাকলে কোন্দল সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকে নিজেদের সর্বোচ্চ সত্যাশ্রয়ী দাবি করে। তার মানে এই নয় যে, ভিন্ন মতাবলম্বী থাকা নিষিদ্ধ। তবে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যাবশ্যকীয়। যেমনটা মক্কা-মদিনায় দেখা যায়। চার মাযহাবের মুসলমানই সেখানে বসবাস করে। অথচ নামাজের পদ্ধতিগত পার্থক্যে কেউ কাউকে কটাক্ষ করে না, বক্র দৃষ্টিতে দেখে না। আজকাল বাংলাদেশে হানাফি মাযহাবের অনুসারীদের মসজিদে কেউ সুরা ফাতেহা শেষে সশব্দে আমিন বললে কিংবা রুকুর আগে-পরে হাত উত্তোলন করলে অবশিষ্ট মুসল্লিগণ বাঁকা চোখে তাকায় কিংবা ভিন্ন মতাদর্শী বলে কটাক্ষ করে। আবার আহলে হাদিস মসজিদগুলোতে কেউ যদি বুকে হাত না রেখে নাভির নিচে রাখে, রুকুর আগে-পরে হাত না উঠায়, তবে কোন কোন অতি উৎসাহী সে মুসল্লির নামাজ-ই হয়নি বলে ফতোয়া দিয়ে বসে। ব্যস! শুরু হয় ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি। কিন্তু কেন? নামাজের এ সকল পদ্ধতিই তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর এসবের কোনোটি সুন্নত, কোনোটি বা মুস্তাহাব। যা ত্যাগ করলেও নামাজের বিশুদ্ধতায় ত্রুটি হবে না। কেননা এগুলো ইসলামের মৌলিক বিষয় নয়। ইসলামের মৌলিক বিষয় হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। আর এ মৌলিক বিষয়ে তো কোন ভিন্ন মত নেই। কীভাবে আদায় করবে- সে ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকলেও সবগুলোই হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। হাদিস বিশারদদের পর্যালোচনায় একটি অপরটির তুলনায় উত্তম হতে পারে। এই উত্তম-অনুত্তমের প্রশ্নে মুসলমানদের ঐক্য-সংহতিতে ফাটল রাখা, মুসলিম-সমাজে দলবাজি-বিশৃঙ্খলা নিতান্ত বোকামি নয় কি!
প্রিয় পাঠক! নামাজের পদ্ধতিগত ভিন্নতার বিষয়গুলো যে হাদিসে প্রমাণিত, আসুন দেখে নিই-
হাত নাভির নিচে নাকি বুকে বাঁধবে
নাভির নিচে হাত বাঁধার প্রমাণ: হযরত আবু ওয়াইল হতে বর্ণিত, হযরত আবু হুরায়রা (রদি.) বলেছেন: ‘নামাজের মধ্যে এক হাত অন্য হাতের ওপর রেখে নাভির নিচে স্থাপন করবে।’ (আবু দাউদ)
বুকে হাত বাঁধার প্রমাণ: হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রদি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নামাজ আদায় করেছি। (আমি দেখেছি) তিনি নিজের ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে বুকের ওপর রাখলেন। (বুখারি : পৃ. ১০২; মুসলিম : পৃ. ১৭৩; তিরমিযি : পৃ. ৫৯)
রফয়ে ইয়াদাইন তথা রুকুর আগে-পরে দুই হাত উত্তোলন
হাত না উঠানোর প্রমাণ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রদি.) বলেন: ‘আমি কি তোমাদের নবিজির নামাজ পড়ে দেখাব না? তারপর তিনি নামাজ পড়লেন এবং শুধু প্রথমবারে (তাকবিরে তাহরিমার সময়) হাত উঠালেন। (আবু দাউদ : হাদিস নং ৭৪৮; তিরমিযি, হাদিস নং ২৫৭)
ইমাম তিরমিযি বলেন, হাদিসটি হাসান অর্থাৎ বর্ণনা ও আমলযোগ্য। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা আহমদ শাকের (রহ.) হাদিসটির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন- এই হাদিসকে ইবনে হাযমসহ অন্যান্য হাদিস বিশারদগণ বিশুদ্ধ বলেছেন।
হাত না উঠানোর পক্ষে আরেকটি হাদিস হলো- হযরত বারা ইবনে আযিব (রদি.) বলেন: ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায আরম্ভ করতেন, তখন তাঁর হস্তদ্বয় কর্ণদ্বয় পর্যন্ত উত্তোলন করতেন। তারপর তা আর করতেন না। (আবু দাউদ : হাদিস নং ৭৫০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : হাদিস নং ২৪৫৫)
হাত উঠানোর প্রমাণ: হযরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (রদি.) তার পিতা থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত শুরু করতেন, তখন উভয় হাত তাঁর কাঁধ বরাবর উঠাতেন। আর রুকুতে যাওয়ার জন্য তাকবির বলতেন এবং যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তখনও অনুরূপভাবে দু হাত উঠাতেন এবং সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদা ও রব্বানা অলাকাল হামদ বলতেন। কিন্তু সেজদার সময় এমন করতেন না। (বুখারি ২য় খন্ড, হাদিস নং ৬৯৯)
হাত কান বরাবর নাকি হাত বরাবর উঠাবে
কান বরাবর হাত উঠানোর প্রমাণ: হযরত মালিক ইবনে হুওয়ারিছ (রদি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকবিরে তাহরিমা উচ্চারণ করতেন, তখন হাতদ্বয় এতটুকু উত্তোলন করতেন, যাতে হাতদ্বয় কানদ্বয় বরাবর হতো... (মুসলিম, হাদিস নং ৩৯১)
কাঁধ বরাবর হাত উঠানোর প্রমাণ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রদি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, যখন তিনি নামাজে দাঁড়াতেন তখন তিনি হাতদ্বয় এতটুকু উঠাতেন; যাতে হাতদ্বয় কাঁধ বরাবর হতো... (বুখারি, হাদিস নং ৭৩৬; মুসলিম, হাদিস নং ৩৯০)
এটি হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা (রদি.) প্রমুখের অভিমত।
সুরা ফাতেহা শেষে আমিন আস্তে নাকি জোরে
উচ্চৈস্বরে কেরাতবিশিষ্ট নামাজে মুসল্লিদের আমিন বলা সংক্রান্ত একটি হাদিস হলো: হযরত আবু হুরায়রা (রদি.) থেকে বর্ণিত, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘যখন ইমাম আমিন বলে, তখন তোমরাও আমিন বলবে। কেননা যার আমিন ফেরেশতার আমিন-এর সঙ্গে মিলে যাবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৭৮০)
উক্ত হাদিসের আলোকে একদল বলেন, আমিন সাধারণভাবেই জোরে বলতে হবে। আরেকদল বলেন, ফেরেশতারা তো জোরে আমিন বলতে শোনা যায় না, তাই আস্তে বলতে হবে। যেহেতু হাদিসে জোরে আস্তের বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়।
নামাজ শেষে সম্মিলিত মুনাজাত
হযরত ছাওবান (রদি.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন ব্যক্তি লোকদের ইমাম হয়ে এমন হবে না যে, সে তাদেরকে বাদ দিয়ে দোয়াতে কেবল নিজেকেই নির্দিষ্ট করে। যদি এমন করে, তবে সে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। (তিরমিযি, হাদিস নং ৩৫৭)
উক্ত হাদিসকে প্রমাণস্বরূপ পেশ করে একদল বলেন, নামাজের পর সম্মিলিত মুনাজাত সুন্নত বা মুস্তাহাব। আরেকদল বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামাজের পর মুসল্লিদের নিয়ে সম্মিলিত দোয়া করতেন না। তাই তা সুন্নত নয়; বরং বিদয়াত। এ নিয়ে মসজিদে তুমুল দ্ব›দ্ব-বিবাদ দেখা যায়। এমনকি এ ইস্যুতে নিজেদের মতাদর্শের ইমাম নিয়োগের প্রতিযোগিতায় ঘনঘন ইমাম পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটছে। অথচ বিষয়টি সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব। নামাজের পর যার ইচ্ছে হয় দোয়া করল, যার মনপুত হয় না সম্মিলিত দোয়া করবে না। দোয়া করা কিংবা না করাতে তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু এ নিয়ে মুসল্লিদের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করলে কবিরা গুনাহ হবে এবং পরকালে দায়বদ্ধ থাকবে।
তাই আসুন, আমরা নামাজের শাখাগত মাসয়ালার মতপার্থক্যের বিষয়ে হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করি এবং প্রত্যেকের মতাদর্শকে সম্মান করি। মুসল্লি সকলেই নবির উম্মত। নবিজির সুন্নাহ মেনেই জীবন-যাপন করছে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সহনশীল ও ভ্রাতৃত্বসূলভ আচরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন