ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হতে হবে? কিছু মানুষদের ধারণা, যেহেতু ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিয়েছিল, তাই বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা। কিন্তু প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ড. আকবর আলী খান বলেছেন ভিন্ন কথা। সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত তাঁর বক্তব্য সম্বলিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: ভারতের কাছে (বাংলাদেশের) চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়।
আসলে কোনো স্বাধীন দেশই অন্য একটি দেশের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকতে পারে না। কারণ, যে কোনো স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কাজ যারা করবে বা যাদের কাছ থেকে করার আশঙ্কা থাকে, সেসব দেশের প্রতি চোখ বুজে চিরকৃতজ্ঞ থাকা হবে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীন-স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রাখা এবং তাকে শক্তিশালী করাই যে কোনো স্বাধীন দেশের নেতাদের প্রধান কাজ। এর অন্যথা করতে চাওয়া সব সময়ই আত্মঘাতী এবং বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
এ ব্যাপারে আমাদের নিজেদের ইতিহাস থেকেও উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সকলেই জানেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে যারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নং ধানমণ্ডির বাড়িতে গেছেন, তাদের সকলকে বিনা বিলম্বে ভারতে পালিয়ে যেতে তিনি নির্দেশ দেন। তিনি নিজে কোথাও না গিয়ে বাড়িতেই থেকে যান। সেখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি থাকেন স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর তিনি পাকিস্তানের বন্দিশালা হতে প্রথম লন্ডন যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির পরও বাংলাদেশে কিছু ভারতীয় সৈন্য রেখে দেয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে তাঁর যথাকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। তিনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি কালে প্রথম সুযোগেই ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনি আপনার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে কখন ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন চাইবেন, তখনই। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য অপসারণ সহজ ও সম্ভবপর হয়ে পড়ে। তবে একথাও সত্য যে, তখন সারা বিশে^ বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এত অধিক ছিল যে, তাঁর ইচ্ছার বিপরীত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এখানে আরেকটি উদাহরণ দেয়াও সম্ভবত অপ্রাসাঙ্গিক হবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পদিন পর পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের ঐ সম্মেলনে যোগদানের ঘোর বিরোধিতা করে। ফলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কঠিন সমস্যায় পড়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা সাহেব সোজা কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, তুমি যদি একটা স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাক, তাহলে তোমার মনে যা চায়, তাই করো। আর তুমি যদি তা না হয়ে ভারতের মিত্র নেতা হয়ে থাক, তাহলে ভারত যা বলে, তাই করো। মওলানা সাহেবের এ জবাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়ে উঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন লাহোর সম্মেলনে যোগ দেবেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন লাহোর সম্মেলনে যোগ দিতে যান, সেদিন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
উল্লেখিত ঘটনাবলী থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? কোনো প্রকৃত স্বাধীন দেশই অন্য কোনো দেশের চিরদিনের জন্য বন্ধু হতে পারে না। প্রত্যেক দেশকে তার নিজস্ব স্বাধীনসত্তার ও বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ যেমন একটি স্বাধীন দেশ, তেমনি একটি মুসলিমপ্রধান দেশও। মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মুসলিম বিশে^র সঙ্গে আদর্শের বন্ধনে আবদ্ধ। এই আদর্শের বন্ধন অস্বীকার করা তার স্বাধীন সত্তাকে আংশিক অস্বীকার করার শামিল।
এখানে আরেকটি কথা বলে রাখাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ইসলাম এমন একটি শক্তিশালী জীবনবিধান, যা অন্যান্য ধর্মের প্রতি উদারতার শিক্ষা দেয়। সেই কারণে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোকেরাও শান্তির সাথে বসবাস করতে পারছে। অথচ, আমাদের নিকটতম হিন্দুপ্রধান ভারতে এবং বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারে সম্ভবপর হচ্ছে না। ভারতে বর্তমানে চলছে গোঁড়া হিন্দু সংগঠন বিজেপির শাসন। যখন-তখন সেখানে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লেশমাত্র নেই।
এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। একবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু লোক এমন একটা সময়ে বাংলাদেশে এসে হাজির, যখন ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা চলছিল। তারা ভেবেছিল, বাংলাদেশে এসে হয়ত দেখবে এখানে মুসলমানরা উত্তেজিত হয়ে ভারতবিরোধী বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু তারা অবাক বিস্ময়ে দেখে, এখানকার কোনো মুসলমানের মধ্যে সেরকম কোনো চিন্তাই নেই, যদিও তারা অত্যাচারিত মুসলমানদের জন্য দুঃখ ও সমবেদনা বোধ করছে।
এবার মিয়ানমারের কথা। মিয়ানমার একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশ। মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী একটি দেশ হওয়ায় আরব থেকে প্রথম যুগের অনেক লোক ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রে এসে ঐ দেশে বসতি স্থাপন করেন। ঐসব লোকেরা অনেকে বাঙলা ভাষাও চর্চা করতেন। বিখ্যাত গবেষক ড. মুহাম্মদ এনামূল হকের লেখায় তার পরিচয় আছে। বিখ্যাত কবি আলাওল, কোরেশী মাগব ঠাকুর, দৌলত কাজী প্রমুখের রচনার কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। অথচ, আজ মিয়ানমার মুসলিমবিরোধী। সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানরা সেনাবাহিনীর জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার। সারা বিশ^ই তাদের অত্যাচারের খবর জানে এবং এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এখনো তারা মিয়ানমার থেকে মুসলমানদের তাড়াতে কোনো দ্বিধাবোধ করছে না। কোনো মানবিকতার চিন্তাই তারা করছে না। অথচ, মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো বহু বৌদ্ধ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পর থেকেই বৌদ্ধরা মুসলমানদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলমানদের সাথে তাদের অতীতে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। বরং বৌদ্ধরা এক শ্রেণির গোঁড়া হিন্দুর হাতে নিপীড়িত হয়েছে। এক উগ্রপন্থী হিন্দু ধর্মনেতা একসময় বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং বলেন, কোনো বৌদ্ধকে দেখামাত্রই হত্যা করতে হবে। তা না করলে তাকে অনন্ত জীবন নরকে বাস করতে হবে। আর দেখা মাত্র বৌদ্ধকে হত্যা করলে সে অনন্তকাল স্বর্গে বসবাস করতে পারবে। এর ফলে বৌদ্ধদের অনেকে জন্মভূমি থেকে পালিয়ে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড প্রভৃতি এলাকায় যেয়ে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করে। অনেকে প্রাণরক্ষা করতে ইসলাম গ্রহণ করে। টেকনাফ থেকে খাইবার গ্রন্থের লেখক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী প্রমুখ বহু বিখ্যাত বৌদ্ধ গবেষকদের লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন