মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত যে জীবন তার অতীত কাহিনীও কি কম সমৃদ্ধ? তা না হলে এত বছর পরে এসে কেন মনে পড়বে সেই শীর্ণকায় কিশোরের কথা, ক্লাস ফাইভের ছাত্র, রশীদ আলীর মুক্তি চাই ¯েøাগান দিতে দিতে ১০-১২ মাইল মিছিল করে বহু দূরে অজানা গৃহস্থবাড়িতে রাত্রিযাপন হবে যার ললাট লিখন। সে কি আমি? তারপর ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৬-এর বছরগুলোতে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ। অবশেষে এলো যথার্থ যুদ্ধ, বাঁচা-মরার লড়াই। চট্টগ্রামে শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রতিরোধ সংঘ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে টোমদন নিয়ে বসে সিগন্যালিংয়ের দায়িত্ব পালন পরে রাউজান, রাঙ্গুনীয়া, রামগড়, আগরতলা, নরসিংগড়, কলকাতা, দিল্লি, বইরুদ, দামেস্ক, আলেপ্পো ঘুরে এসে মুক্তিযুদ্ধের মিশন নিয়ে প্যারিস যাবার পথে কলকাতা প্রত্যাবর্তন। রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তির একটা পরিচিতিপত্র ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
ড. ফারুক আজিজ খান এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। খুবই স্মার্ট একজন কম বয়সী বাঙালি মহিলার অফিসে গিয়ে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন করে এলাম। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। দিল্লি থেকে ফরাসি লঁমোদ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি কলকাতা এসে কয়েক জায়গায় ফোন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দুুপুরে পার্ক হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজের আমন্ত্রণ। একথা-সেকথার পর অভিনন্দন জানিয়ে বলল, এরপর তো দেখা হবে ঢাকায়। জানো কি, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? আশ্চর্য সীমান্তে সামান্য সংঘর্ষ ছাড়া সে দিনের সংবাদপত্রে তো এ ধরনের ইঙ্গিতবহ কোনো কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু ফরাসি বন্ধু যথার্থ খবরই পেয়ে গেছে তার ইনফরমার মারফত। ১ ডিসেম্বর প্রীতিশ নন্দী ও রিনার বাড়িতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ। দিল্লি থেকে আগত ড. লোকনাথ ভট্টাচার্য ও কলকাতার রাজনীতিবিদ ডা: গনি আরো কয়েকজন সঙ্গে ছিলেন সেখানে। গল্পগুজবে অনেক রাত হয়ে গেল। ডা: গনি একটা ট্যাক্সি ডেকে আমাদের তাতে তুলে দিলেন। টুকে রাখলেন ট্যাক্সির নম্বর। গোবরা রোডে কবরস্থানের পাশে তেতলা বাড়ির দেড় তলায় গাড়ি রাখার গ্যারেজের ওপর ছোট একটি কক্ষ আমাদের বিশেষ বাসগৃহ। নিচের তলায় থাকেন সস্ত্রীক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ কন্যা ও জামাতা, তাদের দুই ছেলেমেয়ে, ভাগ্নে, শ্যালক ও বহুকালের এক আশ্রিতা চম্পা খালা। পাশের ফ্ল্যাটে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামের মুখ্য সচিব ও তাঁর স্ত্রী (ফজলে হাসান আবেদের কাজিন), দোতলায় প্রফেসর মুশাররফ (অর্থনীতিবিদ) ও তার বিদেশি স্ত্রী, তেতলায় পুলিশের বড় কর্তা আবদুল খালেক সাহেব ও তাঁর পরিবার।
রাত দুইটার পর আমার স্ত্রীর শরীরে খারাপের আলামত দেখা গেল। নিচে গিয়ে শাশুড়ি –মামনিকে খবর দিতেই তিনি হায় হায় করে উঠলেন। সবাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। যা হোক বাড়িওলার দারোয়ানের বদৌলতে টেলিফোন ব্যবহার করা সম্ভব হলো। ভাগ্যিস আগেভাগে বলা-কওয়া ছিল। ড. আনিসুজ্জামান নিজেই বলে রেখেছিলেন। তবু সসঙ্কোচে তার আত্মীয় বাড়িতে এই গভীর রাকে ফোন করলে দেখা গেল তারা তখনো ঘুমোয়নি। আনিস ভাই দ্রæত গাড়ি নিয়ে এলেন এবং আমাদের পার্কভিউ নার্সিং হোমে পৌঁছে দিলেন।
এই নার্সিং হোমের প্রধানমন্ত্রী বিলাতী ডিগ্রিধারী ডা. আনোয়ারা খাতুন। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা ও দক্ষ চিকিৎসক। তার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ফরিদপুর নিবাসী এক কর্মী। প্রথমবার স্ত্রী নাসরীনকে নিয়ে আমি ডা. আনোয়ারার চেম্বারে গিয়ে অবাক হয়ে যাই। ছোট্ট কামরা কিন্তু একটা দেয়ালজুড়ে বিরাট এক ছবি- যে ছবি আমরা ক্ষুদ্রাকারে দেখেছি সাময়িকপত্রে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন শেরেবাংলার বাসভবনে। সামনে অতিথির জন্য অনেক আঙুর ও অন্যান্য ফলমূল। সাদা-কালো ছবি কিন্তু খুবই তাৎপর্যবহ। যাহোক, স্ত্রীকে রেখে আমরা শেষরাতে বাসায় ফিরলাম। সকালে গিয়ে পৌঁছতে প্রায় ন’টা বেজে গেল। ইতোমধ্যে মা ও শিশুপুত্র রৌদ্রোজ্জ্বল একটি কক্ষে শুয়ে আছে। নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনায় খাওয়া-দাওয়া ছিল খুবই চমৎকার। সুসাহিত্যিক আবু সাঈয়িদ আইউব ও গৌরী আউউবের একমাত্র পুত্র সন্তান পূষণ নামেই নবজাতককে ডাকতে আমাদের ভালো লাগল। শুনেছি, আইউবের সন্তান পূষণ মুম্বাই থাকে এখন। আজ সে একজন অ্যাপ্লাইড ফিজিসিস্ট। আমাদের ছেলে পূষণ ঢাকায় আছে একই ডিগ্রি নিয়ে। বৈরুতে যে আরব সাংবাদিক বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠাকালেই মোল্লা জালাল ও আমাকে সহায়তা দান করেছে এবং ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমার ইংরেজিতে লেখা ঝটঋঋঊজওঘএ ঐটগঅঘওঞণ ওঘ ইঅঘএখঅউঊঝঐ আরবীতে অনুবাদ করে পুস্তিকা করে ছাপিয়ে কয়েক হাজার কপি বিলির ব্যবস্থা করেছিল সেই নাবিল বা রাদিব ‘নাবিল’ নামটিও ধার নিলাম ছেলেটির আসল নামের জন্য। সে হলো নাবিল শাহ কোরেশী, আমাদের প্রথম সন্তান।
এদিকে ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এসে জনসভায় ভাষণ দেবেন। মহা হুলুস্থুল, কী হবে কী হতে যাচ্ছে? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় কেউ তেমন খুশি হতে পারল না। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে খবর শোনা গেল : পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে, প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলো। কলকাতার রাস্তা হয়ে গেল বাতিহীন। পার্ক এভিনিউ থেকে মাইকেলের কবর পেরিয়ে গোবরা রোডের দীর্ঘপথ আমাকে এক নিশ্চিহ্ন অন্ধকারে অতিক্রম করতে হলো কয়েক দিন।
দু’দিন যুদ্ধ চলার পর ভারত বাংলাদেশকে দিলো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। আরো দু’দিন পর ভুটানও তাই করল। এতে জনমনে ভয়ানক আলোড়ন দেখা দিলো। সবাই খুশি বিভিন্ন ফ্রন্টে তখন মারাত্মক লড়াই চলছে, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে চলছে বাকযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী সংঘবদ্ধ হয়ে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। বিজয় আসন্ন। খ-যুদ্ধ চলছে চার দিকে। ভারতীয় বিমান বোমা ফেলছে ঢাকায়। কিন্তু কই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তো আত্মসমর্পণ করছে না?
অবশ্য ৯ ডিসেম্বর অবধি আমি বেশি উৎকণ্ঠিত ও ব্যতিব্যস্ত ছিলাম ব্যক্তিগতভাবে। সকালে ও বিকেলে দুবার যাই নার্সিং হোমে। ৯ তারিখ বেশ বড় দুই প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে গেলামÑ এক প্যাকেট সেবিকাদের জন্য, অন্যটির প্রাপক ডা. আনোয়ারা। তার অফিসে চমৎকার ব্যবহার পেলাম। আমাদের সবার ভয় ছিল এই প্রথম শ্রেণীর ক্লিনিকে কত না বিল দিতে হবে। কমপক্ষে হাজার টাকা। আশ্চর্য অনেক ছাড় দিয়ে মাত্র ছয়শ’ টাকারও কম পাওনাগ-া বুঝিয়ে রেহাই পেলাম। স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি চেপে চলে এলাম গোবরা রোড। আত্মীয়স্বজনরা অপেক্ষা করেছিল অভ্যর্থনার জন্য। মিসেস মুশাররফ নরওয়ের মহিলা হয়েও এর পরের এক মাস প্রতিদিন বাচ্চাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গোসল করাতেন। শাশুড়ির নির্দেশে পরদিন সকালে অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ড. মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামান, ব্যারিস্টার সালাম ও তিন প্রতিবেশীর বাড়ি ঘুরে এলাম সুসংবাদ বহন করে।
অবশেষে পুনঃযোগাযোগ শুরু হলো বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে- হোসেন আলী, মাহবুবুল আলম চাষী, অধ্যাপক খালেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ, রফিক মাহমুদ ও আনোয়ার করিম চৌধুরী (জয়) প্রমুখের সান্নিধ্যে চলে এলাম। তাদের কেউ কেউ কিছু ফরাসি ভাষায় ডেসপাস চিঠিপত্র, সংবাদ ক্লিপিং আমার হাতে তুলে ধরলেন। প্রয়োজনে অনুবাদ করে বুলেটিন বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। ফরাসিভাষী সাংবাদিকদের দিতে হচ্ছে সাক্ষাৎকার চার দিকে প্রবল উত্তেজনা হানাদার বাহিনী ‘সারেন্ডার’ করবে নাকি মার্কিন সপ্তম নৌবাহিনীর প্রতীক্ষায় কালক্ষেপণ করবে?
অবশেষে জানা গেল, ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযুদ্ধের মিশন আপাতত সমাপ্তি লাভের শুভক্ষণ এসে গেছে। রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের আয়োজন চলছে। বাংলাদেশ মিশনজুড়ে মহা হুলুস্থুল। চার দিক থেকে শরণার্থী আর স্থানীয় উৎসাহীদের হৈ চৈতে সেখানে অবস্থান কঠিন হয়ে পড়ল। চার দিকে অজ¯্র বাজি ফুটতে লাগল। একপর্যায়ে অসুস্থ বোধ করে আমি বাসায় ফিরে এলাম। শুয়ে-বসে রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষের উল্লাস শুনতে পাচ্ছি। এর মধ্যে কেউ কেউ সত্বর ঢাকা যাবার ঘোষণা দিচ্ছে, ঢাকায় ব্যবসা করবে, চাকরি করবে কত কিছু! পরদিন সকালে নিউমার্কেটের কাছে দেজ মেডিক্যাল সেন্টারে ওষুধপত্র কিনতে গেলে শুনি : কী দাদা। কবে শাখা খুলছেন ঢাকায়? আর সঙ্গে নানা উচ্ছ¡াসময় বাক্য বিনিময়! মনে হলো, এ কী ধরনের পরিস্থিতি! পরদিন সকালে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানসহ যোধপুর পার্কে অন্নদাশংকর রায়ের বাড়িতে গেলাম। মিসেস নীনা রায় অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাকে বৈঠকখানায় বসালেন। একথা-সেকথার পর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটিও উঠল। আমরা কি সত্বর পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়ব? ঠিকমতো খোলামেলা না হলেও চার দিকের অবস্থাদৃষ্টে সৈয়দ আলী আহসান বিষয়টি সম্পর্কে তার আশঙ্কার প্রকাশ ঘটালেন। কিন্তু প্রাজ্ঞ অন্নদাশঙ্কর অত্যন্ত যৌক্তিক ভঙ্গিতে মতামত জানালেন ভারতের নিজস্ব সমস্যার কারণে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বহির্ভারত বা বিশ্বমুখী ধ্যান-ধারণা নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র গন্ডিতে আবদ্ধ হতে চাইবে না। এখন যা হচ্ছে তা সাময়িক। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আমরা সেদিন বাসায় ফিরলাম। কিন্তু ১৮ তারিখ সংবাদপত্রে ঢাকার বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের খবর জেনে আমরা অনেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে অশ্রæপাত করতে থাকলাম। অবশ্য ১৬ তারিখ থেকে মাঝে মাঝে এটা হচ্ছে। কার আত্মীয়স্বজন কোথায় লুকিয়ে আছে, বেঁচে আছে? বঙ্গবন্ধু কি জীবিতাবস্থায় ফিরে আসবেন আমাদের কাছে? মাথায় ও মনে এসব দুশ্চিন্তা নিয়ে বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটা কথিকা লিখতে বসলাম।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, গণবিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন